‘ছোট থেকে বড় হয়ে গেছি বলতে বলতে, প্লিজ পাপাকে ফিরিয়ে দিন’

বিএনপি
আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির মানববন্ধনে বক্তব্য দিচ্ছেন মির্জা ফখরুল। ছবি: সংগৃহীত

'আমার বাবাকে ওরা নিয়ে গেছে। আমি বাবাকে একবারও দেখিনি। বাবাকে দেখতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দেখতে পাই না।' 

কথাগুলো 'গুম' হওয়া বংশাল থানা ছাত্রদলের সভাপতি মো. সোহেলের ছোট্ট মেয়ে সাফার।

আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে সে এসেছিল বিএনপির মানববন্ধনে অংশ নিতে। রাজধানীর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আজ মঙ্গলবার দুপুরে এই মানববন্ধনের আয়োজন করে বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ শাখা।

সেসময় একটি চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে বাবাকে কাছে না পাওয়ার করুণ বেদনার কথা তুলে ধরে সে। বাবাকে ফিরে পাওয়ার তীব্র আকুতি জানায়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাফা বলে, 'আমি যখন স্কুলে যাই, তখন দেখি আমার বন্ধুরা তাদের বাবার সঙ্গে আসে। আমাকে জিজ্ঞেস করে- তোমার বাবা আসে না কেন? আমি তখন কিছু বলতে পারি না।'

'আমার একটাই দাবি, বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই', বলে সে।

সাফার মতোই মানববন্ধনে যোগ দিতে এসেছিল আরেক হতভাগা শিশু হৃদি। সে-ও 'গুম' হওয়া পল্টন থানা ছাত্রদলের সভাপতি পারভেজ রেজার মেয়ে।

হৃদি বলে, 'আমি ছোট থেকে বড় হয়ে গেছি বলতে বলতে। প্লিজ আপনারা আমার পাপাকে ফিরিয়ে দিন।'

এসময় অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। বলতে থাকে, 'কত বার বলেছি, আমি পাপার সঙ্গে ঘুরতে চাই। কিন্তু পারি না। আমার কষ্ট লাগে। কিছুই ভালো লাগে না। প্লিজ আমার পাপাকে ফিরিয়ে দিন। পাপা কবে আসবে, কেউ কিচ্ছু বলে না।'

বাবার জন্য এই ২ শিশুর হাহাকার শুনে সেসময় আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারেননি। প্রকাশ্যেই কান্না করেন। সেসময় বার বার তাকে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে দেখা যায়।

সাফা ও হৃদির কান্না-আকুতি মহাসচিব ছাড়াও মানববন্ধনে উপস্থিত বিএনপির নেতা-কর্মীদের বেশ নাড়া দেয়। সেসময় নয়াপল্টনে তৈরি হয় আবেগঘন পরিস্থিতি।

সাফা ও হৃদি ছাড়াও মানববন্ধনে 'গুম' হওয়া ছাত্রদলের সাইফুর রহমান সজীবের বাবা শফিকুর রহমান, সেলিম রেজা পিন্টুর বোন নদী ও সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম তুলি তাদের মনের কষ্ট তুলে ধরেন।

সেসময় মির্জা ফখরুল বলেন, 'যাদেরকে গুম করা হয়েছে, তাদের অপরাধ কী ছিল? তাদের অপরাধ ছিল একটাই- স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে তাদের অধিকার নিয়ে বাস করতে চেয়েছিল। আজ এই আওয়ামী লীগ সরকার, শেখ হাসিনার সরকার গত ১৫ বছর ধরে আমাদের সেই অধিকারগুলো কেড়ে নিয়েছে।'

তিনি বলেন, 'আমি যখন এই অনুষ্ঠানের জন্য বের হচ্ছি, তখন দক্ষিণখানের মুন্নার মা আমাকে ফোন করেছিলেন। মুন্না ছাত্রদল নেতা ছিল। তার বাবা একটি ওষুধের দোকান চালাতেন। মুন্না ওই ওষুধের দোকান দেখাশুনা করতো। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে একদিন হঠাৎ করে তাকে সেখান থেকে সাদা পোশাক পরিহিত র‌্যাব সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়।'

'এরপর তার বাবা একবছর ধরে সারাদেশে ছেলেকে খুঁজেছেন, ভারতে গেছেন, কলকাতায় গেছেন, সবখানে খুঁজেছেন। কিন্তু কোথাও পাননি। অবশেষে নিজে লিভার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। আজ মুন্নার মা এখানে বসে আছেন। তাকে এখন দেখার কেউ নেই', যোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।

গুম-খুনের শিকার পরিবারগুলোর উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, 'আজ গুম হওয়াদের পরিবারের যারা এখানে এসেছে, তাদের প্রতি আন্তরিক সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। একটা কথা পরিষ্কার বলতে চাই, তোমরা একা নও, তোমাদের সঙ্গে সারাদেশের মানুষ আছে, তোমাদের জন্য সারাদেশের মানুষ লড়াই করবে।'

'আজ আমাদের এই সন্তানদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, তাদের বাবা-ভাই-ছেলেকে ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের আরও বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে', বলেন তিনি।

মানববন্ধনে দলের গুম হওয়া শতাধিক ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন। ফকিরেরপুল থেকে কাকরাইলের নাইটিংগেল মোড় পর্যন্ত রাস্তার একপাশে হাজার হাজার নেতা-কর্মী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।

গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক নিপীড়ন বন্ধের দাবি জানিয়ে বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড বহন করেন। এ ছাড়াও, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার দৃশ্য অভিনয় করেও প্রদর্শন করেন তারা।

মানববন্ধনে ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্যসচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল আলম মজনুর পরিচালনায় মানববন্ধনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবং মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ বক্তব্য রাখেন।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

16h ago