ইভিএম নয়: নির্বাচন কমিশনের প্রতি ৩৯ নাগরিকের আহ্বান

ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)। ছবি: সংগৃহীত

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিষয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক উল্লেখ করে ইভিএম ব্যবহার না করতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ৩৯ নাগরিক।

আজ মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আমরা মনে করি, কমিশনের এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। এটি রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও উসকে দেবে এবং কমিশনের বর্তমান আস্থার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে। আমরা আবারও একটি ব্যর্থ নির্বাচনের কবলে পড়ব, যা জাতি হিসেবে আমাদেরকে চরম সংকটের দিকে ধাবিত করবে।

কমিশনের সিদ্ধান্তের অযৌক্তিকতার একটি কারণ হলো যে, প্রযুক্তিগতভাবে ইভিএম একটি দুর্বল যন্ত্র। এতে 'ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল' (ভিভিপিএটি) নেই, যার ফলে কমিশন ভোটের যে ফলাফল ঘোষণা করবে তা-ই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং এটি পুনঃগণনা বা নিরীক্ষা করার সুযোগ থাকবে না। এ কারণেই কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি। প্রসঙ্গত, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তাদের ইভিএমে ভিভিপিএটি যুক্ত করা হয়। 

প্রযুক্তির কারণে ইভিএম ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতিও করা যায়। বায়োমেট্রিক্সভিত্তিক ইভিএম অনেক ভোটারকেই শনাক্ত করতে পারে না, ফলে কমিশন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদেরকে তাদের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে যন্ত্রটি খুলে দেওয়ার তথা ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা দিয়ে থাকে। যে কোনো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের মতো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমের ফলাফল নিয়েও কারসাজি করা যায়। এছাড়া নির্বাচনের সময়ে মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত কারিগরি টিমও নির্বাচনী ফলাফল বদলে দিতে পারেন। গত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত দুইবার ফলাফল প্রকাশের অভিযোগ উঠেছে, যা কেবল ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমেই সম্ভব। এছাড়াও আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, ইভিএম ব্যবহার করার কারণে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

কমিশনের সিদ্ধান্তের অযৌক্তিকতার আরেকটি কারণ হলো, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক থাকা এবং এ ব্যাপারে ঐকমত্য তৈরি না হওয়া। সম্প্রতি কমিশনের ডাকা সংলাপে যে ২২টি দল ইভিএম নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছে তার মধ্যে ১৪টি দল এটি নিয়ে তাদের সংশয় ও সন্দেহের কথা স্পষ্টভাবেই বলেছে। এর মধ্যে ৯টি দল সরাসরি ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছে। আওয়ামী লীগসহ ৪টি দল ইভিএমে ভোট চেয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ যে ৯টি দল ইসির সংলাপ বর্জন করেছিল, তারাও ইভিএমের বিপক্ষে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেও সংলাপের সময়ে বলেছিলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না। তাই ইভিএমের ওপর অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের এ অবিশ্বাস আমাদের আগামী নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করার পথে একটি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে আমাদের আশঙ্কা।

তৃতীয়ত, একাদশ নির্বাচনের আগে ইভিএম ক্রয়ে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার (৪৫০ মিলিয়ন ডলার) মতো ব্যয় হয়েছে। ১৫০টি ইভিএমে নির্বাচন করতে হলে নতুন মেশিন কেনায় অন্তত অর্ধ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এ ধরনের বিপুল ব্যয় কতটুকু যৌক্তিক তা ভেবে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।

প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও ভোটারদের আস্থাহীনতার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশই এখন ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসছে। প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক উন্নত জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসও ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। পৃথিবীর ১৭৮টির মধ্যে বর্তমানে শুধু ১৩টি দেশ তাদের সব নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করছে।

ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে সিইসি উল্লেখ করেছেন যে, তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত আমলে নেওয়া হয়নি। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ যে গুরুত্বহীন ছিল তা সুস্পষ্ট হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আগামীতে কমিশনের সাথে নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের সংলাপও অর্থহীন হয়ে পড়েছে।

আমরা মনে করি, ইভিএম ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের যে আস্থাহীনতা তা দূর না করেই ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচন নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হবে ও আরেকটি অনাকাক্ষিত বিতর্কের ক্ষেত্র তৈরি করবে। তাই আমরা নিম্নলিখিত স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিবর্গ আমাদের নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।

বিবৃতিতে সই করা ৩৯ নাগরিক হলেন, ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী; ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এমিরেটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; এম হাফিজউদ্দিন খান, অবসরপাপ্ত মহা হিসাব-নিরীক্ষক এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; ড. আকবর আলি খান, অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা; বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ; ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, প্রতিষ্ঠাতা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র; ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার, আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব; ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক; অধ্যাপক পারভীন হাসান, ভাইস চ্যান্সেলর, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি; অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ; ড. শাহদীন মালিক, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, অর্থনীতিবিদ; ড. শহিদুল আলম, আলোকচিত্রশিল্পী, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; ড. আহসান মনসুর, অর্থনীতিবিদ; আবদুল লতিফ মন্ডল, সাবেক সচিব; শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট; প্রকৌশলী বিডি রহমতুল্লাহ, সাবেক মহাপরিচালক, পাওয়ার সেল; সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; আসিফ নজরুল, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, লেখক; লুবনা মরিয়ম, আর্টিস্টিক ডিরেক্টর, সাধনা; স্বপন আদনান, অধ্যাপক ও গবেষক, সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন; শারমিন মুরশিদ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্রতী; ফিরদৌস আজিম, অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়; সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাবেক ব্যাংকার; আবু সাঈদ খান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক; কামাল আহমেদ, সাংবাদিক; জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ; নূর খান লিটন, মানবাধিকারকর্মী; শিরিন হক, সদস্য, নারীপক্ষ; ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক; সাইফুর রহমান, সাবেক জ্যেষ্ঠ তথ্য প্রযুক্তিবিদ, অস্ট্রেলিয়ান পাবলিক সার্ভিস; ফারুক ফয়সাল, আঞ্চলিক পরিচালক, আর্টিকেল ১৯; সঞ্জীব দ্রং, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম; সালমা আলী, সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি; ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ, অধ্যাপক, মোনাশ ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া ও ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, সিনিয়র সফটওয়্যার সল্যুশন আর্কিটেক্ট।

 

 

Comments

The Daily Star  | English

Enforced disappearances: Eight secret detention centres discovered

The commission raised concerns about "attempts to destroy evidence" linked to these secret cells

3h ago