‘৮৭ শতাংশ শুশুক মারা পড়ে কারেন্ট জালে আটকে’

ছবি: সিলেটের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর সৌজন্যে

শান্ত স্বভাবের বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন স্তন্যপায়ী জলজ প্রাণী শুশুক। বাংলাদেশে এখন এটি বিপন্ন প্রাণী হিসেবে পরিচিত। আঞ্চলিক ভাষায় হুম মাছ নামে পরিচিত হলেও প্রাণীটি আসলে 'গাঙ্গেয় শুশুক, মিঠা পানির শুশুক বা ডলফিন'। কোনো নদীতে ডলফিন থাকা মানে নদীর স্বাস্থ্য বা পরিবেশ ভালো থাকা। 

তবে গবেষকদের মতে, শুশুক মারা পড়ার জন্য ৮৭ শতাংশ দায়ী কারেন্ট জাল।

এ বিষয়ে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেটের কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)-এর বরাত দিয়ে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত কয়েক বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, বছরে ৩০টির বেশি শুশুক মারা পড়ছে। আর শুশুকের মারা পড়ার জন্য ৮৭ শতাংশ দায়ী হলো কারেন্ট জাল।'

তিনি আরও বলেন, 'গোটা পৃথিবীতে শুশুকের সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার। এর মধ্যে এক সুন্দরবনেই আছে প্রায় ২২৫টি শুশুক। পদ্মা–যমুনায় আছে প্রায় ২০০টি। কর্ণফুলী, সাঙ্গু, রূপসা, সুরমা, হালদাসহ অন্যান্য নদীতে ৫০০–এর মতো ডলফিন দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশের নদীগুলোতে সব মিলিয়ে শুশুকের সংখ্যা হাজারখানেক, যা গোটা পৃথিবীর প্রায় এক–তৃতীয়াংশ।'

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ জানিয়েছে, বাংলাদেশে ৭ জাতের ডলফিনের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে মিঠাপানির নদীর ডলফিন মাত্র একটি। এর নাম গাঙ্গেয় শুশুক। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের লালতালিকায় প্রাণীটি এখন বিপন্ন। এরা বাচ্চা প্রসব করে এবং বাচ্চারা মায়ের দুধ পান করে বড় হয়। এরা মাছের ঝাঁকের পিছনে ছুটে বেড়ায় এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বল মাছ শিকার করে খায়। মিঠা পানির শুশুক বা ডলফিন আমাদের দেশে বিপন্নপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম মৌলভীবাজার জেলার সধারণ সম্পাদক নুরুল মোহাইমিন মিল্টন বলেন, 'শুশুক ছাড়াও পৃথিবীতে মিঠাপানির ডলফিন আছে ৪ প্রজাতির। এর মধ্যে চীনে নদীর ডলফিন গোটা দুনিয়া থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর নাম বাইজি। পাকিস্তানের সিন্ধু নদীতে আছে শুশুকের আরেক জাত ভাই। অন্য প্রজাতিটি দেখা যায় আমাজন নদীতে। সর্বশেষ প্রজাতিটি হলো ইরাবতী ডলফিন। এটি প্রকৃতপক্ষে মিঠাপানির ডলফিন নয়। উপকূলীয় লোনাপানির নদীতে এগুলোকে বেশি দেখা যায়। ইরাবতী ডলফিন পৃথিবীতে প্রায় ৭ হাজার টিকে আছে বলে ধারণা করা হয়, যার একটা বড় অংশ আছে বাংলাদেশের নদীতে। আর এদের বড় একটি অংশ কারেন্ট জালে ধরা পড়ে মারা পড়ছে।

বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্রে বিভিন্ন প্রজাতির ডলফিন রয়েছে। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ জানিয়েছে, গতবছরও জেলেরা কুশিয়ারা নদী থেকে শুশুক ধরে মাংস কেটে বিক্রি করে। এ ঘটনায় মামলাও হয়। 

বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মির্জা মেহেদী সরোয়ার বলেন, নদীতে শুশুকের মতো উপকারী প্রাণী আর একটিও নেই। একটি জলাশয়ে শুশুক থাকা মানে ওই জলাশয়ে পর্যাপ্ত মাছ আছে, পানির গুণাগুণ আর জলীয় অবস্থা ভালো। শুশুকের প্রধান খাবার মাছ। তাই অনেকে ভাবেন, শুশুক থাকলে নদীতে মাছের সংখ্যা কমে যায়। কিন্তু শুশুক থাকলে নদীতে তার উল্টো হয়। শুশুক এমন সব প্রজাতির মাছ খায়, যেগুলো অন্যান্য মাছের বংশবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর। একটি নদীতে বেশি শুশুক থাকা মানে ওই নদীতে বেশি মাছ রয়েছে।

শুশুক হলো আমাদের নদীর প্রধানতম স্তন্যপায়ী প্রাণী। একসময় বাংলাদেশের প্রায় সব মিঠাপানির নদীতেই শুশুক দেখা যেত। এখন এর সংখ্যা কমছে। সংখ্যায় বেশি দেখা যায় পদ্মা-যমুনা ও সুন্দরবনের নদীতে। সুন্দরবনের পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনায় শুশুক বসবাসের উপযোগী একটি পরিবেশ পেয়েছে। এ দেশের অন্যান্য নদীতে কারেন্ট জালের দৌরাত্ম্য এতই বেশি যে শুশুকের চলাচলে খুব সমস্যা হয়।

ডলফিন বাঁচাতে সরকার এরই মধ্যে ৯টি ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। এর ৬টি সুন্দরবনে, অন্য ৩টি পদ্মা–যমুনায়। ডলফিনের মতো একটি প্রাণী বাঁচাতে সরকারিভাবে এত অভয়ারণ্য ঘোষণা সত্যিই বিরল।

ভারতে মিঠাপানির জাতীয় প্রাণী হলো শুশুক। আমাদের দেশে নদীগুলোয় শুশুকের বিচরণ সবচেয়ে বেশি।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী-শুশুক বা ডলফিন শিকার বা হত্যা করা, পাচার কিংবা ক্রয়-বিক্রয় করা আইনত দণ্ডণীয় অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫ লাখ টাকা জরিমানা।

তিনি বলেন, বিশ্ব মিঠাপানির ডলফিন দিবসে শুশুককে মিঠাপানির জাতীয় জলজ প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করা হোক।

 

Comments

The Daily Star  | English

IMF sets new loan conditions

Bangladesh must clear dues, hit steep revenue, reserve targets for next tranche

7h ago