‘ফাইভ স্টার’ হাসপাতালের অভিজ্ঞতা

গত ২৯ আগস্ট রাতে হঠাৎ বুকে ও পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হয়। ভোরের দিকে ব্যথা আর সহ্য করতে না পেরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যাই। রাজধানীর প্রথম সারির ৩টি ‘ফাইভ স্টার’ হাসপাতালের নাম করলে এটি প্রথম দুইয়ের মধ্যেই থাকবে। ওই ভোরে পরিবারের সদস্যরা আমার শারীরিক অবস্থা দেখে গভীর আস্থায় ওই হাসপাতালে যাওয়ারই পরামর্শ দেন। কিন্তু অত বড় হাসপাতালে ৩ দিনের যে অভিজ্ঞতা এবং সেখান থেকে রীতিমতো জোর করে যেভাবে বেরিয়ে আসতে হয়েছে, তা দুর্বিষহ।
ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

(ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলার সংবাদ মাঝেমধ্যেই আলোচনায় আসে। কিন্তু আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সংকট যে কতটা ভয়াবহ, এই লেখাটি তার ছোট্ট একটি দৃষ্টান্ত।)

গত ২৯ আগস্ট রাতে হঠাৎ বুকে ও পেটে তীব্র ব্যথা শুরু হয়। ভোরের দিকে ব্যথা আর সহ্য করতে না পেরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যাই। রাজধানীর প্রথম সারির ৩টি 'ফাইভ স্টার' হাসপাতালের নাম করলে এটি প্রথম দুইয়ের মধ্যেই থাকবে। ওই ভোরে পরিবারের সদস্যরা আমার শারীরিক অবস্থা দেখে গভীর আস্থায় ওই হাসপাতালে যাওয়ারই পরামর্শ দেন। কিন্তু অত বড় হাসপাতালে ৩ দিনের যে অভিজ্ঞতা এবং সেখান থেকে রীতিমতো জোর করে যেভাবে বেরিয়ে আসতে হয়েছে, তা দুর্বিষহ।

প্রায় ৩ সপ্তাহ আগের সেই ভোরে হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে যাওয়ার পর ব্যথা কমাতে ডাক্তার ও নার্স আমাকে বেশ কয়েকটি ইনজেকশন দেন। চলতে থাকে একের পর এক পরীক্ষা ও পরীক্ষার জন্য রক্ত নেওয়া।

দুপুরের দিকে জানানো হয়, ভর্তি হতে হবে হাসপাতালে। কারণ ব্যথার কারণ বোঝা যাচ্ছে না। ব্যথা তখনও পুরোপুরি কমেনি এবং হার্টবিট তখনও ১২০ এর উপরে।

একজন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হয়। কার তত্ত্বাবধানে ভর্তি হতে চাই তা আমাদের কাছে কেউ জানতে চায়নি। রক্তের অনেকগুলো পরীক্ষা করানো ছাড়াও দুপুরের মধ্যে আমার পুরো অ্যাবডোমিনাল আলট্রাসনোগ্রাম, ইসিজি, ইকো কার্ডিওগ্রাম এবং ফ্যাটি লিভারের পরীক্ষায় ফাইব্রো স্ক্যান করানো হয়।

মনে আছে, ফাইব্রো স্ক্যানের সময় যিনি পরীক্ষা করছিলেন তিনি বলছিলেন, খুব বেশি সমস্যা নেই আপনার। ওষুধ দিলে ঠিক হয়ে যাবেন।

ভর্তির পর আমাকে হাসপাতালের সুন্দর পোশাক পরিয়ে দিতে, চুলে ঝুটি করে দিতে নার্স আসেন। আসেন একজন পুষ্টিবিদও। এরপরই আসেন গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির ডাক্তার। তিনিও হাসপাতালের পোশাকে সুসজ্জিত। ইংরেজিতে কথা বলেন। এসেই জানতে চান, কী করি আমি। উত্তরে জানাই চাকরি করি। বললেন কোথায়, জানাই সাংবাদিক।

ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনের জন্য ২ দিন আগে থেকে একটি অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হচ্ছিল আমাকে। এর সঙ্গে ডাক্তার আরেকটি অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন যোগ করলেন। আরও কিছু খাওয়ার ওষুধ দিলেন। বললেন, আপনার পুরো অবস্থা জানতে অ্যান্ডোস্কপি ও কোলোনস্কোপি করতে হবে।

আমার পরিবারের সদস্যরা জানতে চান, কোলোনস্কোপি কেন করানো দরকার? তিনি জানান, 'পুরো অবস্থা কমপ্যারিজনের জন্য' দুটি পরীক্ষাই করা দরকার। কিন্তু এই অবস্থায় এতো পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধকল শরীর নিতে পারবে কি না, সেই প্রশ্নে তিনি বলেন, সেটা কষ্টকর, তবে খুব সমস্যা হবে না।

