ফারদিন হত্যায় আলোচিত মাদক আর অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য চনপাড়া
রাজধানী লাগোয়া জেলা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র (চনপাড়া গ্রাম)। তিন দিকে নদী এবং একদিকে খালবেষ্টিত প্রায় দ্বীপের মতো এই গ্রাম স্থানীয়ভাবে 'চনপাড়া বস্তি' নামেই বেশি পরিচিত। মাদক চোরাকারবারি ও অপরাধীদের অন্যতম 'স্বর্গরাজ্য' বলে পরিচিত এই চনপাড়া।
সম্প্রতি সারাদেশে চনপাড়া আলোচনায় আসে বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। পুলিশের তদন্ত বলছে, ফারদিনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি সর্বশেষ চনপাড়া এলাকায় সক্রিয় পাওয়া গেছে। এখানেই ফারদিনের হত্যাকাণ্ড হয়েছে ধারণা করেই তদন্ত চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক দল।
রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের একটি অংশ চনপাড়া। এই গ্রামে বসবাসরত মানুষজন ও অপরাধচক্রের সঙ্গে জড়িত কেউই এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা নন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভাসমান অবস্থায় এসে এই গ্রামে আশ্রয় নিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়াসার ১২৬ একর জমির উপর দেশের বিভিন্ন স্থানে নদীভাঙনে বাড়িঘর হারানো আশ্রয়হীন মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। এর নাম দেওয়া হয় চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র। শুরুতে সাড়ে ৫ হাজার পরিবারের পুনর্বাসন করা হলেও বর্তমানে চনপাড়ার মোট বাসিন্দা লক্ষাধিক। ভোটার রয়েছেন প্রায় ১৭ হাজার।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির ভাষ্যমতে, চনপাড়ার ভাসমান লোকজন শুরুতে দিনমজুরের কাজ করতেন। তবে আশির দশকের শুরুর দিকে এই অঞ্চলে মাদক কেনা-বেচা শুরু হয়। এই এলাকায় একাধিক বাহিনী মাদক বেচা-কেনাসহ চাঁদাবাজি, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টিসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত। গত কয়েকবছরে মাদক চোরাকারবারি ও অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে চনপাড়া।
সরেজমিনে চনপাড়া
চনপাড়া গ্রামে স্থলপথে ঢোকার একমাত্র পথ ডেমরা থেকে বালু সেতু। বালু সেতু পার হলেই চনপাড়া মোড়। চনপাড়াকে ৯টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের অসংখ্য অলিগলি। বাড়িঘর একটার সাথে অন্যটা লাগোয়া। চনপাড়ার দুই দিকে শীতলক্ষ্যা নদী এবং একদিকে বালু নদ। পার্শ্ববর্তী ডেমরা, নোয়াপাড়া ও মুড়াপাড়া থেকে নদীপথে চনপাড়ায় ঢোকা যায়। চনপাড়ায় প্রবেশের জন্য ৩টি খেয়াঘাট আছে।
স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ জানায়, বেশিরভাগ মাদকের চালান চনপাড়ায় নদীপথে ঢোকে। স্থলপথেও অভিনব কায়দায় মাদকের ছোট-বড় চালান আনা হয়। অস্ত্রের কেনা-বেচাও চলে এখানে। চনপাড়ার ভেতরে অর্ধশতাধিক চিহ্নিত মাদকের স্পট রয়েছে। মাদকের এইসব স্পট নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে রয়েছেন রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে 'সিটি' শাহীন, জয়নাল আবেদীন, রাজু আহম্মেদ ওরফে রাজা, শাহাবউদ্দিন, শমসের, রোকসানা, মোস্তফা, রায়হান, ফালান, শাওন, আনোয়ার, স্বপন, আসাদুল, শাহ্ আলম, শাহিদা, বিল্লাল, রওশানা, রহিমন, নাসির, শাহীন।
একসময় চনপাড়ায় সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য বিউটি আক্তার ওরফে কুট্টির নিয়ন্ত্রণ ছিল। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বিউটির স্বামী এম এ হাসান ওরফে হাসান মুহুরি খুন হন। দুই বছরের মাথায় ২০১৯ সালের জুনে খুন হন বিউটিও। বিউটি ও বিউটির স্বামী হত্যা মামলার আসামি জয়নাল, শাহীন, রাজা, আনোয়ারকে আসামি করা হয়। বিউটি মারা যাওয়ার পর চনপাড়া মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান বজলুর রহমান। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ প্রায় ডজনখানেক মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। যদিও মাদক চোরাকারবারি ও অপরাধীদের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ সবসময়ই অস্বীকার করে আসছেন বজলুর।
