ঢাকার মঞ্চে বেদের মেয়ে ‘চম্পাবতী’

শব্দনাট্য চর্চা কেন্দ্রের পরিবেশনা 'বেদের মেয়ে’ নাটকের একটি দৃশ্য । ছবি: সংগৃহীত

যুগের পর যুগ ধরে বেহুলারা নিজের জীবন বাজি রেখে স্বামীর জীবন রক্ষা করে। সেরকমই একটি গল্প 'চম্পাবতী'। কবি জসীম উদ্‌দীনের 'বেদের মেয়ে' অবলম্বনে কাব্যনাটকটি লিখেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। ঢাকার মঞ্চে নতুন করে উপস্থাপন করছে শব্দনাট্য চর্চা কেন্দ্র। সম্প্রতি জাতীয় শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে নাটকটির ৩২তম মঞ্চায়ন হয়। নাটকটির আলোকসজ্জায় ছিলেন ঠাণ্ডু রায়হান, পোশাকে আইরিন পারভীন লোপা, সংগীতে শিশির রহমান। নির্দেশনা দিয়েছেন খোরশেদুল আলম।

জসীম উদ্‌দীনের লেখা মূল নাটকের সঙ্গে এই নাটকের কিছু পার্থক্য দেখা যায়। নামকরণের মাধ্যমে গল্পের নামকরণের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া গেলেও আগের চেয়ে নাটকটির ক্যানভাস যে আরও ছোট হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একথা বলতেই হয় চম্পাবতী নামকরণের মাধ্যমে চরিত্রটি আরও উজ্জ্বল হয়েছে। আর উজ্জ্বলকরণ যে নারীবাদের জায়গা থেকে হয়েছে তাও কিছুটা অনুমান করা যায় নাটকের দ্বিতীয় অংকের শুরুতে এবং শেষে। অংকের শুরুতে যেখানে মোড়ল স্ত্রীকে ধরে রাখতে ধর্মের দোহাই দেয় এবং শেষে চম্পার প্রতি অত্যাচারে মোড়লের স্ত্রী মোড়লের মুখের উপর প্রতিবাদ জানায়। যা জসীম উদ্‌দীনের মূল লেখায় এত স্পষ্টভাবে ছিল না। এখানে নাট্যকার সৈয়দ হককে আমরা যেনো অগ্রজ নারীবাদী হিসেবে আবিষ্কার করি। যেমনটা আমরা তাকে আবিষ্কার করেছিলাম ঈর্ষাতে।

তবে তার স্বরচিত কাব্যনাটক 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়', 'নূরলদীনের সারাজীবন' কিংবা 'ঈর্ষা'-তে আমরা তার কাব্যনাট্যের যে স্বাদ পাই এই নাটকটি যেনো সেই রস থেকে অনেক দূরে। নারীবাদের দিকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে মুখ্য চরিত্র এবং খল চরিত্রের প্রতি অতিরিক্ত কেন্দ্রিক হয়েছেন লেখক। দুটো চরিত্রের পেছনে চরকির মতো বারবার ঘুরেছেন যে ছাঁচটা অনুসরণ করে পশ্চিমা লেখকরা। জসীম উদ্‌দীন কি ওই ছাঁচের লেখক ছিলেন? না, বোধ হয়। তিনি চরিত্রের চেয়েও বিষয়কে প্রাধান্য দিতেন। বিষয়ের প্রয়োজনে চরিত্রগুলো আসত। চম্পাবতী দেখে মনে হবে চরিত্রের প্রয়োজনে বিষয় এসেছে। যেমনটা আমরা দেখতে পাই বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না চলচ্চিত্রে। একটা প্রেমের গল্প বলার প্রয়োজনে বেদে জনগোষ্ঠীর জীবন ধারার কিয়দংশ এসেছিল ওই গল্পে। এখনও পর্যন্ত কোনো চলচ্চিত্রকার শুধুই বেদেদের জীবন দেখানোর জন্য একটা গল্প বলতে পারেননি। যেটা জসীম উদ্দীন করেছেন। কিন্তু চরিত্রকেন্দ্রিক গুরুত্ব এই কাব্য নাট্যায়নের প্রচেষ্টা হয়ত মূল উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করেছে। কথাটা বলার সাহস হচ্ছে এই কারণেই যে জসীম উদ্দীন চিরায়ত বাংলার একজন রূপকার। যে বাংলার রূপ দেখার চাইতে আমরা এই নবনাট্যায়নে চরিত্রগুলোর মনোজাগতিক অবস্থাই বেশি দেখছি।

