সৈয়দ শামসুল হকের নূরলদীনের সারাজীবন: বিবিধ ভাবনা

syed shamsul haq
সৈয়দ শামসুল হক। ফাইল ছবি

বাংলা সাহিত্যের সৃজনশীল ধারায় সৈয়দ শামসুল হক একজন অন্যতম লেখক। তার সহজাত কাব্য প্রতিভার শক্তিতে আমাদের কাব্যসাহিত্যে শুধু নয়; সাহিত্যের বিচিত্র শাখা হয়েছে সমৃদ্ধ।

কবিতা, নাটক, গান প্রভৃতি রচনার ক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিভার জ্যোতির্ময় প্রকাশ পাঠক ও সমালোচকের চোখ এড়ায় না। সব্যসাচী অভিধায় অভিষিক্ত এই লেখক কবি হিসেবে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করলেও আধুনিক কাব্যনাটক রচনায় যে নিপুণ দক্ষতা ও অভিনত্বের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন, তা ভূয়সী প্রশংসার দাবিদার। অবশ্য এই কাব্যনাটক সৈয়দ হকের পরিণত বয়সের সৃষ্টি। তবে নাটকের প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল মজ্জাগত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকলীন নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর অনুপ্রেরণা তাঁকে পরবর্তী জীবনে নাটক রচনায় প্রয়াসী করেছে। লোকায়ত জীবনের মর্মমূলে লুকিয়ে থাকা গ্রামীণ গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা, হতাশা-যন্ত্রণা এবং তাদের বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াইয়ের মধ্যে যে সংগ্রামী চেতনার বীজ লুকিয়ে রয়েছে; তার প্রতি সুগভীর মুগ্ধতা থেকে, তাঁদের জীবনের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে, মানবতার উদ্বোধনী জয়গানে তিনি মুখর হয়েছেন।

লক্ষণীয়, লোকায়ত জীবনের প্রবাহকে আমাদের বাংলা সাহিত্যে আধুনিক আঙ্গিকে শৈল্পিকভাবে রূপায়ণের জন্য তিনি পাশ্চাত্যের আধুনিক কাব্যনাট্য আন্দোলনের পুরোধা টি. এস. এলিয়টের কাব্যভাবনার দ্বারস্থ হয়েছেন। নাটকের আঙ্গিক যাই হোক, কাব্যনাট্যের বিষয় ও বক্তব্যের স্ফূরণ ঘটাতে তিনি স্বদেশ ও তার ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে বিচ্যূত হননি। স্বদেশ ও সমকাল সচেতন কবি স্বদেশ ও তার মাটি মানুষের প্রতি থেকেছেন দায়বদ্ধ।

লেখকের জবানিতেও আমরা তার পরিচয় পাই: 'ভাষা মাধ্যমে নাটক আমার সব শেষের সংসার; অথচ, এখন পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই, নাটকের জন্যে আমি তৈরী হয়ে উঠছিলাম সেই ছোটবেলায় বালকের বিস্ময় নিয়ে লেখা ভোরের শেফালী ফুল আর দেয়ালে ঝোলানো বিবর্ণ তাজমহল বিষয়ে দু'টি পদ্য রচনার বহু আগে। ...তৈরী হচ্ছিলাম নাটকের জন্যে...শীত মৌসুমে বাবার সঙ্গে রাতজেগে ভ্রাম্যমাণ যাত্রাদলের পালা দেখে; প্রতি শীতে বরিশালের যাত্রাদল আসতো আমাদের ছোট্ট শহরে, বাবা ছিলেন যাত্রাপাগল মানুষ।'

'নূরলদীনের সারাজীবন' সৈয়দ শামসুল হক রচিত দ্বিতীয় কাব্যনাটক। 'পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়' তাঁর আঞ্চলিক ভাষা ও সংলাপে নির্মিত প্রথম কাব্যনাটক। তবে সমালোচক মহল তাঁর প্রথম নাটকে আঞ্চলিক ভাষা ও সংলাপের প্রয়োগ কৌশল ও তাঁর শক্তিমত্তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলে, তিনি দ্বিতীয় নাটক রচনার পূর্বে 'পরানের গহীন ভিতর' (১৯৭৯) কাব্য রচনা করেন।