চনপাড়ার সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় পুলিশ, স্থানীয় বাসিন্দা ও সাংবাদিকদের সঙ্গে। চনপাড়ায় শুরু থেকে আছেন এমন একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, সত্তরের দশকের শেষের দিকে দুটি স্পটে গাঁজা বিক্রি ও সেবন হতো। শুক্কুর ও আলী নামে দুই ব্যক্তি এই স্পট দুটি নিয়ন্ত্রণ করতেন। আশির দশকের শুরুর দিকে মাদকের বিস্তৃতি বাড়তে থাকে।
তবে ২০১১ সালের পর থেকে মাদক পুরো চনপাড়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ইয়াবা, ফেন্সিডিল, গাঁজাসহ সবধরনের মাদক এখানে বিক্রি হয়। ৫ বছরে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ রূপ নিয়েছে। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে যেকোনো ধরনের মাদক। শুধু মাদকই নয় অপরাধীরা আশ্রয়স্থল হিসেবেও বেছে নেয় চনপাড়াকে। গত দুই দশকে মাদক চোরাকারবার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে চনপাড়ায় খুন হয়েছেন পুলিশের এক সদস্যসহ অন্তত ১৫ জন। এই সময়ে থানায় কেবল চনপাড়ার মাদক ও মাদক চোরাকারবারকে কেন্দ্র করে মারামারির ঘটনায় ২ হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দুই-তিনটা মামলা হয় বলেও জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান। যদিও অভিযোগ রয়েছে চনপাড়ার মাদক চোরাকারবারিদের কাছ থেকে মাসোহারা পায় পুলিশও।
স্থানীয় বাসিন্দা হারুন মিয়াজি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ১০ বছরে ভয়ানকভাবে চনপাড়ায় মাদকের বিস্তার বেড়েছে। প্রতিটি অলি-গলিতে মাদকের কেনাবেচা চলে। কয়েকজন ব্যক্তিই এসবের নিয়ন্ত্রক। তাদের শেল্টার দেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এলাকার শিক্ষিত ছেলেমেয়ে এই কারণে মাদকসেবন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। উপাসনালয়ের সামনেও মাদক বিক্রি চলে। এসব নিয়ে মাদক চোরাকারবারিদের মধ্যে মারামারির ঘটনা নিত্যদিনের।'
প্রশাসনিকভাবে কড়াকড়ি থাকলে মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলেন তিনি। তিনি বলেন, 'মাদক ও সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হিসেবে রূপ নিয়েছে চনপাড়া। এই গ্রামের পুরোনো বাসিন্দাদের অনেকেই তাদের ছেলেমেয়েকে গ্রামের বাইরে রাখেন। গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে।'
চনপাড়ার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের একটি মার্কেটের সামনে কথা হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এক তরুণের সঙ্গে। চনপাড়ার পরিবেশের কারণে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে থাকতে পারেন না বলে জানান বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা এই তরুণ।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এমন পরিস্থিতি এইখানে তাতে এখানে থাকা যায় না। মাদকের বিক্রি চলে প্রকাশ্যে। সেবন তো কথাই নেই। আমার বাবা-মা এইখানে থাকেন। আমি চাকরি করি বাইরে, সেখানেই থাকি। মাঝেমধ্যে বাবা-মার সঙ্গে দেখা করতে আসি। সুযোগ পেলে তাদের নিয়েই এই এলাকা ছেড়ে দিতাম।'
স্থানীয় ইউপি সদস্য বজলুর রহমানও চনপাড়ায় মাদকের বিস্তৃতির কথা স্বীকার করেন। তবে মাদক চোরাকারবারিদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন তিনি। দ্য ডেইলি স্টারকে বজলুর বলেন, 'সিটি শাহীন, জয়নাল, শাহাবুদ্দিন, শমসেরসহ ছোট-বড় অর্ধশত মাদক চোরাকারবারি আছে চনপাড়ায়। কয়েকবছর ধরে মাদকের বিস্তৃতি এই এলাকায় বাড়ছে এইটা সত্য, কিন্তু আশির দশকের শুরু থেকেই মাদক বেচাকেনা ছিল। এইসব নিয়ন্ত্রণে কাজ করি আমি। অথচ আমাকেই প্রতিবার মাদক চোরাকারবারিদের নেতা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।'
