জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, ব্যাংকে আমানতবৃদ্ধির হার কমেছে
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় দেশের ব্যাংকগুলোতে আমানতবৃদ্ধির হার কমেছে।
আমানত পরিস্থিতির অবনতির আরেকটি কারণ হলো— ব্যাংকে সুদের হার কম হওয়ার আমানতকারীদের একটি বড় অংশ বিকল্প খাতে বিনিয়োগ করছেন।
আমানত কমে গেলে তা ব্যাংকের ঋণ প্রদান ও ব্যবসার ওপর প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট আমানত বছরে ৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫৭ কোটি ৬৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকায়, যা ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন আমানত প্রবৃদ্ধি।
গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত ত্রৈমাসিক তফসিলি ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের এপ্রিল-জুনে ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা থাকলেও তৃতীয় ত্রৈমাসিকে সামগ্রিক আমানত দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মধ্য ও স্থায়ী আয়ের মানুষ হিমশিম খাচ্ছেন। জীবনযাত্রার খরচ মেটাতে অনেক পরিবার সঞ্চয় বন্ধ করে দিয়েছে। একইসঙ্গে সঞ্চয়পত্র বিক্রির প্রবণতাও দেখা গেছে।'
আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় গত কয়েক মাসে মুদ্রাস্ফীতির উচ্চহার পরিলক্ষিত হয়েছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, 'আগস্টে মুদ্রাস্ফীতির হার ১০ বছরের সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ থাকলেও গত ৩ মাসে তা কিছুটা কমেছে। নভেম্বরে মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।
ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের রিটেইল ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান মো. মাহিউল ইসলাম বলেন, 'মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়েছে মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ে।'
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেডের (এমটিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, 'মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব ছাড়াও সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম ধীর হয়ে গেছে। ছোট আকারের ব্যবসাসহ অনেকের আয়েই এর প্রভাব পড়েছে।'
সম্পদের মূল্যবৃদ্ধির উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, '১ কোটি টাকার বেশি অর্থ জমা রাখা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের পরিমাণ কমেছে। এ ছাড়া, ব্যাংকে সুদের হার কম থাকায় অনেকেই সম্পদসহ অন্যান্য কাতে বিনিয়োগের দিকেও ঝুঁকছেন।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আমানতে সুদের গড় হার ছিল ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪ দশমিক ০৯ শতাংশ।
এপ্রিল-জুনে গড় আমানতের হার ছিল ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যা মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে অনেক কম।
ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আমদানি বিল নিষ্পত্তির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে প্রায় ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার নিয়েছে, যা সামগ্রিক আমানতকেও প্রভাবিত করেছে। অন্যদিকে ঋণ বিতরণ বেড়েছে বলে জানান এমটিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রা কেনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে বিপুল পরিমাণ তারল্য চলে যাওয়ায় তারল্য সংকট চলছে।'
আমানতবৃদ্ধির হার কমার পেছনে অর্থপাচার ও হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
'উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পণ্য ও সেবা কিনতে জনগণকে এখন আরও বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে', বলেন তিনি।
আহসান এইচ মনসুর আরও বলেন, 'বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ প্রদানে অনিয়মের কারণে জনমনে আস্থা সংকট তৈরি হওয়ায় অনেকে ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করে নিচ্ছেন।'
চলতি মাসের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমাদ কায়কাউস বলেন, 'একটি গুজব ছড়ানো হয়েছে যে, ব্যাংকগুলোর পর্যাপ্ত তহবিল নেই। এর ফলে সাধারণ মানুষ ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন।'
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'আমানতের হার কমে যাওয়ার মানে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারবে না। আর্থিক খাত ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব মারাত্মক।'
একই মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক কর্মকর্তা ফাহমিদা খাতুনও। 'ব্যবসা পরিচালনার জন্য ব্যাংকগুলোর ঋণযোগ্য তহবিল থাকবে না। এর প্রভাব তাদের মুনাফার ওপরও পড়বে', বলেন তিনি।
Comments