এটি একটি নিরীক্ষাধর্মী রচনা, যা আঞ্চলিক ভাষার উপযোগিতা ও শক্তি পরীক্ষার প্রচেষ্টা। সফলও হলেন তিনি পরবর্তী পর্যায়ে 'নূরলদীনের সারাজীবন' কাব্যনাটক রচনার মাধ্যমে তিনি সফলতার সুউচ্চ শিখরে পদার্পণ করেন। এ কথা আমাদের সাহিত্যের পাঠক মাত্রেরই জানা যে, আধুনিক কাব্যনাট্য রচনায় টি.এস. এলিয়ট পথিকৃতের দাবিদার।

আমাদের বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক টি.এস.এলিয়ট দ্বারা ভীষণ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাঁর ভাষায় 'টি.এস. এলিয়টের কাব্যনাট্য ভাবনা আমাকে ক্রয় করেছিল'।

সৈয়দ হকের কাব্যনাটকে পাশ্চাত্য প্রভাব ছাপিয়ে নিজস্ব মেজাজ-ভঙ্গিও পরিলক্ষিত হয়। সুদূর অতীতের কোনো ঐতিহাসিক ঘটনাকে উপজীব্য করে যখন তিনি নাটক রচনা করেন, তখন তাঁর লেখনীতে অবলীলায় রূপায়িত হয় সমকালীন জীবন, সমাজ ও বাঙালির লোকায়ত সংস্কৃতি তথা স্বদেশের সার্বিক একটি পরিমণ্ডল। 'নূরলদীনের সারাজীবন' নাটকের কাহিনী, ঘটনা এবং পটভূমি লেখকের সমসাময়িক কোনো বিষয় নয়। এই কাব্যনাটকের বিষয় ঐতিহাসিক। ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৭৮৩ সালে জানুয়ারি মাসে জমিদার-জোতদার এবং কোম্পানির কুঠিয়ালদের অত্যাচার, অবর্ণনীয় শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে রংপুরের উত্তরাঞ্চলে যে প্রকাশ্য বিদ্রোহ শুরু হয়। সৈয়দ হক মূলত সেই কৃষক বিদ্রোহের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গণমানুষের মুক্তির যে সংগ্রামী চেতনার জাগরণমূলক আত্মপ্রত্যয় ও লক্ষণ দেখতে পান; তা-ই তাঁর এই কাব্যনাটকের মূলসুর। বলে রাখা ভালো, কাব্যনাটক প্রথাগত নাটকের নিয়মে রচিত হলেও প্রথাগত নাটক থেকে কাব্যনাটকের পার্থক্য মাত্রাগত ও তাৎপর্যগত। তবে কবিতায় লেখা নাটকই কাব্যনাটক নয়। টি.এস.এলিয়ট প্রদর্শিত কাব্যনাটকের ভাবনা মূলত জীবনবোধের গভীরে লুকায়িত। কাব্যনাটকে কহিনী প্রধান বিষয় নয়; বরং মানবচরিত্রের অন্তর্লোকের চৈতন্য অবলোকন, চরিত্র-রহস্য উন্মোচন এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য উদঘাটনই কাব্যনাট্যের মূল উদ্দেশ্য। মানুষের সূক্ষ্মবোধ-ভাবনার উপলব্ধি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমকালচেতনা, সমাজ-বাস্তবতাবোধের বিচিত্র প্রকাশ, আধুনিক মানুষের জটিল জীবনচিত্র, যান্ত্রিক যুগচেতনার পীড়নে ক্লীষ্ট মানবচৈতন্যের শৈল্পিক রূপায়ন কাব্যনাটকের বিষয় হতে পারে। কারণ, কাব্যনাটকের উদ্দেশ্যেই হচ্ছে দর্শককে সচেতন-সংবেদনশীল করা, আত্মোপলব্ধি, যুক্তি, বুদ্ধির উদ্বোধন ঘটানো। এক্ষেত্রে কাহিনীকে প্রাধান্য দিলে কাব্যনাটকের বৈশিষ্ট্য খর্ব হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বাংলা সাহিত্যে কাব্যনাটকের ধারায় সৈয়দ শামসুল হক সফল একজন কাব্যনাট্যকার, কারণ কাব্যনাটকের উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সমকালীন আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক সমস্যা যুক্ত করে, কবিতার কাঠামোতে ব্যক্ত করে তিনি যে সফলতা দেখিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে দূরূহতম কাজ। ইতিহাসের পটভূমিতে সমাজ, স্বদেশ, সমকাল ছায়া ফেলে যায়।

