চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ালেই কি বেকার সমস্যার সমাধান

আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর বয়স ৩০ বছর পার হবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী বাঁধনের (ছদ্মনাম)। তার সরকারি চাকরির বয়স পার হতে বাকি আছে আর মাত্র ১৪ দিন। পড়ালেখা শেষে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা প্রায় শেষ হয়ে এলেও এখন পর্যন্ত কোনো চাকরি তিনি জোগাড় করতে পারেননি। নিজের মতো করে ব্যবসা বা অন্য কিছু করার আর্থিক সামর্থ্যও নেই তার।

এমন পরিস্থিতিতে প্রচণ্ড হতাশা ঘিরে ধরেছে বাঁধনকে। তার প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে তাহলে কী লাভ হলো? যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো ধরনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাই যদি করা না গেল, তাহলে শিক্ষাগত সনদ দিয়েই বা তিনি কী করবেন?

বাঁধন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও সেশন জটের কারণে মাস্টার্স শেষ করে ফল পেয়েছেন ২০১৭ সালে। সব মিলিয়ে প্রায় ৭ বছর তিনি ব্যয় করেছেন উচ্চশিক্ষার পেছনে। এরপর দেশের তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে চাকরির জন্য চেষ্টা শুরু করেও প্রথম ৩ বছরে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো চাকরিই পাননি তিনি।

এর কারণ হিসেবে বাঁধন বলেন, 'ওই সময় যে পরিমাণ চাকরিপ্রার্থী ছিল, সে তুলনায় খুবই কম নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে আগে থেকে যাদের ভালো প্রস্তুতি ছিল তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারিনি। এরপর বিসিএসসহ অন্যান্য চাকরির জন্য মোটামুটি প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর দেশজুড়ে করোনা মহামারি দেখা দিলে খুব বেশি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। এখন মহামারি শেষ আমার চাকরিতে আবেদনের বয়সও শেষ হয়ে যাচ্ছে।'

বাঁধন আরও বলেন, 'সরকারের পক্ষ থেকে করোনার মধ্যে ব্যাকডেটে আবেদনের জন্য কয়েক মাসের সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু করোনা আসার আগে যাদের চাকরিতে আবেদনের বয়স শেষ হয়েছে তারাই কেবল এই সুযোগটি পেয়েছেন। এখন করোনার পর বয়স শেষ হওয়ায় আমরা সে সুযোগ পাচ্ছি না।'

চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে 'চাকরিপ্রত্যাশী যুব প্রজন্ম' এর ব্যানারে গত ৯ আগস্ট রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে ১০ জন আহত হন এবং ১ জনকে আটক করা হয় বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের।

এই আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাজিদ সেতু। আবেদনের বয়সসীমা বাড়িয়ে ৩৫ বছর করা হলেই কি সবাই চাকরি পাবে— এমন প্রশ্নের জবাবে সেতু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সয়সসীমা বাড়ালে সবাই চাকরি পাবে, সেটা আমরা মনে করি না। কিন্তু করনোনাভাইরাস মহামারির কারণে যারা বঞ্চিত হয়েছে, যাদের ভালো প্রস্তুতি থাকার পরও সার্কুলার না থাকায় আবেদন করতে পারেনি, চাকরির পরীক্ষা দিতে পারেননি। তারা অন্তত আবেদন করতে, চাকরির পরীক্ষা দিতে পারবে।'

সেতু আরও বলেন, 'আমরা জানি চাকরি কিংবা বেকার ভাতার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করলে কোনো লাভ হবে না। এ কারণে আমরা আর চাকরি চাচ্ছি না। আমরা অন্তত চাকরিতে আবেদন করার সুযোগ চাচ্ছি। আমার যদি যোগ্যতা থাকে, তাহলে আমি সেই যোগ্যতা দিয়ে চাকরি পাব।'

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সেতু বলেন, 'আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের ৩৩ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে মেধা ও দক্ষতা বিবেচনায় রেখে বাস্তবতার নিরীখে যুক্তিসংগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। করোনা মহামারিতে সবার জীবন থেকে ২ বছর হারিয়ে গেছে। চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এরচেয়ে কঠিন বাস্তবতা আর কি হতে পারে?'

