শিশুর বলার মতো কোনো কথা নেই, গল্প নেই
'পৃথিবীতে সকল অমঙ্গলের কারণ হলো এটাই যে, মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারে না'। কথাটি বলেছেন মনোবিদ কার্ল গুস্তাভ জং। আমরাও এখন এমন জাতিতে পরিণত হয়েছি যারা কথা বলার জন্য ভাষা জানে, গণিত শিখে, পদার্থ বিজ্ঞান শিখে, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শিখে, কিন্তু তাদের মনে বলার মতো কোনো কথা নেই, বলার মতো কোনো গল্প নেই। আছে শুধু নিজের ইন্দ্রিয় উপভোগ, সম্পদ আহরণ বা অভাব-অভিযোগের বিষয়। কিন্তু, আমরা কি এমনটা ছিলাম?
উত্তরাঞ্চলের একটি গ্রামের স্কুলে আব্বারা পড়াশোনা করতেন। তার ভাইরা বিভিন্ন ক্লাসে ছিল। যেদিন পরীক্ষার ফল বের হতো, সেদিন আব্বার জ্যাঠা মানে বড় চাচা, যিনি নিজে একজন বিচারক ছিলেন, সবার উদ্দেশ্যে বলতেন, 'যে যাই ফল করেন না ক্যানে, ঘরের ছাওয়াল ঘরোত ফিরি আইসেন। মনখারাপ করি অথবা ভয়ত এদি-সেদি চলি যান না।' অর্থাৎ, রেজাল্ট যাই হোক, বাসায় ফিরে এসো। মনখারাপ করে বা ভয়ে এদিক সেদিক চলে যেও না।
সেই একই তরিকা ধরে আমাদেরও বড় করা হয়েছে। পড়াশোনা খুব জরুরি। কিন্তু, এত জরুরি নয় যে সন্তানের ওপর চাপ দিতে হবে। তবে হ্যাঁ, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হলে, উপার্জন করতে হলে পড়াশোনা ছাড়া আর তেমন কোনো উপায় ছিল না বলে এর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশে উচ্চশিক্ষাই সব, এই ধারণা থেকে মানুষ সরে এসেছে বহু আগে। কিন্তু, আমরা এখনো সেই চাপ থেকে বের হতে পারছি না। পারছি না বাবা-মা ও অভিভাবকের অস্বাভাবিক প্রত্যাশাকে কমিয়ে আনতে, পারছি না মেধাতালিকায় স্থান পেতে বা ভালো স্কুল-কলেজে ভর্তির দৌড় বন্ধ করতে। ফলে আমাদের সন্তানদের ভয়াবহ একটা প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। সেই প্রতিযোগিতা ও চাপ এতটাই বেশি যে অনেক সময় বাচ্চারা তা মেনে নিতে পারে না।
হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্রী পারপিতা ফাইহা, দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় উচ্চতর গণিতে ফেল করায় বাবার মারধরের ভয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে তাকে। নরসিংদীর স্কুলের অষ্টম শ্রেণির প্রভা আক্তার বাজার থেকে ইঁদুর মারার বিষ কিনে সেটা খেয়ে সরাসরি থানায় গিয়ে তার এক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে তাকে মারার অভিযোগ করেছে। পরে মেয়েটিকে আর বাঁচানো যায়নি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সে পড়া মেয়েটি বাবার ওপর রাগ করে আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ আছে।
এ ছাড়াও, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে না পেরে প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী পরপর আত্মহত্যা করল। তাদের চলে যাওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকলেও, মূল কারণ কিন্তু একটাই— সেটা হচ্ছে চাপ, বিষণ্ণতা ও হতাশা, যা তারা বহন করতে পারেনি।
এসব ঘটনায় প্রকাশিত সংবাদের নিচে বহুজন বহু মন্তব্য করেছেন। অধিকাংশই মনে করেন, সন্তানরা বেশি বেশি অভিমানী হয়ে উঠেছে। তারা শাসন করা একদম পছন্দ করে না। কেউ শাসন করলেই বেয়াদবি করে, উল্টাপাল্টা কথা বলে এবং একপর্যায়ে আত্মহত্যা করে বসে। অভিভাবকদের অনেকেই মনে করছেন, সন্তানরা বাড়াবাড়ি করছে।
কিন্তু, অভিভাবকরা কি একবারও ভাবছি শিশুর ওপর কতটা চাপ দিচ্ছি আমরা? সন্তানকে কীভাবে প্রতিযোগিতার বাজারে ঢুকিয়ে দিচ্ছি? তাকে বিনোদনের জন্য একমাত্র মোবাইল বা ভিডিও গেম ছাড়া আর কিছু দিতে পারছি না? সৎ হওয়ার জন্য আদর্শিক কোনো মডেল দাঁড় করাতে পারছি?