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে প্রথমে ব্যবসার উদ্দেশ্যে এলেও ধীরে ধীরে এদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক দুর্বলতা ও অসংহতিকে পুঁজি করে উপনিবেশ স্থাপনের মধ্যদিয়ে রাজক্ষমতার অংশীদার হয়ে যায় অতি সুকৌশলে।

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয়ের পর মূলত বিদেশি বেনিয়া ও তাদের মদদপুষ্ট শাসক মীর জাফর আলী খাঁরা মসনদে জেঁকে বসে, যা আধুনিককালের নয়া উপনিবেশবাদের ফলে সৃষ্ট দখলকৃত দেশেরই লোকজন দ্বারা গঠিত এক ধরনের পুতুল সরকার।

অবস্থা আরও শোচনীয় হতে থাকে যখন লর্ড ক্লাইভরা অতি সুকৌশলে 'দ্বৈত-শাসন' ব্যবস্থার সূত্রপাত করেন। ১৭৬৫ সাল 'দ্বৈত শাসন' ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে, প্রতি বছর নবাবকে ২৬ লাখ টাকা দেওয়া এবং খাজনা বা কর আদায়ের ভার কোম্পানির হাতে নিয়ে নেওয়ার পর বাংলার মানুষের ওপর অত্যাচার ও শোষণের মাত্রা চতুর্গুণ বেড়ে যায়। কৃষক-প্রজাদের ওপর খাজনা কয়েকগুণ বেড়ে গেলে, তারা অসহায় ও নিঃস্ব হতে শুরু করে। খাজনা পরিশোধ না করতে পারলে চলে নির্মম নির্যাতন।

অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, মাত্র ৫ বছরের ব্যবধানে, ১৭৭০ সালেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল বাংলার বুকে। তবু নির্যাতন, জুলুম বন্ধ হয়নি। বরং শোষণের মাত্রা আরো তীব্রতর হতে থাকে। প্রজারা, বিশেষ করে কৃষকেরা বিদ্রোহী হতে শুরু করে। এসময় বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়। ঐতিহাসিকভাবে এ তথ্যের সত্যতা মেলে।

হান্টার সাহেবের গ্রন্থে এই ঐতিহাসিক তথ্য পাাওয়া যায়: '১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জানুয়ারি মাসে রংপুরের কৃষকগণ হঠাৎ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং রাজস্ব আদায়কারীদের বিতাড়িত করেন। তারা তাদের নেতা নবাব নুরুদ্দীনকে নবাব বলে ঘোষণা করেন এবং খাজনা প্রদান বন্ধ করেন। তাদের দাবিদাওয়া স্থানীয় কালেক্টরের নিকট পেশ করেন। বিষয়টি অমিমাংসিত হলে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে সেনাপতি ম্যাগাডোনাল্ডের নেতৃত্বে সিপাহী দল স্বয়ং সম্পূর্ণ নবাব নুরুদ্দীনের বিরুদ্ধে আক্রমণ করলে মোঘলহাট যুদ্ধে নবাব আহত এবং সেনাপতি দয়াল নিহত হন।