সৈয়দ হক কাজটি করে গুরুপাপ করেছেন ব্যাপারটি এমন নয়। তাকে এই পাপের অনুমতি দিয়েছেন স্বয়ং কবি জসীম উদ্‌দীন। বেদের মেয়ের চতুর্থ সংস্করণে কবি বলেন,''যাহারা থিয়েটার রূপে এই নাটক অভিনয় করিবেন তাহারা ইচ্ছা করিলে ঐ নতুন গানগুলি বাদ দিতে পারেন। কোন গ্রাম্য যাত্রার দল যদি এই নাটক অভিনয় করেন, তাহারা ইচ্ছা করিলে পাত্র-পাত্রীদের মুখে প্রয়োজন অনুসারে আরও নতুন গান জুড়িয়া দিতে পারেন।

কেহ কেহ এই কাহিনীকে নৃত্য-নাট্যে রূপ দিতে চাহিয়াছেন। সেই জন্য ইহার বহুস্থানে নৃত্যের ইঙ্গিত দেওয়া হইয়াছে। (লোক নাট্যের বিষয় আমার প্রবন্ধ সমূহে (প্রথম খণ্ড) পুস্তকে বাংলায় এবং পাকিস্তান কোয়র্টারলীতে ইংরেজিতে বিস্তৃত প্রবন্ধ লিখিয়াছি। কৌতূহলী পাঠক তাহা পাঠ করিতে পারেন।''

বোঝা যাচ্ছে যে নাটকটিতে বহু ক্ষেত্রে স্বয়ং কবি নিজেই স্বাধীনতা দিচ্ছেন। সেখানে দল হিসেবে শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র সৈয়দ হক থেকে কতটুকু স্বাধীনতা আদায় করে নিতে পেরেছেন আমরা এখন তা দেখব।

অসংখ্য সংলাপ আছে যা অভিনেতা অভিনেত্রীরা পরিবর্তন করেছেন, বাদও দিয়েছেন। যদি পরিচালক ম্যানুস্ক্রিপ্ট থেকে সংলাপ বাদ দেওয়ার মতো সাহসী ভূমিকা নিতে পারেন তাহলে প্লট পরিবর্তন করছেন না কেনো? মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়কার গ্রামীণ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় প্রধান ছিলেন মোড়ল। এখন সেই প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেই। কিন্তু প্রধান খলচরিত্রটি মোড়ল হিসেবেই পরিচিত হয়েছেন যা পরিচালক চেষ্টা করলে পরিবর্তন করতে পারতেন। প্লট পরিবর্তন না করার কারণে ঢাকার মঞ্চে এরকম অসংখ্য নাটকে দর্শক সংযোগ করতে পারেন না। মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য নাটক ঢাকার মঞ্চে মঞ্চায়িত হয়, যা আশি বা নব্বইয়ের দশকের ন্যারিটিভে ঠিক আছে। কিন্তু সেই সময়ের লেখা নাটক এখনও যদি হুবহু মঞ্চস্থ হয় এই সময়ের দর্শক কিভাবে তার স্পিরিট খুঁজে পাবেন? ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের অনেক তরুণই এসব নাটক দেখে বিরক্ত।

বর্তমানে গ্রামের যে অবস্থা, বেদে জনগোষ্ঠীর যে পরিবর্তন হয়েছে সে পরিবর্তন অনুযায়ী নাটকের ম্যানুস্ক্রিপ্টে কোনো প্রকার সম্পাদনা করবেন কিনা পরিচালক ভেবে দেখতে পারেন। যদি কাব্যনাটক সম্পাদনার ক্ষেত্রে অসুবিধা হয় সেক্ষেত্রে পরিচালক কবির মূল বেদের মেয়েকেই সম্পাদনা করতে পারেন। তবে যারা ইতোপূর্বে সৈয়দ হকের বইপুস্তক সম্পাদনা করেছেন পরিচালক তাদের সাহায্য নিয়েও কাজটা করতে পারেন। এর জন্য দুটি পথই খোলা।

