সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির মধ্যেও বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ছে

bangladesh_bank.jpg
বাংলাদেশ ব্যাংক। স্টার ফাইল ফটো

বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি আগস্টে ১৪ দশমিক ০৭ শতাংশে পৌঁছেছে, যেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সমগ্র অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি। এই প্রবণতা দেশের অর্থনীতির জন্য একটি অশনি সংকেত, কারণ এতে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়তে পারে।

গত জুনে বাংলাদেশ ব্যাংক যখন ২০২২-২৩ অর্থবছরের মুদ্রানীতি প্রকাশ করে, তখন তারা এই অবস্থানকে সংকোচনমূলক বলে অভিহিত করে। কিন্তু বেসরকারি খাতে বর্তমান ঋণের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির বিপরীত।

বাংলাদেশ ব্যাংক চলমান অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১৪ দশমিক ১ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এর আগের বছর এই খাতে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঋণের প্রবৃদ্ধি মার্চ থেকে বাড়ছে।

বিশ্লেষকরা বলেন, ঋণের সুদ হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সিলিং নির্ধারণ করে দেওয়ায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কাজ করছে না। ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি থাকায় অর্থের সরবরাহ বাড়ছে। এই প্রবণতা মূল্যস্ফীতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে।

জুনে গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির পর জুলাইতে তা কমে ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ হয়।

সরকার এখনও আগস্টের মূল্যস্ফীতির সংখ্যাটি প্রকাশ করেনি। তবে, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এ মাসের শুরুর দিকে ইঙ্গিত দেন, দৈনন্দিন জীবনযাপনের খরচ বেড়ে যাওয়া ও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মঞ্জুর হোসেন বলেন, 'মূল্যস্ফীতির চাপের মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির রাশ টেনে ধরতে একটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে।'

'তবে ঋণের ক্ষেত্রে সুদের হারের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়ায় অর্থ সরবরাহ কমছে না। এ ধরনের সর্বোচ্চ সীমা বজায় রেখে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা যায় না', যোগ করেন তিনি।

সুদ হারের সর্বোচ্চ সীমার কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কম খরচে ঋণ পাচ্ছে। ফলে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে।

অর্থনীতিবিদ মঞ্জুর হোসেন বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিৎ হবে ঋণে সুদের সিলিং প্রত্যাহার করে অর্থের সরবরাহ কমিয়ে আনা। এটা করা না হলে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে।'

অর্থ সরবরাহ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেঞ্চমার্ক সুদের হার ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ করেছে। সাধারণত, বেঞ্চমার্ক সুদ হার বা পলিসি রেট বাড়ালে ব্যাংকে তহবিল ব্যয় বেড়ে যায়।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে ঋণ ও আমানতে সুদ হার নির্ধারণ করতে এটি ভূমিকা রাখে। যেসব ব্যাংক অর্থ সংকটে ভুগে, তারা পলিসি রেট (৫ দশমিক ৫ শতাংশ) হারে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে স্বল্প মেয়াদি ঋণ নেয় এবং তা ঋণগ্রহীতাদের কাছে বিতরণ করে।

তবে ঋণের সুদ হারের ওপর সিলিংয়ের কারণে পলিসি রেট বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

মঞ্জুর হোসেন আরও বলেন, 'সুদ হারের সিলিং প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত চলমান মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না।'

তবে এই অর্থনীতিবিদ উল্লেখ করেন, যদি ব্যাংকের দেওয়া ঋণ উৎপাদন খাতে যায়, তাহলে মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ সইতে পারবে।

'উৎপাদন খাত সম্প্রসারণ হলে নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হয়। তবে এই তহবিল ভোক্তাঋণ আকারে গেলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে', যোগ করেন তিনি।

পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে বলেন, যদি ব্যাংকগুলোর কাছে বাড়তি তহবিল থাকত তাহলে এখন ঋণের প্রবৃদ্ধি আরও অনেক বেড়ে যেতো।

তিনি বলেন, 'ঋণের সুদ হারে সিলিং নির্ধারণ করে দেওয়ায় কম খরচে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে।'

উচ্চ আমদানি খরচের কারণে ব্যাংকগুলো এখন ডলার সংকটে আছে। গত অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাপক মাত্রায় বাজারে ডলার সরবরাহ করছে যাতে আমদানিকারকরা আমদানি বিল নিষ্পত্তি করতে পারে।

বিগত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে রেকর্ড ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সরবরাহ করে। চলমান অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন অর্থনীতিবিদ জানান, আমদানি বিল বেড়ে যাওয়াতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।

জুলাইতে আমদানি বিলের পরিমাণ বেড়ে ৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার হয়, যেটি এক বছর আগের তুলনায় ২৩ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক জানান, ডলার ও টাকার বিনিময় হারের তারতম্যের কারণে ক্ষতির শিকার হওয়া থেকে বাঁচার জন্য অনেক আমদানিকারক এলসি খোলার সময় তাৎক্ষণিক আমদানি বিল পরিশোধ করছেন।

'তারা আমদানি-পরবর্তী অর্থায়ন হিসেবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পেমেন্ট করছেন। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব এসেছে', যোগ করেন এমরানুল হক।

এর পেছনে কারণ হল, গত ১ বছরে ডলারের বিপরীতে টাকা ২৫ শতাংশ মূল্য হারিয়েছে। গতকাল ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ছিল ১০৫ দশমিক ৩৫।

চলমান যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক পণ্য সরবরাহ এখনও বিঘ্নিত হচ্ছে, ফলে আগামীতে স্থানীয় মুদ্রা আরও দুর্বল হতে পারে।

এমরানুল হক আরও জানান, ভোক্তা ঋণও বাড়ছে এখন। এতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে।

'আমাদেরকে ভোক্তা ঋণ কমাতে হবে। এটা করা না হলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে ভুগতে পারে', যোগ করেন তিনি।

অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

54m ago