সন্তানকে একক পরিবারে বড় করে স্বার্থপর ও একাকী করে তুলছি। সবচেয়ে বড় কথা সন্তানকে নিরাপত্তা দিতে পারছি না ঘরে কিংবা বাইরে। একটা বয়সে এসে যখন শিশু-কিশোরদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দেখার সময়, তখন আমরা শুধু তাদের ঘাড়ে বই-প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি। সন্তানদের পাশে যখন, যেভাবে থাকা দরকার, আমরা কি পারছি সেভাবে থাকতে?
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও ইনসিডিন বাংলাদেশের 'ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট চিলড্রেন অ্যান্ড দেয়ার ভালনারেবিলিটি' শীর্ষক গবেষণায় দেখিয়েছে, একটি পরিবার শিশুর কাছে সবচেয়ে 'নিরাপদ স্থান' হওয়ার কথা থাকলেও, বাস্তবে তা হচ্ছে না। গৃহেই শতকরা ৯৫ ভাগ শিশু কোনো না কোনো সময় সহিংসতার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে শারীরিক, মানসিক, যৌন— সব ধরনের নিপীড়নই রয়েছে।
গৃহে শতকরা ৮৬ জন শিশু নানাভাবে নিপীড়িত হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হয় শতকরা ৮২ জন। শিশুরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে এই অত্যাচারকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। এরমধ্যে বকাবকি, চড়-থাপ্পড়, মারপিট— সব আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ইমোশনাল টর্চারসহ, মারপিট ও যৌন হয়রানি করা হয়। উত্তরদাতা শিশুদের বয়স ৫ থেকে ১৭ বছর। এরা গ্রাম ও শহরে থাকা শিশু। যদি ধরেও নেই শিশুরা বাড়িয়ে বলছে, তাও তো মনে করতে হবে যা বলছে, এর অনেকটাই সত্যি।
সন্তান প্রতিপালনে আমাদের কৌশল পাল্টাতে হবে। মারধোর, শাসন ও ভালোবাসার মধ্যে ভারসাম্য আনতে না পারলে সন্তানকে হারাতে হবে। বিপদে তাদের পাশে থাকতে হবে। কোনো অপরাধের জন্য কাউকে ধিক্কার জানানোর মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। নিজেদের অপ্রাপ্তি সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কেউ যদি বিষণ্ণতায় ভোগে, তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। সময়মতো কারো পাশে দাঁড়ালে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে একজন মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
অনেক পরিবার বুঝতেই পারে না বা বুঝতে চায় না বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে কেন শিশু-কিশোর-যুব সমাজ বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। জানে না সিচুয়েশনাল অথবা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের কথা, জানে না বাইপোলার, সিজোফ্রেনিয়া ও বর্ডার লাইন ডিজিজ কী। আমাদের যে সন্তানরা আত্মহত্যা করছে, সে আসলে নিজে বাঁচার উপায় হিসেবেই স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নেয়। তবে হ্যাঁ, একেকজনের কারণ থাকে একেকরকম। বিষণ্ণতা থেকে আবেগ তৈরি হয়, আশা চলে যায়, অন্য কোনো উপায় খুঁজে পায় না মানুষ। তখন একমাত্র উপায় হয় নিজের জীবন শেষ করে দেওয়া।