সম্প্রতি অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তারা চাকরি পাবেন না। আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ।

জরিপ অনুসারে, চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ—কোনোকিছুর সঙ্গেই সংশ্লিষ্টতা নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণের।

চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানো হলে সবার বেকার সমস্যার সমাধান হবে কি না, জানতে চাইলে চাকরিপ্রত্যাশী যুব প্রজন্মের আরেক সমন্বয়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'সরকারি চাকরিতে আবেদনের যে বয়সসীমা আছে, তা এখন অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও অনুসরণ করা হচ্ছে। সেখানেও ৩০ বছরের পর আবেদনের তেমন একটা সুযোগ থাকছে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করতেই অনেকের জীবনের ২৫ থেকে ২৭ বছর পার হয়ে যায়।'

তিনি আরও বলেন, 'সরকারি চাকরির জন্য বেশ কয়েক বছরের প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়, অন্যদিকে বেসরকারি চাকরির জন্য লাগে কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা। ফলে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি বা বেসরকারি চাকরির অভিজ্ঞতা অর্জনের আগেই আবেদনের বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে।'

চাকরিপ্রত্যাশী যুব প্রজন্মের সমন্বয়ক সোনিয়া চৌধুরী বলেন, '১৯৯১ সালে শেষবার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয়। তখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। এখন গড় আয়ু ৭৪ বছর ৩ মাস। চাকরি থেকে অবসরের বয়স বাড়িয়ে ৫৯ করা হলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো হয়নি। ফলে চাকরিক্ষেত্রে শূন্যপদের সংখ্যা আরও কমে গেছে।'

সোনিয়া জানান, ভারতে না চাইতেই পরিস্থিতি বিবেচনা করে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কাতেও বয়সসীমা ৩৫, ইউরোপ-আমেরিকায় তো বয়সসীমাই নেই।  তার ভাষ্য,  'চাকরিতে আবেদনের বয়স বাড়ানো হলে সবাই চাকরি পাবে না, বেকার সমস্যার সমাধানও হবে না। কিন্তু যাদের সেই সক্ষমতা আছে তারা ৩০-এর পরেও চেষ্টা করতে পারবে। অনেকে একটু সময় নিয়ে পার্টটাইম কাজের ফাঁকে চাকরির প্রস্তুতি নিতে পারবে। এতে তাদের ওপর মানসিক চাপ কম পড়বে।'

সোনিয়ার ভাষ্য, 'জাতীয় যুবনীতি-২০১৭ অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সের বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক যুব বলে গণ্য হবে। তাহলে একজন যুবক ৩০ পার হওয়ার পর নতুন করে সরকারি চাকরিতে আবেদন করতে পারবে না কেন?'

চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে যে আন্দোলন চলছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে বয়সসীমা বাড়ানোর কোনো সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এইচ এন আশিকুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আপাতত সরকারের এ বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। এখন বয়সসীমা ৩০ আছে। বর্তমানে এমনিতেই বহু বেকার আছে। তাদেরই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না।'

এ সময় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকা বয়সসীমা সংক্রান্ত তথ্য এবং এ বিষয়ে আন্দোলনকারীদের বক্তব্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করলে আশিকুর রহমান বলেন, 'কোনো কিছুতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। সময়-সুযোগ বুঝে সেটা করা হবে। তাছাড়া আমাদের নেত্রী সব সময় বলেন, নিজেদের উদ্যোগী হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে।'

বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলনকারীদের ভাষ্য, ভারতে বিভিন্ন ধরনের চাকরিতে রয়েছে বিভিন্ন বয়সসীমা। যেমন- ব্যাংকে বিভিন্ন ধরনের চাকরিতে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে আবেদন করা যায়। রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে আবেদনের বয়সসীমা ১৮ থেকে ৩৩ বছর, পুলিশে ২১ থেকে ৩৫ বছর।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর কেন- জানতে চাইলে আশিকুর রহমান বলেন, 'তারা (আন্দোলনকারীরা) তাদের যুক্তি দিচ্ছে। আমরা তো চাই কর্মসংস্থান হোক। ৩০ বছরের নিচে চাকরিপ্রার্থী বেকারের সংখ্যা লক্ষাধিক। এর উপরে দিলে (বয়সসীমা বাড়ালে) তো তাদের সমস্যা হবে। সরকারের তো দেখতে হয় বৈশ্বিক দিক। আপাতত এর বেশি আমার জানা নেই।'

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

15h ago