অস্তিত্ব সংকটে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের জন্মভিটা

বিপ্রবী-উল্লাসকরের-বাড়ি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ গ্রামে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের ঐতিহাসিক বাড়ির সামনের অংশে পাকা ভবন তৈরি করা হচ্ছে। ছবি: মাসুক হৃদয়/স্টার

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ গ্রামে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের ঐতিহাসিক বাড়ির সামনের অংশে পাকা ভবন তৈরি করে ঢেকে ফেলা হচ্ছে।

ফলে, বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অগ্নিগর্ভ বাংলার অন্যতম বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের সর্বশেষ স্মৃতি।‌

বাড়িটির সামনের অংশ ঢেকে বহুতল ভবন গড়ে তুলছেন ক্রয়-সূত্রে বাড়িটির মালিক দাবি করা কালিকচ্ছ ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আহমেদুর রহমান। যদিও বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের উত্তরসূরি নেই। পূর্বসূরি যারা ছিলেন তারা মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগেই ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন। তবুও এই সাবেক চেয়ারম্যান দাবি করেন, উল্লাসকর দত্তের জ্ঞাতি ভ্রাতুষ্পুত্র শিবেন্দ্র কুমার দত্তের কাছ থেকে বাড়ি ও পুকুরসহ ৮০ শতাংশ জায়গা তিনি ১৯৯০ সালে কিনেছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি কবি জয়দুল হোসেনের মতে, অগ্নিযুগের এই অগ্নিপুরুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে তার জরাজীর্ণ বাড়ির স্মৃতি সংরক্ষণ জরুরি।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ অথবা সরকারের যেকোনো মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এটি সংরক্ষণ করা উচিত।'

'বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের বাড়ি ঢেকে দিয়ে নতুন করে যে পাকা স্থাপনা করার কার্যক্রম চলছে, তা যদি সম্পন্ন হয় তাহলে বাড়িটি উদ্ধারের প্রক্রিয়া কার্যকর হবে না। স্থানীয় প্রশাসনের উচিত অতি দ্রুত পাকা স্থাপনা নির্মাণ কাজ বন্ধ করা,' যোগ করেন তিনি।

গত বুধবার দুপুরে কালিকচ্ছ গ্রামের ওই বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের সর্বশেষ স্মৃতি পূর্বমুখী বিশাল আয়তনের কাচারি ঘরটি জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। কাচারি ঘর ঘেঁষা উত্তর দিকের ছোট আরেকটি ভবনে সাবেক চেয়ারম্যান আহমেদুর রহমান পরিবার নিয়ে থাকেন। কাচারি ঘরটির সামনের অংশে (পূর্ব পাশে) বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য গর্ত খুঁড়ে ঢালাই করে রড বসানো হয়েছে।

সরাইল ইতিহাস পরিষদের নেতাদের অভিযোগ, উল্লাসকর দত্ত ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তার জন্মভিটা সংরক্ষণে এখনো পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ১৯৯০ এর দশকের শুরুর দিক থেকে এখন পর্যন্ত বাড়িটি সাবেক এক চেয়ারম্যানের দখলে।

তাদের আরও অভিযোগ, বর্তমান দখলদার ক্রয়-সূত্রে বাড়িটির মালিকানা দাবি করলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার দলিলপত্র ও মালিকানার বিষয়টি যাচাই করা হয়নি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লন্ডন থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত পণ্ডিত দ্বিজ দাস দত্তের ছেলে উল্লাসকর দত্ত ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত বিপ্লবী। তিনি আলীগড় মামলার আসামি ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যার বিশাল অবদান তার বাড়ি আজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।'

তিনি আরও বলেন, '২০০৫ সালের প্রত্নতত্ত্ব আইনে বলা আছে—১০০ বছরের বেশি পুরনো বাড়ি বা স্থাপনা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করবে। আমরা চাই সেই আইন অনুযায়ী প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করে এখানে স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার নির্মাণ করুক।'