এই সময় অবশিষ্টাংশ বিদ্রোহীদল পাটগ্রাম অঞ্চলে অবস্থান করেন। পরদিন অন্য সিপাহীদল সাদা পোষাক পরে হঠাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি ১৭৮৩ সন পাটগ্রাম আক্রমণ করে সম্পূর্ণ বিদ্রোহী দলকে বিধ্বস্ত করে। যুদ্ধে ৬০ জন বিদ্রোহী নিহত ও বহু সংখ্যক আহত হয়ে বন্দী হন।'

ঐতিহাসিক উপাদান বা তথ্য হিসেবে সৈয়দ হক তাঁর নাটকে হান্টার সাহেবকেই অনুসরণ করেছেন। যদিও কোনো কোনো চরিত্রে হেরফের রয়েছে। তিনি নূরলদীন, দয়াশীল ও গুডল্যাডকে ঐতিহাসিক চরিত্র মনে করেন। কোম্পানির ফৌজি অফিসার হিসেবে ম্যাগডোনাল্ডকে নাটকে চরিত্র হিসেবে আনলেও তাকে তিনি ঐতিহাসিক চরিত্র বলেননি। কাব্যনাটক রচনার বিশেষ কৌশলটিকে আয়ত্ত্বে রেখে, নাট্যকার ঐতিহাসিক ঘটনাকে সমকালীন ভাবনার অনুগামী করে তুলতে, এই নাটকে কিছু পরিবর্তন সাধন করেছেন।

ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, বিদ্রোহে নূরুলদীন মারা যাননি, তাঁর সেনাপতি দয়াশীল নিহত হন। 'নূরলদীনের সারাজীবন' নাটকে দয়াশীল নিহত হননি।

ঐতিহাসিকভাবে বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল। অবশ্য এ কাব্যনাটকে ইংরেজ বাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের সরাসরি কোনো যুদ্ধ দেখানো হয়নি, বরং বিবাদমান দু'পক্ষের মধ্যে যুদ্ধংদেহী মনোভঙ্গি ও উত্তেজনাকে ক্রমশ তীব্রতর করে তোলা হয়েছে। মূলত নিপীড়িত কৃষকদের সংগ্রামী চেতনার বিপ্লবাত্মক ভাবটিকে আবাহনের লক্ষেই নাট্যকার এ কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। বোধ করি, এটি কাব্যনাটকের আঙ্গিক ধরে রাখার একটি বিশেষ কৌশল । তা না হলে এ নাটকে মৃতদেহ থেকে নূরলদীন জীবিত হয়ে উঠতো না। আবার নাটকের শেষে স্বেচ্ছামৃত্যুও গ্রহণ করতো না নূরলদীন, যদি না তাঁর সংগ্রামী চেতনাবাহী জনরাতে সমাবেত হতো।

এ নাটকে উল্লিখিত স্থান সমূহ ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। মোঘল হাট, কাজীর হাট, পাংশা, পাটোগ্রাম, ডিমলা প্রভৃতি স্থানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এ নাটকে। ভবানী, গরীবুল্লাহ, হরেরাম প্রভৃতি যোদ্ধাদের নামও আছে, যেগুলো ঐতিহাসিক। দেবীসিংহও ঐতিহাসিক চরিত্র। তবে তাকে নাট্যকার একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। এ নাটকে নীল চাষের কথা বলা হয়েছে।

