গ্রাফিক ডিজাইন-ইমেজ এডিটিং: বাড়ছে কর্মসংস্থান, আসছে বৈদেশিক মুদ্রা

গ্রাফিক ডিজাইনিং ও ইমেজ এডিটিংয়ের আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে অনেক বাংলাদেশি। এতে করে বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশও।

ভারত, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের জন্য আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছে। এখন বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের কাছে সুপরিচিত। কারণ, স্বল্পমূল্য ও বৃহৎ আকারের কাজ করতে বাংলাদেশিরা সক্ষম।

সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের গ্রাফিক ডিজাইনিং ও ইমেজ এডিটিং খাতে ১০০টিরও বেশি ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন ৭ হাজার জন। আরও ৫০ হাজার জন কাজ করছেন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে।

ই-কমার্স, ক্যাটালগ, ব্রোশিওর, ম্যাগাজিন, প্রিন্টিং, সংবাদপত্র, সাইনবোর্ড ও ব্যবসায়িক কার্ডগুলোর জন্য ডিজিটাল ডিজাইনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা স্থানীয় ফ্রিল্যান্সার ও সংস্থাগুলোর জন্য বিপুল পরিমাণ সুযোগ তৈরি করছে।

গ্রাফিক পিপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাজিম ফারহান চৌধুরী বলেন, 'বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ায় গ্রাফিক ডিজাইন ও ইমেজ এডিটিংয়ের অর্ডার বেশি পাওয়া যাচ্ছে।'

ঢাকায় অবস্থিত স্টুডিও গ্রাফিক পিপল বিভিন্ন বিদেশি বিজ্ঞাপন সংস্থা ও ব্র্যান্ডগুলোকে ডিজিটাল প্রিন্ট ও উৎপাদন সহায়তা পরিষেবা সরবরাহ করে থাকে। ডেল ও মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠানকে তারা এ ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ২৫০ জন কর্মী কাজ করেন।

ই-কমার্স ও ডিজিটাল ব্যবসা সমৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছবি ও ভিডিওর প্রয়োজনীয়তাও বেড়েছে। বড় বড় স্টুডিওগুলো বিশ্ব বাজারে বেশ নাম করছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্রাফিক ডিজাইন ও ইমেজ প্রসেসিংয়ের এই খাতে চাকরি পাওয়ার জন্য মৌলিক দক্ষতার প্রয়োজন। ফলে এই খাতটি বেশ সম্ভাবনাময়।

'আমরা এখন যা করছি, তা হলো আমরা ব্যাকএন্ড এডিটিং ও সংশোধনের কাজ। তবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিও পোশাক শিল্পের মতো বড় হতে পারে', বলেন নাজিম ফারহান চৌধুরী।

তিনি আরও বলেন, গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ৫২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ পোশাক খাত থেকে এসেছে। কিন্তু, গ্রাফিক ডিজাইনিং ও ইমেজ এডিটিং সেগমেন্টে যারা কাজ করেন, তাদের বেতন পোশাক শিল্পে যারা কাজ করেন, তাদের তুলনায় অনেক বেশি।

'পোশাক খাতে ভ্যালু-এডিশন প্রায় ২০ শতাংশ, যেখানে গ্রাফিক ডিজাইনিং ও ইমেজ এডিটিং সেগমেন্টে এটি ১০০ শতাংশের কাছাকাছি।'

গ্রাফিক ডিজাইনিং ও ইমেজ এডিটিংয়ের আউটসোর্সিং ব্যবসা বৃহত্তর আইটি পরিষেবা শিল্পের অংশ।

গত অর্থবছরে বাংলাদেশ আইটি সেবা থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারেরও কম আয় করেছে বলে এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর তথ্যে দেখা গেছে।

সফটওয়্যার ও আইটি পরিষেবাগুলোর জন্য জাতীয় বাণিজ্যিক সংস্থা বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) তথ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যাটি ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। কারণ বিদেশি আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আনা হয় কিংবা একেবারেই আনা হয় না।

ভারতীয় সংস্থা স্কাইকুয়েস্ট টেকনোলজি কনসাল্টিং প্রাইভেট লিমিটেডের তথ্যের বরাত দিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক নিউজওয়্যার বিতরণ নেটওয়ার্ক গ্লোবনিউজওয়্যার জানিয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বব্যাপী আউটসোর্সিং ব্যবসার বাজারের আকার ছিল ২৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৮ সালের মধ্যে তা ৪৯২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা হচ্ছে।

নাজিম ফারহান চৌধুরী বলেন, 'শিক্ষার্থীদের জন্য ঋণ ও সার্টিফিকেশনের ওপর জোর দিয়ে দক্ষতা-ভিত্তিক প্রশিক্ষণ, ৫০০ এরও বেশি কর্মী থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং আইটি পরিষেবাগুলোকে জরুরি পরিষেবা হিসেবে বিবেচনা করার মাধ্যমে এ শিল্পকে আরও উচ্চস্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে।'