এরই মধ্যে আমাদের বন্ধুবান্ধবরা খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করেছে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ডাক্তার। গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজির ডাক্তারও আছেন দুজন। ডাক্তার অ্যান্ডোস্কপি ও কোলোনস্কপি করতে চান জেনে তারা একটু চিন্তিত হন। দুজনই শেষ পর্যন্ত বলেন, তাদের মতে কোলোনস্কপি করার কোনো যুক্তি নেই।

শেষ বিকেলে আরেকবার ডাক্তার আসেন আমাদের কোলোনস্কপি করানোর জন্য বলতে। তবে কী হয়েছে, কেন করতে হবে তার উত্তরে 'পুরো অবস্থা কমপ্যারিজন' ছাড়া আর কিছু বলেননি তিনি। বরং আমরা কোলোনস্কপি করতে অনাগ্রহী জেনে গম্ভীর মুখে মাথা নাড়াতে থাকেন।

রাতে ডাক্তার বন্ধুদের পরামর্শে একই বিভাগের অন্য একজন অধ্যাপকের অধীনে আমি বদলি হয়ে যাই। তিনি একটু রাতে আসেন দেখতে।

পুরো পরিস্থিতি শুনে, কী কী ওষুধ চলছে সেটা দেখলেন। ইউরিন ইনফেকশনের জন্য যে ওষুধটা চলছে, যেটা কালচার রিপোর্ট দেখেই দিয়েছেন গাইনি ডাক্তার। সেই রিপোর্ট দেখে চমকে উঠলেন তিনি। জানালেন, আমাকে নতুন যে অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন এই হাসপাতালের আগের ডাক্তার দুপুর থেকে দিয়ে যাচ্ছেন সেটি 'রেজিসট্যান্ট'। যা আগে করা কালচার রিপোর্টেই বলা আছে। জানা থাকার পরও সেটি আমাকে কেন দেওয়া হয়েছে তা ডিউটি ডাক্তারের কাছে জানতে চান তিনি। তবে রোগী ও তার পরিবারের সামনে খুব বেশি উচ্চবাচ্য করেননি। একইসঙ্গে তিনি ফাইব্রো স্ক্যান রিপোর্টে এক জায়গায় দাগ দিয়ে ডিউটি ডাক্তারকে কিছু একটা বলেন। তবে আমাদের কিছুই জানান না।

আমরা জানতে চাইলে, তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে নতুন অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দেন এবং যাওয়ার আগে বলেন, জ্বর কমলে পরের দিন অ্যান্ডোস্কপি করা হবে। কোলোনস্কপি করতে হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'প্রয়োজন নেই। শুধু অ্যান্ডোস্কপি করলেই হবে।'

পরদিন জ্বর ও ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় অ্যান্ডোস্কপি করা যায়নি। এর পরদিন অ্যান্ডোস্কপি করার জন্য আমরা প্রস্তুতি নেই।

অ্যান্ডোস্কপি করতে যাওয়ার আগে দুপুর ২টার দিকে একটা কল আসে আমার ফোনে। ২ হাত ক্যানুলার কারণে ফুলে থাকায় কল ধরেন আমার হাজবেন্ড। ফোনটা করেছিলেন যিনি আমার ফাইব্রো স্ক্যান করেছিলেন তিনি। বলেন, রিপোর্টটা নিয়ে যেন হাসপাতালে তার সঙ্গে কেউ একজন দেখা করে। একটু ঝামেলা আছে আগের রিপোর্টে। তাকে যখন জানানো হয় আমরা হাসপাতালেই ভর্তি আছি, তিনি রুম নম্বর জানতে চান। আমার হাসব্যান্ডের সন্দেহ হলে তিনি দ্রুত নার্সেস স্টেশনে গিয়ে আমার ফাইলটা দেখতে চান। ফাইব্রো স্ক্যান রিপোর্টটি বের করে তিনি দেখতে পান অন্য আরেক রোগীর রিপোর্ট। যা আমার রিপোর্টের সঙ্গে বদলে গেছে। তিনি দ্রুত সেটার ছবি তোলেন, যদিও ডিউটি নার্স বাধা দেন। সেখানে একদফা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এরই মধ্যে ফাইব্রো স্ক্যান যিনি করেছিলেন, তিনি একটি রিপোর্ট নিয়ে এসে হাজির হন। ওই রিপোর্টে আমার নাম লেখা ছিল এবং উভয় রিপোর্টে আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখা যায়। এদিকে আমাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ভুল রিপোর্ট বিবেচনায়।

ফাইব্রো স্ক্যান মূলত লিভারে কোনো সমস্যা আছে কি না, তা জানার জন্য করা হয়ে থাকে। সেখানে যার রিপোর্ট আমাকে দেওয়া হয়েছিল সেই রোগীর ফ্যাটি লিভার ছিল ৫৩ এর বেশি। আর আমার ছিল ৩।

এসব ঘটনা আমাকে তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হয়নি, কারণ তার একটু পরই আমার অ্যান্ডোস্কপি টেস্ট ছিল।

