‘প্রশ্ন আর ফাঁস হবে না’ গ্যারান্টির মধ্যেই ফাঁসের বার্তা

চালের দাম আর বাড়বে না—মন্ত্রীর এমন আশ্বাসের পরই বেড়ে যায় চালের দাম। তেল, ডাল, ডিমসহ প্রায় সব নিত্যপণ্য নিয়েও একই কাণ্ড। গত কয়েক বছরে মানুষও নমুনা বুঝে গেছে। মন্ত্রী বা সরকারি উচ্চপর্যায় থেকে কোনো কিছুর দাম কমার আশ্বাস বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি মানেই যেন দাম বৃদ্ধির আগাম বার্তা।

সেই দৃষ্টে তাদের আশ্বাস বা হুঁশিয়ারি শোনামাত্র ক্রেতারা সাধ্য মতো যতদূর সম্ভব দ্রুত ওই পণ্য কিনে ফেলে। বাজারের এ সিনড্রোম নির্বাচন পেরিয়ে ভর করেছে পাবলিক পরীক্ষায়ও।

কিছু দিন ধরে শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্নফাঁস নিয়ে বেশ গর্ব করছিলেন। বলছিলেন, এখন আর প্রশ্নফাঁস হয় না। তারপরও কেউ প্রশ্ন ফাঁস করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার গর্ব ও হুঁশিয়ারির পর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। এক-দুটি নয়, চলমান এসএসসি পরীক্ষায় ফাঁস হয়েছে ৬টি বিষয়ের প্রশ্ন।

একজন কেন্দ্রসচিবকে 'ধামা' বানিয়ে চাপা দিয়ে ফেলা হয়েছে ঘটনাটি। চালিয়ে দেওয়া হয়েছে 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' নামে। একে মোটেই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে ফেলা যায় না। এসএসসি পরীক্ষা মোটেই কোনো বিচ্ছিন্ন পরীক্ষা নয়। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ড পাড়া-মহল্লার যেনতেন বিচ্ছিন্ন কোনো বোর্ড বা সভা নয়।

দিনাজপুরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা খুব বাজে বার্তা দিচ্ছে। গত মঙ্গলবার ঘটনা ধরা পড়ার পর বুধবার গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, কৃষিশিক্ষা ও রসায়নের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। একসঙ্গে ৬টি বিষয়ের প্রশ্নফাঁস রেকর্ড গড়া ঘটনা। একজন কেন্দ্রসচিবের একার পক্ষে সম্ভব এমন ঘটনা ঘটানো?

গত বছর কয়েক ধরে অবিরাম প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। একদিকে বলা হচ্ছে এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্সের কথা, কাউকে ছাড় না দেওয়া, ধরা পড়লে কঠোর শাস্তির হুমকি। অন্যদিকে, পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি বিসিএস, মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পর্যন্ত প্রশ্নফাঁসের ঘটনা। তা গড়িয়েছে ব্যাংকসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায়ও। নার্স নিয়োগের পরীক্ষাও বাদ যায়নি প্রশ্নফাঁসের কলঙ্ক থেকে। আয়োজনে এসব পরীক্ষা পাবলিক পরীক্ষার কাছাকাছি।

মাঝেমধ্যে প্রশ্নফাঁস চক্রের 'হোতা' ধরার খবর আসে। র‍্যাব, গোয়েন্দাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাঞ্চল্যকর অভিযানে প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের সম্পর্কে জানানো হয়। নানান ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রশ্নফাঁস কর্মটি ২-৪ জনের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে শুরু করে সরকারি প্রেসে ছাপা, কেন্দ্রে-কেন্দ্রে বিতরণ পর্যন্ত পরতে পরতে লাগছে অনেক হাতের ছোঁয়া। ঘটনাচক্রে কখনো কোনো ঘটনা ধরা পড়ে। কিন্তু, প্রায়ই পুরো সত্য প্রকাশ না করে আংশিক প্রকাশ বা কাউকে রেহাই দিতে গিয়ে সত্য আড়াল হয়ে যাচ্ছে। যা প্রকারান্তরে প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের জন্য কেবল উৎসাহ নয়, প্রণোদনাও। যার পরিণতিতে ঘটছে প্রশ্নফাঁসের একটির পর আরেকটি ঘটনা।

স্থানীয়, জাতীয় যেকোনো পর্যায়ে প্রশ্নফাঁস রোধের প্রধানত দায়িত্ব সরকারের। সেই দায়িত্ব না নিয়ে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান একেবারেই গৎবাঁধা বাতকেবাত কাজ। দায়িত্ব খেলাপও বলা যায়। তারওপর 'এখন আর প্রশ্ন ফাঁস হয় না, কাউকে ক্ষমা করা হবে না, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে'—ধরনের হুমকি-ধমকি পর্যবশিত হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের ওয়াদা বা নিত্যপণ্যের দাম কমানোর মতো আশ্বাসে।