ঐতিহাসিক তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশ নীলচাষ তখনও ব্যপকভাবে শুরু হয়নি। তবে এটিও কাছাকাছি সময়ের ঘটনা। যতদূর জানা যায়, ১৭৮৮ সালের পূর্বে বাংলাদেশে নীল চাষের প্রসার ঘটেনি। তবে নাট্যকার যে কৃষকদের ওপর নিপীড়িন ও অত্যাচারের মাত্রাকে অধিক তীব্র করে তুলতে চেয়েছেন তা বুঝতে কষ্ট হয় না।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যা-ই হোক, 'নূরলদীনের সারাজীবন' কাব্যনাটকের মূলসূর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে সুদৃঢ়ভাবে যুক্ত। এমনকি এটি গণনাটকের লক্ষণাক্রান্ত বললেও অত্যুক্তি হবে না। কারণ এর মধ্যে রয়েছে শ্রেণী-সংগ্রামের প্রেরণা এবং চেতনা। কারণ ঔপনিবেশিক আমলে, সাবেকি মোঘল আমলের সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেই পুঁজিবাদের বিকাশের যাত্রা শুরু হয়। ফলে উদ্ভুত জটিল সমস্যার আবর্তে কোম্পানি শাসকদের দৌরাত্ম্য এবং স্থানীয় জমিদার-জোতদার–মহাজন শ্রেণীর হাতে নিষ্পেষিত অসহায় কৃষকদের দুর্ভোগের মাত্রা অনেক গুণ বেড়ে যায়। বুর্জোয়াদের শোষণে প্রলেতারিয়েটদের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। এ যেন 'দুনিয়ার মজদুর এক হও' এই স্লোগানকেই মূলমন্ত্র করে সংঘবদ্ধ হতে থাকে রংপুর, দিনাজপুর, কোচবিহার, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলের কৃষক- প্রজা। তাদের এই ঐক্যের মূল প্রেরণা হলো তারা সকলেই নিঃস্ব, শোষিত, নিপীড়িত। নাট্যকার এই কাব্যনাটকটি রচনাকালে মার্ক্সীয় শ্রেণী-সংগ্রামের তত্ত্ব সম্পর্কে না ভেবে থাকলেও, এই প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। নূরলদীনের যোগ্য নেতৃত্বে সংগ্রামী চেতনার সূচনা-বিকাশ ও পরিণতির পথে এগিয়ে যায় নাটকটি।

নাটকের পরিসমাপ্তিতে বিপ্লব সাধিত না হলেও, একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যদিয়ে, বিপ্লবের মহান চেতনাকে পরবর্তী মুক্তিকামী গণমানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে, প্রলেতারিয়েতদের আশাবাদী করে নাটকের যবনিকাপাত ঘটে। আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন, এই সংগ্রামী চেতনার উৎসমূল কোথায়। নিশ্চয়ই শাসক গোষ্ঠীর নিরন্তর জুলুম -শোষণের ক্রিয়াত্মকতা থেকে। 'নূরলদীনের সারাজীবন' কাব্যনাটকে শ্রেণীচেতনা সূত্রটি মার্ক্সীয় দৃষ্টি-ভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যার অবকাশ থেকে যায় । এক্ষেত্রে, 'কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার' গ্রন্থে বলা হয়েছে: 'আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস শ্রেণী-সংগ্রামের ইতিহাস। স্বাধীন মানুষও দাস,প্যাট্রিশিয়ান এবং প্লিবিয়ান , জমিদার ও ভূমিদাস- এক কথায় অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত শ্রেণী সর্বদাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ থেকেছে, অবিরাম লড়াই চালিয়েছে, কখনও আড়ালে কখনও বা প্রকাশ্যে; প্রতিবার এ লড়াই শেষ হয়েছে গোটা সমাজের বিপ্লবী পুনর্গঠনে অথবা দ্বন্দরত শ্রেণীগুলির সকলের ধ্বংস প্রাপ্তিতে।'

সৈয়দ শামসুল হকের 'নূরলদীনের সারাজীবন' কাব্যনাটকেও উল্লিখিত অনিবার্য শ্রেণীসংগ্রামের সূত্রটি খুঁজে পেতে আমাদের কষ্ট হয় না। তবে এ নাটকে মার্ক্সের গভীর বিশ্বাস ও ব্যাখ্যা 'আধুনিক সাম্যবাদী সমাজ' প্রতিষ্ঠা পায় না। যাকে তিনি শ্রেণী-সংগ্রামের অনিবার্য ফসল বলে মনে করেন। তবে শ্রেণী-সংগ্রামের ব্যর্থতাও দেখানো হয়নি, বরং নাট্যকার কাব্যনাটকের বৈশিষ্ট্য রক্ষায় ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন।

