অবাধে চলছে হরিপুরের বন্যপাখির মাংসের রেস্টুরেন্ট
নিজের কর্মজীবনের ১১ বছরে পদার্পণ উদযাপন করতে সহকর্মীদের নিয়ে বুধবার রাতে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর বাজারের একটি রেস্টুরেন্টে 'বালিহাঁস পার্টি' করেছেন সিলেট জেলা পুলিশের কনস্টেবল সানাউল সোহান।
রান্না করা বালিহাঁসের ছবি ও ভোজনরত অবস্থায় নিজেদের ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্টও দেন তিনি। পোস্টে তিনি নিজেই লিখেছেন এটি 'বালিহাঁস পার্টি'। কিন্তু বালিহাঁস একটি পরিযায়ী পাখি, যা শিকার করা, কেনা-বেচা কিংবা খাওয়া আইনত অপরাধ।
কিন্তু হরিপুর বাজারের অন্তত ১০টি রেস্টুরেন্টে অবাধে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী নিষিদ্ধ বন্য ও পরিযায়ী পাখির রান্না করা মাংস। আর এসব রেস্টুরেন্টে নিয়মিত ভিড় করছেন গ্রাহকরা। শুধু সাধারণ মানুষই নয়, জনপ্রতিনিধি ও পুলিশদেরও তাদের গ্রাহক হতে দেখা গেছে বিভিন্ন সময়।
সিলেট শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দুরের হরিপুর বাজারে এই রেস্টুরেন্টগুলো অবস্থিত। ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে হরিপুরের পাখির মাংস লিখে সার্চ দিলে এসব হোটেল-রেস্টুরেন্টে বন্য ও পরিযায়ী পাখির মাংস খাওয়া সংক্রান্ত কয়েকশ পোস্ট ও ভিডিও পাওয়া যায়।
এসব রেস্টুরেন্টে প্রকাশ্যে বন্য ও পরিযায়ী পাখির রান্না করা মাংস বিক্রি হওয়ার বিষয়টি সবাই জানলেও পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদসহ অনেকেই এসব রেস্টুরেন্টের নিয়মিত গ্রাহক হওয়ায় এ নিষিদ্ধ বিক্রি বন্ধে যথাযথ কোনো উদ্যোগ নেই বলে দাবি পরিবেশবাদীদের।
দ্য ডেইলি স্টার ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিলেট সিটি করপোরেশনের ৫ কাউন্সিলরের পাখির মাংস ভোজের ভিডিও ফেসবুকে লাইভ করা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারপর ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন কর্মকর্তার এমন একটি পোস্ট নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
বুধবার রাতে পুলিশ কন্সটেবলদের পরিযায়ী পাখির মাংস খাওয়ার ব্যাপারে কথা বলতে কনস্টেবল সানাউল সোহানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'পাতিহাঁস লিখতে গিয়ে ভুল করে বালিহাঁস লিখে ফেলেছি। সময় ছিল না বলে সংশোধন করতে পারিনি। এখন করে নিচ্ছি।'
আগের ২টি প্রতিবেদনের পর এবং বিভিন্ন সময়ে পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের মুখে এসব রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায় স্থানীয় প্রশাসন ও বন অধিদপ্তর। কিন্তু এসব অভিযানে কঠোর আইনি ব্যবস্থা না নেওয়ায় বন্ধ হচ্ছে না বন্য ও পরিযায়ী পাখি বিক্রি।
সম্প্রতি হরিপুর এলাকায় এসব রেস্টুরেন্টে বন্য ও পরিযায়ী পাখি বিক্রি সরেজমিনে দেখতে যান এ প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সব রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারের কাউন্টারের ওপর সারিবদ্ধভাবে হাঁড়ি ঢাকনা দিয়ে রাখা।
এসব হাঁড়িতে কী আছে জানতে চাইলে ম্যানেজাররা ঢাকনা তুলে ভেতরে রান্না করা মাংসের নাম ও দাম বলেন। সব হাঁড়িতেই মেলে বন্য ও পরিযায়ী পাখির মাংস। ম্যানেজারদের বক্তব্যে জানা যায়, তারা শামুকখোল, বালিহাঁস, কালিম, ডাহুক, কুড়া, বক, ঘুঘু ও পানকৌড়ি বিক্রি করেন। কোনো রেস্টুরেন্টেই মুরগি, হাঁস কিংবা কোয়েল পাখি নেই বলে জানান তারা।
কিছু রেস্টুরেন্টে রান্না করা মাংসের ছবি তুলতে ও ভিডিও করতে চাইলে অনুমতি পাওয়া যায়। ক্যামেরার সামনেই তারা রান্না করা মাংসের পরিচয় দেন। তবে হরিপুরের সবচেয়ে পুরনো 'তারু মিয়া রেস্টুরেন্ট' ভিডিও ধারণের অনুমতি দিলেও ভিডিওতে পাখির মাংসের নাম বলতে রাজি হননি রেস্টুরেন্টটির ম্যানেজার। তবে ভিডিও বন্ধ করার পর তিনি পাখির নাম বলেন, যা এ প্রতিবেদক অডিও হিসেবে ধারণ করেছেন।
রেস্টুরেন্ট সংশ্লিষ্টরা জানান, ৩ দশকের বেশি সময় ধরে হরিপুরে বিক্রি হয় বন্য ও পরিযায়ী পাখির রান্না করা মাংস। এসব রেস্টুরেন্টের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো 'তারু মিয়া রেস্টুরেন্ট' সম্প্রতি প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর উদযাপন করেছে। সিলেট-তামাবিল মহাসড়কে এসব রেস্টুরেন্ট মূলত ট্রাক চালকদের জন্য করে শুরু হলেও ক্রমে সাধারণ মানুষের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে উঠে।
তারু মিয়া রেস্টুরেন্ট ছাড়াও হরিপুরের সোনার বাংলা রেস্টুরেন্ট, ড্রাইভার রেস্টুরেন্ট, শাহজালাল রেস্টুরেন্ট, মা ও বাবার দোয়া রেস্টুরেন্ট, ভাই ভাই রেস্টুরেন্ট, চাচীর দোকান, জনপ্রিয় ড্রাইভার রেস্টুরেন্ট, নিউ ড্রাইভার রেস্টুরেন্ট, স্বাধীন বাংলা রেস্টুরেন্ট ও চুয়াডাঙ্গা রেস্টুরেন্টে বিক্রি হয় পাখির মাংস।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জের বিভিন্ন হাওর, বিল ও পাহাড়ি জঙ্গল থেকে বন্য পাখি ধরে তা সরবরাহ করা হয় এসব রেস্টুরেন্টে। এ ছাড়া, শীতকালে পরিযায়ী পাখি আসার পর সিলেট বিভাগের বিভিন্ন হাওর থেকে জীবিত ধরে বিভিন্ন এলাকায় দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণ করা হয় এবং এসব রেস্টুরেন্টে সারা বছর ধরে সরবরাহ করা হয়।
বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ অনুযায়ী বন্য ও পরিযায়ী পাখি শিকার করা, বিক্রি করা ও খাওয়া অপরাধ এবং এজন্য ৬ মাসের জেল ও সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, 'তারু মিয়া রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর মহাসমারোহে পালন করেছে, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং বন্যপ্রাণী আইনের প্রতি অসম্মানজনক। এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ তাদের গ্রাহক তালিকায় পুলিশ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদরা রয়েছেন, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এসব রেস্টুরেন্ট টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রাখেন।'
পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদের মুখে গত ৬ ফেব্রুয়ারি হরিপুরের তারু মিয়া রেস্টুরেন্টে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালায় স্থানীয় প্রশাসন ও বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল।
এ সময় তারা রেস্টুরেন্টের স্বত্ত্বাধিকারী ওয়াহেদ মিয়াকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা ও নিষিদ্ধ পাখি বিক্রি না করার শর্তে মুচলেকা নেয়। রান্না করা মাংস বন্য ও পরিযায়ী পাখির কি না তা আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হতে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
তবে নমুনা সংগ্রহের ৭ মাস পেরিয়ে গেলেও বন অধিদপ্তরের পরীক্ষাগার থেকে এখনও নমুনা পরীক্ষার ফল পায়নি অভিযান পরিচালনাকারী বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল।
এর আগে গত বছরের ১৯ জুন জৈন্তাপুরের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুসরাত আজমেরী হক এসব রেস্টুরেন্টে অভিযান চালান। কিন্তু রান্না করা পাখির মাংস যে বন্য ও পরিযায়ী পাখির, তা নিশ্চিত হতে না পেরে শুধু মূল্যতালিকা না টাঙানোর অপরাধে ৪টি রেস্টুরেন্টকে ১২ হাজার টাকা জরিমানা করেন।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখনই ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায়, তখনই এসব রেস্টুরেন্ট মালিকরা দাবি করেন যে তারা হাঁস-মুরগির মাংস বিক্রি করেন বন্য পাখি বলে। এ কারণেই বন অধিদপ্তরের ফরেনসিক প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নমুনা সংগ্রহের এতদিন পরেও প্রতিবেদন না আসা হতাশাব্যঞ্জক।'
তিনি আরও বলেন, 'যদি ধরেও নিই, তারা বন্য বা পরিযায়ী পাখি বিক্রি করছেন না, মুরগী-হাঁস রান্না করে বন্য পাখির মাংস বলে বিক্রি করছেন— তবুও তা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে অপরাধ। সে অপরাধেও এসব রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বন্ধ করে দেওয়া যায়। কিন্তু প্রশাসন তা করে না।'
এ ব্যাপারে কথা বলতে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আল-বশিরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমরা তাদেরকে হাতেনাতে ধরতে পারি না বলেই কঠিন আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারি না। কারণ অভিযানের সময় রান্না করা মাংসটা আসলে কোন পাখির তা নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে অনেকেই জানিয়েছেন, তারা বন্য পাখির মাংস বলে মূলত মুরগি বা হাঁস খাওয়ায়। কিন্তু সেটাও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনানুযায়ী অপরাধ।'
জৈন্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. কামাল হোসেন বলেন, 'আমি কখনো এসব রেস্টুরেন্টে যাইনি। কিন্তু জেনেছি, যারা পাখি চেনেন এসব রেস্টুরেন্টে তাদের কাছে বন্য ও পরিযায়ী পাখির রান্না করা মাংস বিক্রি করা হয়। আর যারা চেনেন না, তাদের কাছে হাঁস-মুরগির মাংস বন্য পাখির নামে বিক্রি করা হয়। ২ ক্ষেত্রেই তারা অপরাধ করছে। আমি আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক বৈঠকে উপজেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছি।'
বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, '৬ ফেব্রুয়ারির ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে রেস্টুরেন্টের মালিকরা আমাদের চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, এসব মাংস যে বন্যপাখির তা প্রমাণ করতে। সেখানেই পরীক্ষাগারের ফরেনসিক পরীক্ষার গুরুত্ব। আশা করছি, দ্রুতই এ প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে শক্তভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারব।'
Comments