এমনিতেই বিনাভোটে জয় ও বিনাপরীক্ষায় পাসকে সমার্থক করার একটি প্রবণতা রয়েছে। সেইসঙ্গে সুষ্ঠু ভোটের ওয়াদা করে জালিয়াতি-কারচুপি, ন্যায্যমূল্যের আশ্বাসের পর দাম বাড়ানোর মতো দশা পরীক্ষার প্রশ্নপত্র নিয়ে। 'প্রশ্ন আর ফাঁস হবে না' গ্যারান্টির মধ্যে ফাঁসের বার্তা মিলে যাচ্ছে।

প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে মামলা, কিছু ধরপাকড় আর গরম কথা মোটেই সমাধান নয়। দিনাজপুরের ঘটনায়ও ভূরুঙ্গামারী থানায় মামলা হয়েছে। কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারীকে ধরে জেলে পাঠানো হয়েছে। ভুল করে অন্য বিষয়ের প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণের ঘটনাও ঘটেছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে। এটা মোটেই সমাধান নয়।

চলমান মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস প্রমাণের বহু খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। বিভিন্ন বোর্ডের অধীন কিছু কেন্দ্রে দেখাদেখির পরিবেশে পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র শিক্ষকের লিখে দেওয়ার লজ্জাজনক খবরও পাওয়া গেছে। এমন একটি ঘটনায় পটুয়াখালীতে মামলা হয়েছে। এটিই সমাধান?

মাঝে কিছুদিন প্রশ্নফাঁস কিছুটা কমেছিল। কেন কমেছিল, তা দেখতে হবে সরকারকেই। এখন আবার কেন তা বাড়বাড়ন্ত, সেটি ভাবার মূল দায়িত্বও সরকারের। দায়িত্বের দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন অভিভাবকরা। দুঃখজনকভাবে কোথাও কোথাও এ অনৈতিকতায় অভিভাবকদেরও জড়িয়ে পড়ার কুচর্চার খবর মিলছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেতে মা-বাবাও দৌড়ান। সন্তানও মা-বাবাকে দ্বিধাহীনভাবে বলছে, ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যোগার করে দিতে। যে মা-বাবার সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দেবেন, তারাই সন্তানকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কাজ করলে সমাজ নৈতিকতা শিখবে কিভাবে, কোত্থেকে? চিত্রটা জাতির জন্য চরম বিপজ্জনক।

প্রশ্ন ফাঁস অপরাধ বিচারে মারাত্মক 'দুর্নীতি'। কেবল সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় নয়, বিষয়টি সবার জন্য ভাবনার। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে একদিকে দুর্বল মেধার শিক্ষার্থীরা এগিয়ে যাচ্ছে, প্রকৃত মেধাবিরা যাচ্ছে পিছিয়ে। প্রশ্নফাঁসের ঘটনার সঙ্গে আমাদের নৈতিক বিষয়টি জড়িত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরীক্ষার আগের রাতে মোটা অংকের টাকায় কেনা-বেচা হয় এসব প্রশ্ন। একটি অসাধু মহল ওইসব পরীক্ষা আয়োজনকারী কিংবা দায়িত্বপালনকারীদের সঙ্গে যোগসাজগে আগেই প্রশ্ন পেয়ে যায়। পরে সতর্কতার সঙ্গে চাকরি প্রার্থী কিংবা পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। কোনো কোনো সময় একটি নির্দিষ্ট স্থানে পরীক্ষার্থীদেরকে রেখে প্রশ্ন ও উত্তর দিয়ে দেওয়া হয়। চাকরি প্রার্থীরা ওই স্থানে রাতযাপন করে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও সমাধান থেকে প্রস্তুতি নিয়ে পরদিন পরীক্ষায় অংশ নেন।

কখনো কখনো টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন সরাসরি নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষার্থীর হাতে পৌঁছে যায়। তাদের মধ্যে অনেকে সেই প্রশ্নের স্ক্যানড কপি মুঠোফোনে থাকা ইন্টারনেট ব্যবহার করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন। গোটা বিষয়টি সমাজে অনৈতিকতার ভয়াবহতা ইঙ্গিত করে। লক্ষণটি ভালো ঠেকছে না। শিক্ষাকে রাজনৈতিক বা পরীক্ষাকে নির্বাচনের মতো বিষয়াদিতে ওজন করলে এ ভয়াবহতা আরও তীব্র না হয়ে পারে না।

মোস্তফা কামাল: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
narcotics cases pending despite deadline

4.8 lakh narcotics cases pending despite deadline

Judge shortage, lack of witnesses, inadequate court infrastructure blamed for delays

7h ago