নূরুলদীন ও তাঁর পক্ষের দ্রোহী ও সমবেত জনতার চেতনাকে তিনি ব্যঞ্জনাধর্মী করে তুলেছেন মিশরের সেই প্রাগৈতিহাসিক 'ফিনিক্স' পাখির রূপকথার মতো। যে পাখিকে আগুনে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হলেও তার ছাই বা ভস্ম থেকে আবার অগণিত পাখি নবজন্ম লাভ করে। অর্থাৎ মানুষ মরে যেতে পারে বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে কিন্তু তাঁর সুচেতনা বেঁচে থাকে; প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমরা এ নাটকে দেখতে পাই, নূরলদীনকে ঘিরে সমাবেত বিদ্রোহী জনতা যুদ্ধ-সাজে সজ্জিত হয়েছে। যুদ্ধন্মুখ দু'টি পক্ষ, কিন্তু কেউ কাউকে আক্রমণ করছে না। মনে হয়, এই বুঝি সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল। এ প্রসঙ্গে নূরলদীন ও তাঁর বাল্যবন্ধু আব্বাসের সংগ্রামের কৌশলের মধ্যে ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। নূরুলদীন জুলুমকারীদের উপর নগদ প্রতিশোধ চায়। কিন্তু আব্বাস নূরলদীনকে তাঁর শক্তিমত্তা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে, এবং বিশাল কোম্পানির বাহিনীর সাথে সরাসরি লড়াইয়ে নামার পূর্বে অধিক শক্তি সঞ্চয় এবং আরো সময় প্রয়োজন বলে মনে করে। আব্বাসের দূরদর্শী পরামর্শ গ্রহণ করে নূরলদীন। নাটকের পরিসমাপ্তিতে আব্বাসের যুক্তিই প্রতিষ্ঠিত হয়।

আব্বাসের শেষ সংলাপে ব্যক্ত হয় সুদূর প্রসারী একটি শ্রেণী-

সংগ্রামের ইঙ্গিত: ধৈর্য সবে- ধৈর্য ধরি করো আন্দোলন।

লাগে না লাগুক, বাহে, এক দুই তিন কিংবা কয়েক জীবন।

আব্বাসের এই ভাবনারই পরিপূরক সংগ্রামী চেতনার সর্বাত্মক

ক্রিয়াত্মকতা ও সুযোগ্য নেতৃত্ব দেখি কেন্দ্রীয় চরিত্র নূরুলদীনের

জবানিতে:

ভাবিয়া কি দেখিবো, আব্বাস যদি মরোঁ, কোনো দুঃখ

নাই।

হামার মরণ হয়, জীবনের মরণ যে নাই।

এক এ নূরলদীন যদি চলি যায়,

হাজার নূরলদীন আসিবে বাংলায়।

একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত কাব্যনাটক 'নূরলদীনের সারাজীবন' এর মধ্যে নাট্যকার তাঁর ভাবনাকে সমকালীনতার সাথে যুক্ত করেছেন নিপুণ দক্ষতায়। তা-না হলে 'প্রস্তাবনা' অংশ দিয়ে নাটক শুরু হতো না। সংস্কৃত নাটকের মতো 'প্রস্তাবনা' দিয়ে নাটক শুরু করেছেন মূলত, একটি অতীত ইতিবাচক ঘটনাকে শুধুই সমকাল-সংলগ্ন করে উপস্থাপনের জন্য। কারণ প্রস্তাবক বা সূত্রাধার নাটকের ঘটনা প্রবাহের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো চরিত্র নয়। স্বদেশ, সমাজ ও সমকাল সচেতন এই প্রস্তাবক কাল-পরিক্রমায় নূরুলদীনকে স্মরণ করেছেন; যখন অনাচার, জুলুম শোষণ, নিপীড়নের তীব্রতায় ছেয়ে যায় স্বদেশ। এমন দুঃসময়ে নূরলদীনের মতো একজন মুক্তিপাগল নেতা ও তাঁর নেতৃত্বের আবাহন তাই অনিবার্য হয়ে উঠে:

নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়

যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়;

নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়

যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়।

নূরলদীনকে স্মরণ করেই ক্ষান্ত হন না লোকটি; নূরলদীন আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন এমন প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন:

অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়

যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,

আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়

দিবে ডাক, 'জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?

