অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় শেষে নতুন সূর্য উঠেছিল আজ

অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় শেষে নতুন সূর্য উঠেছিল আজ
সেদিন রাস্তায় রাস্তায়, বাড়ি ছাদ থেকে সবাই ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার করছিল। অনেকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে স্বাধীনতা উদযাপন করছিল। ছবি: সংগৃহীত

সে দিনের শুরুটা ছিল ভয়াবহ রাতের শেষে জ্বলে ওঠা সূর্যের মতো স্নিগ্ধ, সূর্যের আলো যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় শেষে নতুন দিনের আশা নিয়ে এসেছিল।

একাত্তরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাতাসে স্বাধীনতার বার্তা বইছিল। ৯ মাস ধরে জাতিকে যে ভয় ও উদ্বেগ আঁকড়ে ধরেছিল তা ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করে। বিজয়ের আশা ঢাকার নাগরিকদের ক্রমশ শক্ত করে তুলছিল।

ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকা শহরে প্রবেশ করে বিভিন্ন স্থান দখল করতে শুরু করে। একই সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ বাহিনী তাদের সেনাবহর নিয়ে শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রায় নতজানু করে ফেলে।

ডিসেম্বরের শুরুর দিকে যৌথবাহিনীর আক্রমণ শুরু করে। যুদ্ধবিমানগুলো বোমাবর্ষণের জন্য মাথার ওপরে চক্কর দিতে থাকে, কামানগুলো প্রস্তুত ছিল, রাতে বাধ্যতামূলকভাবে ব্ল্যাকআউট জারি করা হয়েছিল। আত্মসমর্পণের বার্তা সম্বলিত লিফলেটগুলো প্লেন থেকে ছোড়া হতো। রেডিওতেও এ ধরনের আহ্বান বারবার শোনা যাচ্ছিল। বিদেশি সাহায্যের সমস্ত আশা হারিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল তখন শূন্যের কোঠায় নেমে গিয়েছিল।

এর মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর বেলা ১টার দিকে, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেএফআর জ্যাকব আত্মসমর্পণের বিষয়ে আলোচনা করতে পাকিস্তানি বাহিনীর সদর দপ্তরে পৌঁছান। পাকিস্তানের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলে সামরিক কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজি তাকে অভ্যর্থনা জানান।

'কর্নেল এমএস খারা আত্মসমর্পণের শর্ত পড়ে শোনান। তখন নিয়াজির গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছিল। রুমটিতে তখন শুনশান নীরবতা। অন্যরা অস্থির হয়ে উঠছিল', 'সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব অ্য নেশন' বইয়ে লিখেছেন জ্যাকব।

পাকিস্তানি বাহিনী আশা করেছিল যে দলিলে জাতিসংঘের নীতিমালা অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি ও সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়ার বিষয় উল্লেখ থাকবে।

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণে আপত্তি জানান। নিয়াজি বলেছিলেন, জ্যাকব তাকে যেখানে স্বাক্ষর করতে বলছিলেন তা ছিল নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ।

জ্যাকব আশ্বাস দিয়েছিলেন, তাদেরকে যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে যুদ্ধবন্দী হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং জেনেভা কনভেনশন কঠোরভাবে মেনে চলা হবে, সমস্ত জাতিগত সংখ্যালঘুদের মর্যাদা রক্ষা হবে।

'আত্মসমর্পণে এই ধরনের নিশ্চয়তা ও এই ধারাগুলো ছিল অনন্য, যা অন্য কোনো আত্মসমর্পণ দলিলে পাওয়া যায় না', জ্যাকব লেখেন।

নিয়াজি দলিলটি অন্যদের কাছে দেন। তারা কিছু পরিবর্তন চেয়েছিল। জ্যাকব আবার তাদের জানান, দলিলে যেসব শর্ত রয়েছে সেগুলো খুব উদার।

'আমি তাকে (নিয়াজিকে) জিজ্ঞেস করলাম, এই দলিল গ্রহণযোগ্য কিনা। তিনি কোনো মন্তব্য না করেই দলিলটি আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। আমি সেটিকে তার সম্মতি বলে ধরে নিই,' জ্যাকব বলেন।

