বেশি দামে গম আমদানি: খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যার প্রতিউত্তর টিআইবির
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব খাদ্যপণ্যের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছিল এটি যেমন সত্য, তেমনি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় ১ আগস্ট থেকে ইউক্রেন গম রপ্তানি শুরু করার পর বিশ্ববাজারে গমের দর বড় আকারে পড়তে শুরু করে, সেটিও সত্য অথচ দর নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় আর্ন্তজাতিক বাজারে দাম কমার ট্রেন্ড কতোটা বিবেচনায় ছিল, তার কোনো ব্যাখ্যা খাদ্য মন্ত্রণালয় দেয়নি বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
আজ মঙ্গলবার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ব্যাখার প্রতিউত্তরে টিআইবি এ কথা জানায়।
এতে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের গমের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে দেওয়া যুক্তি ধোপে টেকে না।
টিআইবি জানায়, বেশি দামে গম আমদানি টিআইবির বিবৃতি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করায় এবং এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া সত্যিই উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্তু মন্ত্রণালয় যৌক্তিক দামে গম কেনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে, যেভাবে টিআইবির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছে, তা সত্যিই হতাশার। একইসাথে, ব্যাখ্যায় গণমাধ্যম ও টিআইবির বিবৃতিতে তোলা অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় গম ক্রয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় গণখাতে ক্রয় আইন লঙ্ঘন করেনি এবং কোনো তৃতীয় পক্ষকে ক্রয় প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেনি বলে গতকাল তাদের ব্যাখ্যায় জানায়।
টিআইবি তার উত্তরে জানায়, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী 'ন্যাশনাল ইলেকট্রনিক বিডি' রাশিয়ার গম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রডিনটর্গের লোকাল এজেন্ট। যাদের গম আমদানিতে প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সেবা নিশ্চিত করার কথা, কিন্তু দাম নির্ধারণ বা এ বিষয়ক সমঝোতায় তাদের ভূমিকা থাকার কথা নয়। কিন্তু খাদ্যসচিবের বক্তব্য অনুযায়ী (১৬ সেপ্টেম্বর, প্রথম আলো) আলোচিত প্রতিষ্ঠানটির দুজন প্রতিনিধি গমের দাম নিয়ে সমঝোতা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এবং সমঝোতায় সহায়তা করেছেন। অথচ জিটুজি ক্রয়সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিপত্রে বলা হয়েছে, দাম নির্ধারণবিষয়ক সরকারি কমিটির সভাপতি হবেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব বা অতিরিক্ত সচিব। সদস্যসচিব থাকবেন একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিব। এ ছাড়া অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের মনোনীত ব্যক্তি থাকবেন, এর বাইরে বেসরকারি তৃতীয় কোনো পক্ষ থাকবে না।
একই সঙ্গে বেশি দামে গম কেনা হচ্ছে তথ্যটি সঠিক নয় জানিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় জানায় ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর আর্ন্তজাতিক বাজার থেকে গম সংগ্রহ অনশ্চিয়তার মধ্যে পড়ে। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে জিটুজি প্রক্রিয়ায় গম সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। প্রতি ক্ষেত্রে গমের দাম ৫০০ ডলারের বেশি হওয়ায়, সরকার সেখান থেকে গম ক্রয়ে আগ্রহী হয়নি।
টিআইবি জানায়, গত ১ আগস্ট থেকে ইউক্রেন গম রপ্তানি শুরু করার পর বিশ্ববাজারে গমের দর বড় আকারে পড়তে শুরু করে। অথচ দর নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় আর্ন্তজাতিক বাজারে দাম কমার ট্রেন্ড কতোটা বিবেচনায় ছিল, তার কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। রাশিয়ার গমের এফওবি মূল্য ৩৩০ মার্কিন ডলার ধরে এরসাথে জাহাজ ভাড়া, লোডিং-আনলোডিং, বার্থঅপারটের হ্যান্ডলিং, ইনস্যুরেন্স ও লাইটেনিংসহ সর্বমোট মূল্য ৪৩০ মার্কিন ডলার নির্ধারণ হয়, যাকে যুক্তিসংগত ও সঠিক বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় দাবি করছে। কিন্তু প্রতিটনে ১শ ডলার ল্যান্ডিং খরচের বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি, সেখানেই মূলত শুভংকরী ফাঁকি। একইসাথে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার গমের দামের যে তুলনা মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় দেওয়া হয়েছে, তাকে কিছুটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে হয়েছে বলে মনে করে টিআইবি। কেননা সারাবিশ্বে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আসা ব্ল্যাক-সি-হুইট মূলত কম দামি গম হিসেবেই খ্যাত। বর্তমান আর্ন্তজাতিক বাজার দরও যার সাক্ষ্য দিচ্ছে।
গমের দাম যাচাই নিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়, গত ১৭ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার গমের এফওবি মূল্য ছিল ৩৩৪.২৫ মার্কিন ডলার। প্রতিনিয়ত গমের এফওবি মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এর যুক্তিতে টিআইবি জানায়, শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডের তথ্য বলছে, ব্ল্যাক-সি-হুইট ৩১০ ডলারে লেনদেন হয়েছে ১৯ সেপ্টেম্বর। একইসাথে, সিএমই গ্রুপের তথ্য বলছে, এই গমের ভবিষ্যত চুক্তি, যেটি ২০২৩ সালে (জুন থেকে আগস্ট সময়কালে) সরবরাহ করা হবে, তার দাম ২৯৬ ডলারে সম্পন্ন হয়েছে।
তাই মন্ত্রণালয়ের গমের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে দেওয়া যুক্তি ধোপে টিকে না বলে জানায় টিআইবি।
একইসাথে টিআইবি জানায়, 'জিটুজিতে কোনো পণ্য ক্রয় করার পূর্বে বাজার যাচাইয়ের বিষয়টি সম্পন্ন না করে, কীভাবে দর ঠিক হলো, তার ব্যাখ্যাও দেয়নি মন্ত্রণালয়। বরং পূর্ববর্তী দুটি ক্রয়মূলের রেফারেন্স টানা হয়েছে, যা এড়িয়ে যাবার শামিল। খাদ্যপণ্যের কেনাকাটায় নিয়মিত আন্তর্জাতিক বাজার এবং সরবরাহকারী সর্ম্পকে খোঁজখবর রাখা জরুরি হলেও, খাদ্য মন্ত্রণালয় যে তা রাখে না, তার বড় প্রমাণ বাড়তি দাম বিবেচনায় প্রডিনটর্গের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশের চুক্তি বাতিলের বিষয়ে তথ্য না থাকা।'
Comments