এভাবেই প্রায় দু'শো বছর পূর্বে রংপুরের কৃষক বিদ্রোহের নেতা নূরলদীনের 'জাগো, বাহে ,কোনঠে সবায়?' ডাকটি সমসাময়িক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বের সাথে জাগরণের কাজটি করে থাকে। 'নূরলদীনের সারাজীবন' নাটকে কোম্পানির কর্মকর্তাবৃন্দের সংলাপ ও আচরণ, এদেশীয় সমকালীন আমলাতন্ত্রের চেহারা মনে করিয়ে দেয়।

কোম্পানি পরিচালনার প্রত্যক্ষ অঙ্গ হয়েও কালেক্টর গুডল্যাড, রেভিনিউ সুপারভাইজার মরিস, ফৌজি অফিসার ম্যাকডোনাল্ড, কুঠিয়াল টমসন ও তার স্ত্রী লিসবেথ প্রত্যেকের কর্মকাণ্ড, কথাবার্তায় তাদের সরকার ও দায়িত্বের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ পেলেও; তাদের আত্মপ্রীতি, স্বার্থপরতা, লোভাতুর মানসিকতা দৃষ্টি এড়ায় না। যাকে আমাদের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তুলনা করা যায়। আমলাদের উচ্চভিলাসী জীবন ভাবনার প্রতিফলন দেখতে পাই পরস্পরের সংলাপে। গুডল্যাডের সংলাপে স্পষ্টত ধরা পড়ে এই মনোভঙ্গি:

এবং দরিদ্র

দেহে নীল রক্ত নেই, পিতার সম্পদ নেই

শীতের আগুন নেই, বর্তমান ভিন্ন কোনো বাস্তবতা নেই।

বাণিজ্য বা রাজত্বেও হোক না প্রসার,

তাতে কোন স্বর্গ লাভ তোমার আমার?

এই উচ্চাভিলাসী ভাবনা আরো উচ্চকিত হয়েছে মরিসের সংলাপে:

পুত্রের দু'হাত ভরে দিতে চাই নিশ্চিন্ত জীবন,

প্রাসাদে কন্যার চাই নাচে নিমন্ত্রণ,

হ্যাঁ, চাই, হ্যাঁ

আমি চাই -কোনোদিন অর্থে ও সম্পদে যদি সম্ভব তা হয়,

আমার এ দেহে নীল রক্ত আমি চাই,

আমিও ব্যারন হতে চাই,

আমি চাই ব্যারনের জীবন যাপন।

'নূরলদীনের সারাজীবন' কাব্যনাট্যে ব্যবহৃত কোরাস গ্রিক নাটকে ব্যবহৃত কোরাসের মতো নয়। গ্রিক নাটকে কোরাসের ভূমিকা ছিল মূল ঘটনা প্রবাহের বাইরে থেকে ঘটনা সম্পর্কে ধর্মীয়, নৈতিক ও সামাজিক মতামত প্রদান করা। কিন্তু উল্লিখিত কাব্যনাটকে কোরাসের ভূমিকা সামষ্টিক চেতনার প্রসূন। নাটকে লালকোরাস ও নীলকোরাস চরিত্রের মতোই কাজ করেছে। লালকোরাস কৃষকদের পক্ষে এবং নীলকোরাস ইংরেজ কোম্পানির পক্ষ অবলম্বন করে বিদ্রোহী ভাবকে আরো ঘনীভূত করেছে। সুবিধাবাদী এদেশীয় কতিপয় জনগণও নীলকোরাসে দেখা যায়।