এ খাতে মূলত ২ ধরনের মানুষ কাজ করে। প্রথমত, ফ্রিল্যান্সাররা আপওয়ার্ক ও ফাইভারের মতো মার্কেটপ্লেসগুলোর সঙ্গে কাজ করে। আর অন্যরা ছোট বা মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করে।

ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য আন্তর্জাতিক অনলাইন মার্কেটপ্লেস ফাইভারের শীর্ষ ইলাস্ট্রেটর কামরুজ্জামান শিশির বলেন, 'এ খাতে বিপুল পরিমাণ সম্ভাবনা রয়েছে।'

তবে, যেহেতু এ খাতে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি, তাই এ খাতের উপার্জন দক্ষতার ওপর নির্ভর করে।

কামরুজ্জামান শিশির বলেন, 'এ ধরনের কাজে সৃজনশীলতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ৬ মাসের প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর হয়তো কেউ কাজ নাও পেতে পারে। আবার একই প্রশিক্ষণ নিয়ে কেউ হয়তো অনেক কাজ পেতে পারে।'

ফ্রিল্যান্সারদের মতে, একজন দক্ষ গ্রাফিক ডিজাইনার ও ইমেজ এডিটর সহজেই মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করতে পারেন। তবে, যাদের দক্ষতা কম, তাদের জন্য মাসে ১৫ হাজার টাকা আয় করাও কষ্টসাধ্য।

ছবি ও ছবি এডিটিংকে কেন্দ্র করে কনটেন্ট পোস্ট-প্রোডাকশন ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান দ্য কাও কোম্পানি ৩ সদস্য নিয়ে ২০১৪ সালে রাজধানীর বাংলামোটরে এক রুমের একটি অফিস নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এখন তাদের কর্মী সংখ্যা ৫০০ এবং প্রতিদিন তারা বিশ্বব্যাপী ২৫টি স্টুডিওর সঙ্গে কাজ করছে ও প্রায় ২৫ হাজার ছবি এডিট করছে।

দ্য কাও কোম্পানির সিইও ও প্রতিষ্ঠাতা কাওসার আহমেদ নীরবের মতে, ছবি এডিটিং, কম্পিউটার-জেনারেটেড ছবি, ৩ডি ও কন্টেন্ট পোস্ট-প্রোডাকশন সেগমেন্টগুলোতে বিদেশি মুদ্রা আয়ের বৃহৎ সম্ভাবনা রয়েছে।

অনেক বাংলাদেশি ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যে যান। তাদের অনেককেই জমি-জমা বিক্রি করে এ অর্থ জোগাড় করেন। কিন্তু, সেই তুলনায় আয় কম।

কাওসার আহমেদ নীরব বলেন, 'যথাযথ প্রশিক্ষণ পেলে কয়েক মাসের মধ্যে তারা ঘরে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে। এ ছাড়াও, গ্রাফিক ডিজাইন ও এ সংশ্লিষ্ট কাজগুলোর জন্য প্রয়োজন মৌলিক দক্ষতা।'

উদ্যোক্তাদের মতে, একজন দক্ষ সফটওয়্যার ডেভেলপার হতে ২ বছরেরও বেশি সময় লাগে।

কিন্তু, ইমেজ প্রসেসিংয়ের জন্য ৬ মাসের প্রশিক্ষণের পরেই একজন দক্ষ কর্মী পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনট্যাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের সভাপতি ওয়াহিদ শরীফ বলেন, 'বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স ও ডিজিটাল চাহিদা যেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে, তেমনি ইমেজ প্রসেসিং ও সংশ্লিষ্ট খাতে চাহিদাও দ্রুত বাড়ছে। এটি আউটসোর্সিংয়ের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম।'

বেসিসের সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, 'গ্রাফিক ডিজাইনিং ও ইমেজ এডিটিংয়ের জগতে বিকাশের জন্য সৃজনশীলতা ও মৌলিক দক্ষতা প্রয়োজন। গ্রাফিক ডিজাইন বা ইমেজ এডিটিং কাজের জন্য কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রির প্রয়োজন নেই। মানবিক ও ব্যবসায় নিয়ে যারা পড়াশোনা করেছেন, তারাও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ কাজ করতে পারে।'

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যথাযথ ব্র্যান্ডিং নেই বলে মনে করেন রাসেল টি আহমেদ। তিনি বলেন, 'ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমরা যদি ভালোভাবে ব্র্যান্ডিং করতে পারি, তাহলে আমাদের কোম্পানিগুলো বিশ্ববাজারে আরও ভালোভাবে কাজ করতে পারবে।'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

5h ago