এরপর দুই পক্ষ আত্মসমর্পণের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে। নিয়াজি বলেছিলেন, তিনি তার অফিসে আত্মসমর্পণ করতে চান। জ্যাকব তাকে বলেছিলেন যে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে রমনা রেসকোর্সে।

তার মতে, ঢাকাবাসীদের এত ভয়ঙ্কর কষ্টের কথা বিবেচনা করে জনসাধারণ সামনে আত্মসমর্পণ করাই উপযুক্ত।

তবে নিয়াজি এর বিরোধিতা করেন।

জ্যাকব উল্লেখ করেছেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার এবং বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথবাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে ভারতীয় ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা গার্ড অব অনার দেবেন। এরপর অরোরা ও নিয়াজি দলিলে স্বাক্ষর করবেন। নিয়াজি এরপর তার তলোয়ার সমর্পণ করবেন।

জ্যাকবের এমন প্রস্তাবে নিয়াজি জানান, তার কাছে তলোয়ার নেই।

জ্যাকব তখন নিয়াজিকে তার রিভলবার সমর্পণ করতে বলেন।

নিয়াজিকে অসন্তুষ্ট মনে হলেও তিনি চুপ করে রইলেন। জ্যাকব বলেন, 'আমি এটিকেও সম্মতি হিসেবে ধরে নিলাম।'

নিয়াজি তার বই 'দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান'-এ আত্মসমর্পণের ঘটনা স্মরণ করতে গিয়ে লিখেছেন যে জেনারেলদের মধ্যে রাও ফরমানের আচরণে তিনি নাটকীয় পরিবর্তন দেখেছিলেন। সংকটের সময় তিনি যে অপরাধবোধ ও দুর্বলতা প্রদর্শন করেছিলেন তা ফুটে উঠছিল। ২৫ মার্চের কঠোর সামরিক অভিযানে ফরমানের অংশগ্রহণ বাঙালিদের মধ্যে বিদ্বেষ ও ক্ষোভ জাগিয়ে তুলেছিল, বাঙালিরা তাদের বিরুদ্ধে তার কথিত অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল। তাকে গণহত্যার জন্যও দায়ী করা হয়েছিল যার কারণে তিনি ভীত হয়ে পড়েন, তিনি পালাতে চেয়েছিলেন।

'আমি বিক্ষুব্ধ ছিলাম কারণ ভারতীয় প্রস্তাব অপর্যাপ্ত ছিল, বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ হেফাজতের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা তুলে ধরতে এই প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছে,' নিয়াজি লিখেছেন।

নিয়াজি ২টি শর্ত দিয়েছিলেন। প্রথমত, পাকিস্তান সৈন্যরা তাদের ব্যক্তিগত অস্ত্র নিজেদের সুরক্ষার জন্য এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য রাখবে যতক্ষণ না ঢাকা এলাকায় তাদের সুরক্ষায় পর্যাপ্ত ভারতীয় সৈন্য আসছে এবং দ্বিতীয়ত, সব পাকিস্তানি বেসামরিক নাগরিকদের ছেড়ে দেওয়া হবে এবং তারা সৈন্যদের সঙ্গে থাকবেন।

জ্যাকব সহজেই প্রথম দাবিতে সম্মত হন, কিন্তু দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে যুক্তি দেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে ক্যাম্পে আটকা পড়া বাঙালিদের সঙ্গে অদলবদল না হওয়া পর্যন্ত বেসামরিক নাগরিকদের বাংলাদেশেই থাকতে হবে।

আলোচনার পর জগজিৎ সিং অরোরাকে অভ্যর্থনা জানাতে ঢাকা বিমানবন্দরে যান নিয়াজি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার 'উইটনেস টু সারেন্ডার' বইতে লিখেছেন, সেদিন বিকেলে নিয়াজি জগজিতকে মিলিটারি স্যালুট দেন এবং করমর্দন করেন। এটি একটি হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য ছিল। বিজয়ী এবং পরাজিতরা বাঙালিদের চোখের সামনেই দাঁড়িয়েছিল, সেসময় অরোরা ও নিয়াজির প্রতি তাদের চরম ভালোবাসা এবং ঘৃণার অনুভূতি গোপন ছিল না।'

আরোরার সঙ্গে অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। তিনি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন।

অরোরার জিপে তার সঙ্গে এ কে খন্দকার রমনা রেসকোর্স ময়দানের উদ্দেশে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যাত্রা করেন।

উচ্ছ্বসিত জনতার সাগর পাড়ি দিয়ে তারা রেসকোর্সের দিকে যান। ঠিক সেই ময়দান থেকেই ৯ মাস আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন, উচ্চারণ করেছিলেন "...এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা!'