উনিশ শতকের খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানী এমিল ড্যুরখেইমের তত্ত্ব অনুযায়ী আত্মহত্যা একটি সামাজিক ঘটনা। এর কারণ নিহিত থাকে সমাজের মধ্যেই। আত্মহত্যার ৪টি ধরন চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। আত্মকেন্দ্রিক, পরার্থমূলক, নৈরাজ্যমূলক ও নিয়তিবাদী।
এরমধ্যে আত্মকেন্দ্রিক আত্মহত্যার ঘটনাই সবচেয়ে বেশি ঘটে, যে ঘটনার সূত্র ধরে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনাগুলোকে আলোচনা করা যায়। এক্ষেত্রে পরিবার ও পারিপার্শ্বিক সমাজের সঙ্গে সন্তানের বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাদের প্রতি যত্ন-ভালোবাসা কমে যাচ্ছে, শাস্তির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়াটা অপরাধ, ভালো স্কুল-কলেজে ভর্তি হতে না পারাটা চরম ব্যর্থতা, নাচে-গানে-খেলায় চৌকস হতে না পারাটা দুর্বলতা, ভালো চাকরি করতে না পারাটা দুর্ভাগ্য— এমন সব ধারণা গড়ে উঠলে শিশু-কিশোর-যুবকরা তখন আর জীবনের মানে খুঁজে পায় না।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোটাই ফলাফল ও মুখস্থ বিদ্যাকেন্দ্রিক। পরীক্ষার নম্বর, রোল নম্বর, জিপিএ— এগুলো নিয়েই আলোচনা। সন্তান কতটা মনুষ্যবোধ নিয়ে গড়ে উঠছে, তা নিয়ে অভিভাবকরা চিন্তিত নন। স্কুলগুলোরও একমাত্র লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ প্রয়োগ, ভালো রেজাল্ট, কোচিং-বাণিজ্য এসব। মুখস্থ করে শুধু উগড়ে দিলেই হলো!
একটি লেখায় পড়েছি, ভাষাবিদ নোয়াম চমস্কির একটি তত্ত্ব সম্পর্কে। সেই তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কথা বলতে পারে। কারণ ভাষার ক্ষমতা মানুষের মস্তিষ্কের ভৌত ক্ষমতা। ভাষার ক্ষমতা মানুষের মস্তিষ্কের কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ নয়। চমস্কির তত্ত্ব অনুসারে আমাদের রক্ত পাম্পের জন্য যেমন হার্ট, শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য লাং আছে, ভাষার জন্যও মস্তিষ্কে সেরকম একটি অঙ্গ আছে, যেটি মানুষ ছাড়া কারও নেই। তাই আর কোনো প্রাণীর পক্ষে ভাষার ব্যবহার সম্ভব নয়।
চমস্কির এই তত্ত্বটি অনেক ভাষাবিদ, জীববিদ ও মনোবিদ মানেন না এবং এটি নিয়ে পুরো বিজ্ঞানী জগত ২ ভাগে বিভক্ত, যার মধ্যে চমস্কিপন্থিদের সংখ্যা কম। চমস্কি বিরোধীদের বক্তব্য হলো মানুষ ও গ্রেট এইপরা জিনগতভাবে খুবই কাছাকাছি এবং শেখালে তারাও ভাষা রপ্ত করতে পারবে। তাদের ধারণা তফাৎটা শিক্ষা-সাংস্কৃতিক।
আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকিয়াট্রি ও সাইকোলজির অধ্যাপক হার্বাট এস টেরেসের নেতৃত্বে ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি একটি প্রকল্প নেওয়া হয় 'প্রজেক্ট নিম' নামে। এতে নিম নামের একটি শিশু শিম্পাঞ্জিকে সমবয়স্ক মানব শিশুদের সঙ্গে একই পরিবারে বড় করে একইসঙ্গে তাকে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখানো হলো তার সঙ্গে কথা বলার জন্য।
শিম্পাঞ্জিটির নাম দেওয়া হয় নিম চিম্পস্কি। তখনকার একটি মার্কিন পরিবারের আরও ২টি শিশুর সঙ্গে নিম বড় হতে থাকে গবেষক ও সাইন ল্যাংগুয়েজ প্রশিক্ষকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে। ১২ বছর ওই পরিবারের সঙ্গে থেকে ১২৫টি সাইন ল্যাংগুয়েজ ভোকাবুলারি শেখে নিম। কিন্তু, সেগুলো ব্যবহার করে নিজের কোনো বক্তব্য বলার ছিল না নিমের। সে শুধু নিজের চাহিদার সংকেত দিতে পারত, যেমন কলা চাই, খেলতে চাই, খাবার চাই অর্থাৎ নিজের শারীরিক চাহিদা-অভিযোগ ছাড়া নিমের আর কোনো বক্তব্য নাই। 'নিম হ্যাজ নো স্টেটমেন্ট টু কমিউনিকেট' বা 'নিমের বলার কিছুই নেই' এটাই ছিল গবেষণার শেষ ফলাফল। অর্থাৎ কথা বলার জন্য ভাষা জানলেও নিমের কোনো কথা নেই। সে শুধু নিজের ইন্দ্রিয় উপভোগ বা অভাব-অভিযোগের কথা বলতে পারত।
যথারীতি টেরেসের গবেষণা ব্যর্থ হয়। মানব শিশু যখন ইশারা করতে শেখে বা কথাও বলতে শেখে, তখনো তার কোনো বক্তব্য বা বলার কিছু থাকে না। সে শুধু নিজের প্রয়োজনটা জানায়, ইচ্ছাটা জানায় বা অনিচ্ছা কিংবা কষ্টটা জানায়।
কোনো কিছু সম্পর্কে মানুষের ভ্যালিড বক্তব্য বা স্টেটমেন্ট তৈরি হয় মানুষের ব্যক্তিত্ব তৈরি হওয়ার পর। সেই বক্তব্য সামগ্রিক বা ইউনিভার্সাল হয় মানুষের বিবেক বা বিচারবুদ্ধি তৈরি হওয়ার পর। খ্যাতনামা মনোবিদ কার্লের বক্তব্য হচ্ছে 'মনে কষ্ট ছাড়া কারও মনে বিবেক তৈরি হয় না।'
টেরেসের গবেষণা প্রমাণ করে যে ১২৫টি সাইন ল্যাংগুয়েজ জানার পরেও নিমের জীবনে কোনো গল্প নেই, তাই তার বলার কিছু নেই। তার আছে একমাত্র ক্ষুধা, যৌনতা আর খেলার ইচ্ছা, যেগুলো সবই তার ইন্দ্রিয় আনন্দের ইচ্ছা বা যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ।
সময় এসেছে চিন্তা করার যে আমাদের সন্তানদের অবস্থাও কি আমরা নিমের মতো করে তুলছি? তাদের নিজেদের মনের ভাব প্রকাশে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। সারাক্ষণ আছে নিজেদের নিয়ে। অন্যের জীবনের পাশে দাঁড়ানোর মতো কোনো ইচ্ছাও নেই তাদের।
আসলে মানুষের মনে বলার ইচ্ছা বা গল্প নেই তা নয়, বর্তমানে সমাজের নানামুখী চাপ বিশেষ করে সন্তানের ওপর প্রতিযোগিতার চাপ শিশু অবস্থাতেই দমন করে দিচ্ছে মানুষের সব গল্প বলার ইচ্ছে। এটিই আমাদের সন্তানদের অনেককেই চরমভাবে অসুখী করে তুলছে।
শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments