গাইবান্ধা-৫: পরিস্থিতি কেন ইসির ‌‌‌‘নিয়ন্ত্রণের’ বাইরে চলে গেলো

গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন এখন দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়। জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়ার মৃত্যুতে শূন্য হওয়া এই আসনে উপনির্বাচন হয় গত ১২ অক্টোবর। কিন্তু ভোটে অনিয়ম এবং নির্বাচন কমিশনের ভাষায়, 'পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে' চলে যাওয়ায় এখানে ভোট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এর আগে অনিয়মের অভিযোগে বিভিন্ন নির্বাচনে এক বা একাধিক কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত বা বন্ধ করা হলেও, পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার নজির সম্ভবত এটিই প্রথম।

সিইসি বলেছেন, ভোট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, কেন বাইরে চলে গেলো? দেশের ইতিহাসে এরকম ভোট কি এই প্রথম হয়েছে? এর আগে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো কি নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে ছিল? ইসি কি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে? যদি পারতো ,তাহলে কি দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বা তারও আগে হাতেগোনা কয়েকটি নির্বাচন ছাড়া সবগুলো নির্বাচন বিতর্কিত হতো?

সুতরাং কেন ভোট এবং পুরো নির্বাচনী সংস্কৃতি ও ব্যবস্থাটি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো, সেই প্রশ্নের উত্তর ইসিকেই খুঁজতে হবে। সংবিধান বলছে, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। আর জনগণের সেই মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় যে ভোটের মধ্য দিয়ে, সেই ভোট যখন বেহাত হয়ে যায়; নাগরিকরা যখন পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন না বা ভোট দেওয়ার প্রয়োজন হয় না— তখন রাষ্ট্রে তার মালিকানা থাকে না। সুতরাং ভোটের ওপর নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ না থাকার মানে হলো রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা নেই। অতএব কেন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাটি ইসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো, কার নিয়ন্ত্রণে গেলো, কীভাবে গেলো এবং এই নিয়ন্ত্রণ কীভাবে ফিরে পাওয়া যাবে, সেটি ইসিকেই ভাবতে হবে।

তবে গাইবান্ধার উপনির্বাচনের ভোট বন্ধের মধ্য দিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়া নির্বাচন কমিশন— যাদের অধীনে আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা, তারা নিজেদের নিরপেক্ষতা, সক্ষমতা ও সাহসের প্রমাণ দিয়েছেন বলে অনেকে মনে করছেন। বিশেষ করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অর্ধেক অর্থাৎ ১৫০ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ইসি যখন সমালোচনার মুখে, ঠিক সেই সময়ে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট বন্ধ করে দেওয়ার মতো সাহসী উদ্যোগ নিয়ে তারা মাঠের রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ ইভিএমের বিরোধিতাকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছে বলেও মনে করা হচ্ছে।

কারো কারো মতে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেও নির্বাচন কমিশন চাইলেই যে নিরপেক্ষ থাকতে পারে এবং চাইলে তারা ভোটও বন্ধ করে দিতে পারে, গাইবান্ধায় সেটির প্রমাণ দিয়েছে ইসি। অর্থাৎ নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী অন্যান্য যেসব দল অনড়, তাদেরকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহ দিতে নির্বাচন কমিশন গাইবান্ধায় ভোট বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না—সেটিও আলোচনায় আছে। উল্লেখ্য, গাইবান্ধায় ভোটগ্রহণ বন্ধের পরদিনই তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'এই উপনির্বাচনে ভোট বন্ধের ঘটনায় প্রমাণ হয়েছে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন নেই।'

আগামী জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করা তথা আগের দুটি নির্বাচনের মতো যাতে না হয়, সে ব্যাপারে সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে। গাইবান্ধায় ভোট বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাটি সেই চাপ সামলানোর একটি উদ্যোগ কি না— তাও ভাবা যেতে পারে।

তবে এই সবকিছু ছাপিয়ে যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, একটি আসনে উপনির্বাচনই যেখানে ইসির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো বা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না, সেখানে একই দিনে একসঙ্গে ৩০০ আসনের নির্বাচন তারা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে?

গাইবান্ধার উপনির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ১৪৫টি কেন্দ্রে ৯৫২টি বুথে প্রায় ১ হাজার ২৫০টি সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল, যেগুলো রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে বসেই মনিটর করেন সিইসি, অন্যান্য কমিশনার ও কমিশনের কর্মকর্তারা।

ধরা যাক, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রতিটি কেন্দ্রে ও বুথে সিসি ক্যামেরা থাকবে। প্রশ্ন হলো, একটি আসনের ১ হাজার ২৫০টি সিসি ক্যামেরার প্রতি পুরো কমিশন যেভাবে নজর রেখেছে এবং সেখানের প্রতিটি ঘটনা তারা শত মাইল দূরে বসেও যেভাবে দেখে, পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছেন, একই দিনে একসঙ্গে ৩০০ আসনের ভোটে যদি কয়েক লাখ সিসি ক্যামেরা থাকে, তারা সেগুলো কীভাবে দেখবেন এবং কতগুলো কেন্দ্রে অনিয়ম হলো বা তাদের ভাষায় কতগুলো বুথে 'ডাকাত' ঢুকলো, সেটি তারা কীভাবে নজরদারি করবেন? তাদের বিদ্যমান জনবল যদি আরও কয়েক গুণ বাড়ানোও হয়, তারপরেও কি এটা সম্ভব?

প্রশ্ন উঠেছে ইভিএম নিয়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং নির্বাচন কমিশনের তরফে ইভিএমকে ত্রুটিহীন মেশিন বলে দাবি করা হলেও বিএনপিসহ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বিরাট অংশই এই মেশিনকে বিশ্বাস করছে না। তার প্রধান কারণ এখন পর্যন্ত ইভিএমে ভোট দিয়ে ভোটাররা অভ্যস্ত নন। যে কারণে অনেক সময়ই দেখা যায়, বুথের ভেতরে ভোটদানে সহায়তার নামে অন্য আরেকজন ঢুকে পড়েন, যিনি ভোটারের ওপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পান।

গাইবান্ধায় যে কারণে ভোট বন্ধ করা হলো, তার পেছনেও প্রধান কারণ বুথের ভেতরে এই অন্য আরেকজনের প্রবেশ। ভোটের দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, 'আমরা দেখতে পাচ্ছি, আপনারাও দেখতে পাচ্ছেন। গোপন কক্ষে অন্যরা ঢুকছে, ভোট সুশৃঙ্খলভাবে হচ্ছে না।' তবে 'ইভিএমের কোনো দোষত্রুটি দেখতে পাচ্ছি না' উল্লেখ করে সিইসি বলেন, 'মানবিক আচরণের ত্রুটির কারণে এমনটা হচ্ছে।' তার মানে এখানে সমস্যাটা মেশিনের না হলেও মেশিনের পেছনে যারা থাকেন বা মেশিনটি পরিচালনার অজুহাত দিয়ে এখানে দুষ্টু লোকের প্রভাব বিস্তারের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। অতএব দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অর্ধেক আসনে যদি এই ‌'ডাকাতরা' প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পান এবং ইসির কাছে যদি তার প্রমাণ আসে, তারা কি সবগুলো আসনে ভোট বন্ধ করে দেবেন? যদি তাই হয়, তাহলে হাজারো কোটি টাকা খরচ করে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম কেনার যৌক্তিকতা কি প্রশ্নের মুখে পড়বে না?

এই নির্বাচনটি বন্ধ ঘোষণার পরদিনই ইসির তরফে নাগরিকদের মোবাইল ফোনে একটি এসএমএস পাঠানো হয়, যেখানে লেখা ছিল, 'ইভিএমে আঙুলের ছাপ যাচাই হয় বিধায় একজনের পক্ষে আরেকজনের ভোট বা একাধিক ভোট প্রদান অসম্ভব।' এটা ঠিক যে একজনের ভোট আরেকজন দিতে পারবে না। কিন্তু বুথের ভেতরে ভোট দিতে সহায়তার নামে আরেকজন যে ঢুকতে পারবেন না এবং এটি ঠেকানোর কোনো নিশ্চয়তা ইভিএম দেবে কি না, সে কথা এই এসএমএসে উল্লেখ নেই।

বস্তুত নির্বাচন কেমন হবে, সেটি পুরোপুরি নির্ভর করে মাঠ প্রশাসনের সততা, নিরপেক্ষতা, দক্ষতা এবং সর্বোপরি তারা নির্বাচন কমিশনের আদেশ-নিষেধ ও নির্দেশ কতটা মানছেন, তার উপর। কিন্তু মাঠ প্রশাসনের ওপর ইসির নিয়ন্ত্রণের যে কী হাল, সেটি টের পাওয়া গেছে গাইবান্ধায় ভোটের ৪ দিন আগে গত ৮ অক্টোবরেই।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এদিন সারা দেশের ডিসি-এসপিদের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। মূলত ভোটে নিরপেক্ষ আচরণের বার্তা দিতে মাঠ প্রশাসনকে ঢাকায় ডেকেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল তার বক্তব্যে বেশ কিছু নির্দেশনাও দিয়েছেন। কিন্তু শেষমেশ এই উদ্যোগটি যে সফল হয়নি বরং কমিশনের সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের যে দূরত্ব, সেটিই প্রকাশ্য হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে।

বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান, যিনি নিজেও একজন সাবেক আমলা, নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে সৃষ্ট আস্থাহীনতার জন্য ডিসি-এসপিদেরকে দায়ী করলে তিনি সম্মিলিত প্রতিবাদের মুখে পড়েন। এক পর্যায়ে কমিশনার আনিছ বলেন, তাহলে কি আপনারা আমার বক্তব্য শুনতে চান না? তখন সবাই একযোগে 'না' বলে উঠলে নিজের বক্তব্য শেষ না করেই তিনি বসে পড়েন। যে মাঠ প্রশাসনের কর্তারা খোদ নির্বাচন কমিশনে বসে একজন নির্বাচন কমিশনারকে কথা শেষ না করে তার আসনে বসে পড়তে বাধ্য করেন, তাদের নিয়ে ইসি কীভাবে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে? তার মানে বিদ্যমান সাংবিধানিক পদ্ধতি ও রাষ্ট্রকাঠামোয় থেকে যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয় বা কঠিন, গাইবান্ধা কি নতুন করে সেই বার্তাটিই দিলো?

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Govt mulling incorporating ‘three zero’ theory into SDG

The government is considering incorporating the "three zero" theory of Chief Adviser Professor Muhammad Yunus into Sustainable Development Goals (SDGs)

1h ago