পাকিস্তান বাহিনী, যারা গণহত্যা চালিয়েছিল, ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল, ৩ লাখেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করেছিল এবং যুদ্ধে হাজার হাজার বুদ্ধিজীবীকে অপহরণ ও হত্যা করেছিল তাদের এই আত্মসমর্পণ বাঙালির চোখে আনন্দাশ্রু নিয়ে আসে।

প্রাথমিক প্রতিরোধের পর, সেপ্টেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনীর অভিযান আরও সুসংগঠিত, আরও কার্যকর হয়। তারা ঢাকায় পাকিস্তানি সরকার ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মনোবল গুঁড়িয়ে দেয়।

সাধারণত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান যথাযথ প্রস্তুতির পর হলেও ১৬ ডিসেম্বরের দৃশ্যপট ছিল ভিন্ন। সেদিনের পুরো প্রস্তুতি খুব তাড়াহুড়ো করে সীমিত আয়োজনে হয়েছিল।

'অনুষ্ঠানটি ছিল অনাড়ম্বর এবং এটি অল্প সময়ে শেষ হয়,' এ কে খন্দকার তার '১৯৭১: ভিতরে বাইরে' বইয়ে লেখেন।

মাত্র দুটি চেয়ার আর একটি টেবিল ছিল। নিয়াজি একটি চেয়ারে বসলেন আর অন্যটিতে জেনারেল অরোরা বসলেন। ঘড়ির কাঁটায় ৫টা ১ মিনিট বাজতে না বাজতেই নিয়াজি প্রথমে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন এবং পরে স্বাক্ষর করেন অরোরা।

স্বাক্ষরের জন্য নিয়াজিকে কলম এগিয়ে দেন অরোরা। প্রথম দফায় কলমটি দিয়ে লেখা যাচ্ছিল না। অরোরা কলমটি নিয়ে কিছু ঝাড়াঝাড়ি করে পুনরায় নিয়াজিকে দিলেন।

'এ দফায় কলমটি আর অসুবিধা করেনি। পরে জেনেছি, ওই দিন শুধু আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করার জন্যই অরোরা কলকাতা থেকে কলমটি কিনে এনেছিলেন", এ কে খন্দকার বলেন।

আত্মসমর্পণের রীতি অনুযায়ী নিয়াজি তার রিভলবারটি কাঁপা কাঁপা হাতে অরোরার কাছে হস্তান্তর করেন। এর সঙ্গে প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল।

পড়ন্ত বিকেলের তীর্যক আলোতে এই ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণে বাঙালির ওপর ২৪ বছরের দীর্ঘ পাকিস্তানি দমন-পীড়নের অবসান ঘটে।

নিয়াজি নিজেই বলেছিলেন যে তিনি কাঁপা হাতে দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন। বেদনায় তার হৃদয় ভারী হয়ে যায়। হতাশা ও ভগ্নহৃদয়ে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ে।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আগে একজন ফরাসি সাংবাদিক নিয়াজির কাছে এসে বললেন, 'কেমন বোধ করছেন, টাইগার?'

'বিষণ্ন,' নিয়াজি উত্তরে বলেছিলেন।

সেদিন অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর শহরজুড়ে উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় রাস্তায়, বাড়ি ছাদ থেকে সবাই 'জয় বাংলা' বলে চিৎকার করছিল। অনেকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে স্বাধীনতা উদযাপন করছিল।

'আহ! আজ থেকে আমরা শান্তিতে, নির্ভয়ে শান্তিতে ঘুমাতে পারবো', এ কে খন্দকার লেখেন।

Comments

The Daily Star  | English

Jatiyo Party's office set on fire in Khulna

Protesters vandalised the Jatiyo Party office in Khulna's Dakbangla area last evening

1h ago