এলাকাবাসী ডেইলি স্টারকে জানান, শতাব্দী প্রাচীন এই বাড়িটি অনেক বার ভেঙে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। একই গ্রামের বাসিন্দা ও সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা ঐতিহাসিক বাড়িটির স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য একাধিকবার জাতীয় সংসদে আবেদন জানানোর পরও প্রশাসনিকভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়নি।

সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই বাড়িটির সঙ্গে সরাইল তথা বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের ইতিহাস জড়িত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের অবদান সমগ্র ভারতবাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার, সরকারি ডাক লুণ্ঠনের মাধ্যমে যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জিইয়ে রেখেছিলেন, আজ তার বাড়ির অস্তিত্ব সংকটের মুখে।'

তিনি আরও বলেন, 'বাড়িটি উদ্ধার করে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমি বারবার জাতীয় সংসদে দাবি করেছি। এই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসটাকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।'

সরাইল উপজেলা ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ঠাকুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাড়িটির দলিল সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন মানুষের মধ্যে আছে বলে আমরা জানি। এর সুরাহা করতে প্রশাসনকেই এগিয়ে আসতে হবে। বাড়িটি উদ্ধারের মাধ্যমে সরাইল তথা বাংলাদেশের গর্ব বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।'

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাড়িটির মালিকানার বিষয়ে খোঁজ নিতে উপজেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।'

অবিভক্ত বাংলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ গ্রামে উল্লাসকর দত্তের জন্ম। তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। পরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজে পড়ার সময় ইংরেজ অধ্যাপক রাসেল বাঙালিদের সম্পর্কে কটূক্তি করায় তিনি ওই অধ্যাপককে আঘাত করেন। এজন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করেছিল।

পরে বিপিন চন্দ্র পালের অনুপ্রেরণায় উল্লাসকর দত্ত প্রথম বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন। এরপর যুগান্তর দলে যোগ দেন তিনি। তিনি বিস্ফোরক নির্মাণে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তার ফর্মুলায় তৈরি বোমা পরীক্ষা করার জন্য একদল বিপ্লবী বেছে নেন দেওঘরের কাছে নির্জন দীঘারিয়া পাহাড়। ১৯০৮ সালের ১ মে সেই পরীক্ষার দিন বোমা ছোড়ার সময় আহত হয়ে মারা যান বিপ্লবী প্রফুল্ল চক্রবর্তী। সেসময় উল্লাসকর মারাত্মক জখম হন।

উল্লাসকরের তৈরি বোমায় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে আক্রমণে ব্যবহার করেছিলেন। তবে ওই হামলা বানচাল হয়ে যায় এবং পুলিশ উল্লাসকর দত্তসহ যুগান্তর দলের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে।

উল্লাসকর ১৯০৮ সালের ২ মে মুরারিপুকুর বাগানে ধরা পড়েন। ১৯০৯ সালে আলিপুর বোমা মামলায় উল্লাসকর ও বারীণ ঘোষকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ওই সাজা রদ করে তাকে আন্দামানের সেলুলার জেলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা দেওয়া হয়।

আন্দামানের সেলুলার জেলে উল্লাসকর দত্তকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯২০ সালে মুক্তি দেওয়া হলে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।

১৯৩১ সালে আবার তাকে গ্রেপ্তার করে ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালে ভারতভাগের পর তিনি কালিকচ্ছ গ্রামে ফিরে আসেন। সেখানে ১৯৪৮ সালে ৬৩ বছর বয়সে বিপিন চন্দ্র পালের বিধবা মেয়েকে বিয়ে করেন।

১০ বছর পর ১৯৫৭ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে যান। উল্লাসকর তার শেষ জীবন ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরে কাটান।

১৯৬৫ সালের ১৭ মে তিনি সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

Comments

The Daily Star  | English

Managing expectations the challenge for EC

The EC was a rubber stamp to legalise AL's usurpation of power in last three elections

2h ago