টেস্ট করে এসে আমি জানতে পারি এ ভুলের কথা।

এদিকে, টেস্ট করার পর ডাক্তার এসে প্রথমবারের মতো লম্বা সময় আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। বললেন, চিকিৎসার জন্য আরও অন্তত ৫ দিন হাসপাতালে থাকা দরকার।

কিন্তু পরপর এমন ভুল ও হাসপাতালের নার্সদের অদক্ষতা, কী চিকিৎসা হচ্ছে তার বিস্তারিত না জানানো, সব মিলিয়ে তখন সিদ্ধান্ত নেই, আমি আর ওখানে থাকব না।

জানতে চাই, এত বড় একটা হাসপাতালে ভুল ইনজেকশন পুশ করা, আরেকজন রোগীর সঙ্গে রিপোর্ট পাল্টে যাওয়া— এটা কীভাবে সম্ভব? তিনি এর কোনো উত্তর দিতে পারেন না।

তারপরও তারা আমাকে ছাড়পত্র দিতে চায় না। কিন্তু আমার সব আস্থা তখন শূন্যের কোঠায়। আমি পরিচিত এক চিকিৎসককে ফোন করি। তিনি তার হাসপাতালে আমার চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে রাজি হন এবং সেই পাঁচ তারকা হাসপাতালের মোটা অংকের বিল পরিশোধ করে চলে আসি।

কেবল ভুল চিকিৎসা নয়, হাসপাতালে ৩ দিনে‌ ২ হাতে মোট ৯ বার ক্যানুলা করানো হয়েছে। তার মাঝে ৩ বার ক্যানুলা করার সময় ভেইন না পেয়ে কাঁথা ফোঁড়ানোর মতো করে সুই ফোঁড়ানো হয়েছে। প্রচণ্ড অসুস্থতার মধ্যে আমি জানতে চাই, কেন এতবার ক্যানুলা করতে হচ্ছে। তারা বলেন, আপনার ভেইন খুঁজে পাওয়া যায় না। আপনার ওষুধ পাস হয় না।

মনে আছে, এক রাতে এক হাতে একই জায়গায় দুবার ক্যানুলা করিয়েছেন তারা। আমি ব্যথায় চিৎকার করে বলেছি, আপনাদের ভেইন ফাইন্ডার নেই? তারা এমনভাবে তাকায়, যেন এই যন্ত্রের নাম তারা শোনেননি।

তবে পরদিন এক নার্স এসে জানান, হাসপাতালের আরেক বিল্ডিংয়ে ভেইন ফাইন্ডার মেশিন আছে। তবে সেটি এই বিল্ডিংয়ে আনার অনুমতি নেই!

বিলাসবহুল হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে পরের কয়েকদিন বাসার কাছের সেই পরিচিত ডাক্তারের অখ্যাত হাসপাতালে দিনে ৩ বার করে পরবর্তী ইনজেকশনগুলো নিয়েছি। ছোট ওই হাসপাতালের নার্সরা আমাকে ব্যথা ছাড়াই ক্যানুলা করান। সেই ক্যানুলা দিয়ে আমার ওষুধ নিতে কোনো সমস্যা হয়নি।

ওই ছোট হাসপাতালের রক্ত পরীক্ষাতেই বেরিয়ে আসে আমার পেপটিক আলসারসহ অন্যান্য জটিলতার কথা, যা ধনীদের সেই চোখ ধাঁধানো হাসপাতাল আমাকে ৩ দিন ধরে হরেকরকমের পরীক্ষা করিয়ে বের করতে পারেনি। ছোট ওই হাসপাতালের বাসার জামা পরা নার্সরা আমার মাথার কাছে একটা চেয়ার নিয়ে বসে থাকেন, কখন কী লাগে জানার জন্য! আর চকচকে হোটেলের মতো হাসপাতালের নার্সদের আমি অ্যান্ডোস্কপির পর অনেকবার ডেকেও খুঁজে পাইনি।

পরিবারের কেউ যখন অসুস্থ হন, তখন সেই পরিবারের কাছে একজন ডাক্তার ঈশ্বরতুল্য। হাসপাতাল তার আস্থার জায়গা। ডাক্তার একটু ভালো করে কথা বলেছেন, ভালো চিকিৎসা করেছেন, এই দেশের সাধারণ মানুষ সেই ডাক্তারকে কখনও ভোলেন না। পারিবারিক আড্ডা থেকে যেকোনো আলাপে আমরা গর্ব করি সেই ডাক্তারকে নিয়ে। কিন্তু যখন ডাক্তার ভুল করেন, এত বড় হাসপাতালে যখন রিপোর্ট বদলে যায় এবং সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা চলে এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেটি স্বীকারও করে না, তখন কার কাছে যাবে মানুষ? সেই দায় কার ওপর বর্তায়?

Comments

The Daily Star  | English

Mob beating at DU: Six students confess involvement

Six students of Dhaka University, who were arrested in connection with killing of 35-year-old Tofazzal Hossain inside their hall on Wednesday, confessed to their involvement in the crime before a magistrate

8h ago