ব্যক্তি-স্বার্থ চরিতার্থ করার এই মানসিকতা রূপায়ণের মাধ্যমে নাট্যকার সুবিধাবাদী মানবচৈতন্যের একটি চিরায়ত দিক তুলে ধরেছেন। আম্বিয়া নূরুলদীনের স্ত্রী। সে চিরায়ত সহজ সরল সাধারণ বাঙালী নারীর প্রতিভূ। অন্য দশ জন সাধারণ নারীর মতোই সে স্বামীর কল্যাণ কামনা করে। স্বামী-সংসার নিয়েই তার সকল চিন্তা আবর্তিত হতে দেখি। সে আধুনিক নারী নয়। তবু নূরলদীন যখন কৃষক বিদ্রোহের নেতা ও নবাবে পরিণত হয়, তখন আম্বিয়ার মধ্যে স্বাভাবিকভাবে উচ্চাভিলাস তৈরী হয়। সে রাণী হবার স্বপ্ন দেখে। নূরলদীনকে তার বাসনার কথা জানায়। নূরলদীন তার প্রকৃত দ্রোহী চেতনা থেকে আলগা হয় না।

নূরলদীনের স্ত্রীর এরকম স্বপ্নের কথা শুনে স্ত্রীকে ধিক্কার দেয় এবং তাঁর সংগ্রামী চেতনা চতুর্গুণ দ্রোহে ফেটে পড়ে। আম্বিয়া একখান আগুনপাটের শাড়ির কথা বলতেই নূরলদীন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে:

আগুন, আগুন।

আগুন শাড়িতে নয়, প্যাটেতে প্যাটেতে।

আগুন, আগুন জ্বলে, এই ঠাঁই, হামার প্যাটেতে,

কিষাণের সন্তানের প্যাটের ভিতর।

....... ...... ...... ......

আগুন পাটের শাড়ি কাড়ি নেয় কোম্পানী কুঠিতে,

আগুন পাটের শাড়ি জ্বলি ওঠে তাঁতির প্যাটেতে।

আগুন পাটের শাড়ি দাউ দাউ করি জ্বলে সারা বাংলাদেশে।

আম্বিয়া চরিত্রের এই উচ্চাভিলাসী দিকটি লেডি ম্যাকবেথের প্রভাবজাত হওয়া অসম্ভব নয়।তবে নূরলদীন আম্বিয়ার এ ধরনের প্ররোচনা ও প্রণোদনাকে ছাপিয়ে যথার্থ অর্থেই নিষ্পেসিত জনতার প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছে এবং গণনায়কে পরিণত হয়েছে।

সামগ্রিকভাবে বিচার করলে 'নূরলদীনের সারাজীবন' কাব্যনাটকে 'শ্রেণি-সংগ্রামের' লক্ষণ যেমন দুর্লক্ষ্য নয়, তেমনি 'সাব-অলটার্ন স্টাডিজের' দৃষ্টিকোণ থেকেও নাটকটিকে বিশ্লেষণ করা যায়। সৈয়দ শামসুল হক যে অভিপ্রায় নিয়েই এ কাব্যনাটকটি রচনা করে থাকুক না কেন, কব্যনাটক হিসেবে এটি যে সফলতার শিখরে সমাসীন হয়েছে, বাংলাসাহিত্যের নাট্যমোদীরা ভিন্নমত পোষণ করবেন না নিশ্চয়ই।

আধিপত্যবাদী ক্ষমতাধর উচ্চবর্গ কোম্পানির শাসন-শোষণ, সাথে এদেশীয় জমিদার-মহাজন ও সুবিধাদীদের অত্যাচার ও শোষণের পটভূমিকায় চির দুঃখী নিম্নবর্গীয় কৃষক প্রজার বিদ্রোহী ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠার ভূমিকা শৈল্পিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সৈয়দ শামসুল হক। 'নূরলদীনের সারাজীবন' এভাবেই স্বদেশ, সমাজ, সমকাল ও জীবন সম্পর্কে পাঠক ও দর্শক-চিত্তে বিচিত্র ভাবনার উদ্বোধন ঘটায়।

Comments

The Daily Star  | English

Govt mulling incorporating ‘three zero’ theory into SDG

The government is considering incorporating the "three zero" theory of Chief Adviser Professor Muhammad Yunus into Sustainable Development Goals (SDGs)

49m ago