তৃতীয় অংকের শুরুতে গয়া বেদের মৃত্যুতে চম্পার প্রত্যাবর্তনে দর্শক সারি থেকে একজন দর্শক হাসতে হাসতে বললেন, চম্পা এসে গেছে, গয়া বাইদ্যা উইঠা দাঁড়াও। এরকম একটা সিরিয়াস মূহুর্তে দর্শক কিভাবে হাসেন? দর্শক কি বেয়াদব ছিল? দর্শকের দোষ দিয়ে বোধ হয় লাভ নেই। কারণ দৃশ্যটা সিরিয়াস হলেও হয়ত অভিনয়গুলো অভিনয়ই ছিল, সিরিয়াস ছিল না। দর্শকসারির একইরকম হাসির দৃশ্য দেখা যায় চম্পার মৃত্যুতে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে না, চম্পা কি আসলেই মরেছে?

'মজা না পেলে দর্শক নাটক দেখবে কেনো?' 'একটু ভাঁড়ামো না থাকলে দর্শককে সিটে রাখব কিভাবে?' নানান প্রতিউত্তর দেয়া যায় এই দুর্বলতার। বাংলার দর্শকদের আচরণ বুঝে কবিই শুরুটা করেছেন হাস্যরস দিয়ে। নাটকের প্রথম অংকের উদ্দীপক ঘটনায় মাইনক্যা চরিত্রটি সেরকম হাস্যরস করতে সক্ষম হয়েছেন। একটি ট্র্যাজেডিক নাটকে এতটুকু হাস্যরস কি যথেষ্ট নয়? যদি শেষ অব্দিও দর্শকের মুখে হাসি থাকে তবে বুঝতে হবে নাটকের রসবোধের পরিবর্তন ঘটেছে। এত বিশাল পরিবর্তনের দায়ভার কে নেবেন? দর্শক? নাকি শিল্পী ও কলাকুশলীগণ?

নাটকের শো শেষে সংগীত পরিচালকের বক্তব্য থেকে জানা যায়, তিনজন ব্যাতীত এই শো'র সবাই নতুন। এই হতাশার চিত্র আসলে সব দলেরই। তবু যে তিনজন পুরনো ছিলেন, তাদের খুব একটা মুনশিয়ানা আমরা দেখিনি। বিশেষত চম্পা চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তার গলা তো মনে হচ্ছিল বরফে জমে গেছে। কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে শো'র আগেও অভিনয়শিল্পী পূর্ণ শক্তি দিয়ে রিহার্সাল করেছেন। ফলে তার কণ্ঠস্বর অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। অভিনয়শিল্পীকে যদি শোর আগে বিশ্রাম না দেয়া হয়, পার্সোনাল স্পেস না দেয়া হয় তাহলে এমনটা ঘটে অনেক সময়। শো'র কতক্ষণ আগে রিহার্সাল বন্ধ করলে তাঁর কণ্ঠস্বর ঠিক থাকবে তা অভিনয়শিল্পী নিশ্চয়ই ভালো বলতে পারবেন।

বৈষ্ণবী চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তার বয়সের স্বল্পতা চোখে পড়ার মতো হলেও অভিনয়ের যে মুনশিয়ানা তিনি দেখিয়েছেন তাতে মনে হল চর্চা করলে তিনি চরিত্রটিকে আরও শক্তিশালী জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন।

প্রপসের উপস্থিতি সন্তোষজনক হলেও এই নাটকের কস্টিউম বিভাগটি সবচেয়ে অবহেলিত। পুরুষদের কস্টিউমে যতটুকু যত্ন নিয়েছেন পরিচালক নারীদের কস্টিউমে তার সিকিভাগও যত্ম নিয়েছেন কিনা সন্দেহ আছে।

বৈষ্ণবীর কস্টিউম ছাড়া অন্য নারীশিল্পীদের কস্টিউম ছিল রীতিমত প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা জানি বেদেদের স্বকীয়তা তাদের পোশাকে, অলংকারে। বেদে নারীরা এক রঙা শাড়ি পরে। সেই ধরণের শাড়ি কোনো নারীর পরনেই দেখতে পাইনি আমরা। বেদেনীরা মাথার উপরের অংশে গোল করে খোঁপা বাঁধে। গয়া বাইদ্যার দ্বিতীয় স্ত্রী চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তিনি ছাড়া কারো মাথায় এই খোঁপা দেখা যায়নি। বেদেদের মাথায় যেধরণের ফুল থাকে সেটাও তার মাথায় ছিল। চম্পাবতী চরিত্রটির চুল খোলা রাখাটা প্রশ্নবিদ্ধ। বেদেদের চুল নিয়ে যথেষ্ট রিচ্যুয়াল আছে। যেমন কোনো পুরুষ অবিবাহিত বেদেনীর খোঁপা খুলে দিলে সে নারীটি তার হয়ে যেত। সেই প্রথা থেকেই তারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম শক্ত করে খোঁপা বাঁধে। দুয়েকজন বেদেনী হয়ত চুল খোলা রাখতে পারে। কিন্তু যখন আমরা একটি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিকে তুলে আনব তখন নিশ্চয়ই তার নৃতাত্ত্বিক ভিত্তিটাও অনুসরণ করব। যে মোটা কোমরের বিছা আমরা দেখেছি, এটা বেদেরা পরে কিনা সন্দেহ আছে। সম্ভবত এটা রাজা কিংবা রাণীদের বিছা। বেদেদের বিছা আরেকটু চিকন হয়। বিহাইন্ড দ্যা সিনে হয়তবা গল্পও থাকতে পারে। হতে পারে এগুলো অন্য নাটকের কস্টিউম। কস্টিউমটা আবার নতুন করে বাজেট করবেন কিনা পরিচালক ভেবে দেখতে পারেন। মেকাপের ক্ষেত্রেও একই রকম পরামর্শ থাকবে। বেদে পাড়া থেকে অন্তত একজন বেদে নারীকে এনে মেকআপগুলো দেখালেও বিষয়টা অনেকটা সুরাহা হয়ে যেতো।

শব্দ প্রক্ষেপণে অভিনয় শিল্পী এবং সংগীত বিভাগের ভূমিকা প্রশংসনীয়। কিছু জায়গায় সংগীতের বদলে ফলি সাউন্ড দাবি করছে। যেমন: ঢেঁকির শব্দ,পানিতে নৌকা চলার শব্দ প্রভৃতি। সংগীতের আয়োজন প্রশংসনীয়। সংগীতে আরও ভালো করতে চাইলে বেদেদের বর্তমান সময়ের সংস্কৃতি ও সংকট নিয়ে একটা দুটো সংগীত লেখা যায় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। ইতোমধ্যে বেদেসংগীতের যথেষ্ট বাঁকবদল হয়েছে। বেদেদের সংগীত নিয়ে সুমন কুমার দাশের আলাদা বই আছে। বাংলাদেশের বেদে গবেষক রঞ্জনা বিশ্বাসের বইতেও পাওয়া যাবে দুয়েকটা সংগীত। খুব বেশি সংগীত পাওয়া না গেলেও এই প্রোডাকশানটি ডিজাইনের জন্য তাঁর বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছি। সেখানে আরও কিছু মন্ত্রও পাওয়া যাবে। চম্পার মৃত্যুপূর্ব দৃশ্যে যে দুয়েকটা মন্ত্রের দাবি রাখে তা এই বইতে পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।

গয়া বাইদ্যা সেটের বর্ণনায় একটা চিত্রল নৌকার প্রসঙ্গ আনে। অথচ নৌকাটি সেটে অনুপস্থিত। নৌকার আদলে তৈরি কিছু নাই সেখানে। অন্তত সেটে বিদ্যমান বেঞ্চটিকে পানির রঙে রূপ দেয়া যেত। আলোর প্রক্ষেপণটি প্রশংসার দাবি রাখে, সন্দেহ নাই। উদ্দীপক ঘটনায় একটা স্যানসেশনাল আলো দর্শককে যেমন রোমাঞ্চিত করেছে তেমনি চম্পাবতীর মৃত্যুর দৃশ্যে সম্পূর্ণ হলরুম যেনো বিষে নীল হয়ে উঠেছে।

অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা, কলাকুশলী-শিল্পীর অভাবসহ বহু রকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আমাদের যে নাটকের দলগুলো প্রদর্শনী করে যাচ্ছে তাদের মধ্যে শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র অন্যতম। এই আকালে একটা প্রদর্শনীর সবদিক যে ভালো হবে তা আশা করা অত্যুক্তি বলে মনে হয়।

Comments

The Daily Star  | English

At least 30 hurt as clashes engulf part of Old Dhaka

Suhrawardy college, hospital vandalised as protests over student’s death turn violent

1h ago