সরেজমিনে ঘুরে চনপাড়ায় রাস্তার পাশে কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো দেখা যায়। তবে সেসব ক্যামেরার সবগুলোই প্রতিষ্ঠানের দিকে ঘোরানো। রাস্তার দিকে না দিয়ে দোকানের দিকে ঘুরিয়ে রাখার কারণ জানতে চাইলে মো. রহিম নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, 'এলাকায় কোনো ঘটনা ঘটলে পুলিশ এলাকায় আইসা ক্যামেরা চেক করে। এই কারণে ক্যামেরা রাস্তার দিকে না রাইখা দোকানের দিকে ঘুরিয়ে রাখতে বলছে।'
কারা এমন নির্দেশ দিয়েছে প্রশ্ন করলে উত্তর না দিয়ে ওই দোকানি বলেন, 'গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাতে র্যাবের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ার পর থেকেই ক্যামেরা ঘুরাইয়া দিছে তারা। কে দিছে এইটা বলতে পারব না।'
তবে চনপাড়ার মাদক বিক্রি কিংবা অপরাধ কার্যক্রম নিয়ে সাধারণ কোনো ব্যক্তি প্রকাশ্যে মুখে খোলেন না। স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, চনপাড়ায় কোনো ঘটনা ঘটলে তার জন্য সংবাদ সংগ্রহে গেলেও মাদক চোরাকারবারিদের রোষানলে পড়তে হয়।
শীর্ষ সন্ত্রাসী বা অপরাধীরা লুকিয়ে থাকার জন্যও এই বস্তিকে বেছে নেন। গত ৯ নভেম্বর দুপুরে র্যাবের সাথে কথিত 'বন্দুকযুদ্ধে' মাদক চোরাকারবারি শাহীন ওরফে সিটি শাহীন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। যদিও পরবর্তীতে মামলায় র্যাব উল্লেখ করেছে, 'র্যাবের নয়, মাদক চোরাকারবারিদের কারও গুলিতে শাহীন মারা গেছেন।'
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শতাধিক ব্যক্তি চনপাড়ায় মাদক চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন অপরাধীদের আশ্রয়স্থল এই চনপাড়া। প্রতিমাসেই মাদক সংশ্লিষ্ট দুই-তিনটা মামলা হয়, কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়। কিন্তু মাদক চোরাকারবারিদের নেটওয়ার্ক এতটাই বিস্তৃত যে কাউকে ধরতে যাওয়ার আগেই তারা খবর পেয়ে যায়। আবার ভৌগলিক কারণে চনপাড়ায় 'ব্লকরেইড' দিয়ে অভিযান চালানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ বস্তির তিন দিকেই পানি।'
'বস্তির অলিগলি ও ঘরবাড়ি মিলিয়ে এতটাই ঘিঞ্জি এলাকা যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চালালে পালানোর সুযোগ অনেক। অনেক সময় মুহূর্তেই আসামি ছাড়ানোর জন্য ঘরবাড়ি থেকে শতাধিক নারী-পুরুষ বেরিয়ে আসে আমাদের ওপর হামলা চালায়। তারপরও নিয়মিত পুলিশের টহল থাকে চনপাড়ায়। চনপাড়ায় মাদক ও অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করছি আমরা।'
চনপাড়ার মাদকের বিস্তৃতি রোধ করতে জেলা পুলিশ প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছে বলে জানান জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল। তবে মাদক চোরাকারবারিদের ধরতে গেলে প্রায়সময় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয় বলে জানালেন জেলা পুলিশের শীর্ষ এই কর্মকর্তাও।
তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মূলত চনপাড়া একটি বস্তি এলাকা। ভেতরে অলিগলি ও বাড়িঘরগুলো খুবই ঘিঞ্জি। প্রায় সময় অভিযান চালানোর খবর টের পেয়ে তারা কোনো না কোনো ঘরে পালিয়ে থাকে কিংবা কোনো গলি দিয়ে বেরিয়ে পালিয়ে যায়। এমনও হয় বস্তির লোকজন এসে পুলিশকে ঘেরাও করে রাখে। আসামিকে নিতে দেয় না। প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান চালাই। আসামি গ্রেপ্তার হয়, জামিনে বেরিয়ে এসে আবারও মাদক চোরাকারবার শুরু করে।'
'তারপরও মাদক নির্মূলে জেলা পুলিশ, প্রশাসন সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাই। মাদক চোরাকারবারির সঙ্গে যুক্ত লোকজন এই পেশা পরিবর্তন না করলে পুলিশের একার তাগিদে সমূলে উৎপাটন সম্ভব না। তবে আমাদের কার্যক্রম সবসময় অব্যাহত আছে,' বলেন তিনি।
Comments