স্পটিফাই বনাম সাউন্ডক্লাউড: মূলধারা বনাম স্বাধীনধারা

মানুষ কীভাবে গান শুনবে, সংরক্ষণ করবে ও বাণিজ্যিকীকরণ করবে- সেই প্রশ্নের উত্তরে বিবর্তনের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে। যন্ত্রে সংরক্ষিত গান শোনার শুরুটা ফোনোগ্রাফের (পরবর্তীতে গ্রামোফোন হিসেবে পরিচিত) হাত ধরে।

বিবর্তনের ধারা মেনে এটি ছড়িয়েছে রেডিও, ক্যাসেট প্লেয়ার, সিডি প্লেয়ার, আইপডসহ বহু মাধ্যমে। অন্তহীন এই রিলে রেসের ব্যাটন এই সময়ে এসে পৌঁছেছে মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর হাতে।  

যুগের পরিবর্তনে আমরা দেখতে পাচ্ছি সংগীতশিল্পী এবং রেকর্ড কোম্পানিগুলো গান প্রকাশের ক্ষেত্রে ঝুঁকছে স্পটিফাই, অ্যাপল মিউজিক, অ্যামাজন মিউজিক, সাউন্ডক্লাউডের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে।

মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলোকে সংগীতের ভবিষ্যত মেনেই একটি প্রশ্ন এই সময়ে বেশ জোরেশোরে উঠছে৷ মুক্ত বাণিজ্য এবং মুক্ত কন্টেন্টের এই সময়ে যে কেউ সংগীতচর্চা করতে পারলেও সবাই কি তাদের গান প্রকাশের জন্য সমান সুযোগ পাচ্ছে?

ঠিক এখানেই আমরা স্পটিফাই এবং সাউন্ডক্লাউডের মতো দুটি ভিন্ন ধারার প্রতিনিধিত্ব করা সংগীত প্ল্যাটফর্মের দেখা পাই। প্রথমটি রেকর্ড-লেবেল কোম্পানি নির্ভর, দ্বিতীয়টি শিল্পী নির্ভর।

বিভিন্ন নিরিখে স্পটিফাই এবং সাউন্ডক্লাউডের একটি তুলনামূলক আলোচনা টানা যাক।

স্পটিফাই ও সাউন্ডক্লাউড

এ যুগের সংগীত সমঝদার অথচ স্পটিফাইয়ের নাম শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুরূহ। ইন্টারনেটের কল্যাণে আগে থেকেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা প্ল্যাটফর্মটি গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে। বলা বাহুল্য, শুরু থেকেই শহরভিত্তিক শ্রোতাদের কাছে গান শোনবার প্রথম ও প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে সুইডিশ এই প্ল্যাটফরম।

সুইডেন থেকে উঠে আসা আরেকটি সংগীত প্ল্যাটফরম সাউন্ডক্লাউড। বাংলাদেশে সাউন্ডক্লাউডের যাত্রা শুরু স্পটিফাইয়েরও বহু আগে। তবু সাধারণ শ্রোতাদের কাছে সাউন্ডক্লাউড অতটা জনপ্রিয়তা পায়নি। সাউন্ডক্লাউডকে অনেকেই তথাকথিত মূলধারার সংগীত প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আখ্যা দিতে নারাজ।

মূলধারা বনাম স্বাধীনধারা

স্পটিফাইয়ের মতো মূলধারার মিউজিক স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরমগুলোতে শিল্পীদের নিজস্ব সংগীত আপলোড করবার কোনো সুযোগ নেই। তাদের কোনো এক রেকর্ড লেবেল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিজ কন্টেন্ট প্রকাশ করতে হয়।

এতে করে দেখা যায় স্ট্রিমিং থেকে পাওয়া অধিকাংশ অর্থই চলে যাচ্ছে রেকর্ড কোম্পানির পকেটে। প্রথিতযশা শিল্পীরা তবু কিছু সম্মানী পায়, কিন্তু উঠতি তরুণ শিল্পীদের ভাগ্যে অনেকসময় সেটিও জোটে না।

বিজনেস ইনসাইডারের তথ্যমতে, স্পটিফাইয়ে কোনো গান একবার শোনা হলে জনপ্রিয়তা ভেদে শিল্পীরা ০.০০৩৩ থেকে ০.০০৫৪ ডলার আয় করে থাকেন।

চলতি বছরের মার্চে স্পটিফাইয়ের শিল্পী বিরোধী পারিশ্রমিক নীতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলসে রাস্তায় নামেন গীতিকাররা। টেইলর সুইফটসহ অনেক বিখ্যাত গায়কই বিভিন্ন সময়ে স্পটিফাইয়ের নীতিমালার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

অপরদিকে সাউন্ডক্লাউডে গান প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো তৃতীয় মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা নেই। শিল্পী এখানে নিজেই তার গান আপলোড করতে পারেন। শ্রোতারাও বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে বিনামূল্যে সেই গান উপভোগ করতে পারেন। যার ফলে সাউন্ডক্লাউডে নিরীক্ষাধর্মী, তুলনামূলক কম জনপ্রিয় অথচ মানে দুর্দান্ত, বিচিত্র জনরার গানের আধিক্য দেখা যায়। স্পটিফাইয়ে সেটি সম্ভব নয়। কেননা, বহু রেকর্ড কোম্পানি হয়তো তেমন গান অনুমোদনই করবে না৷

এটি ঠিক যে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সাউন্ডক্লাউড থেকে শিল্পীর আয়ের কোনো সুযোগ নেই। তবে যেটি রয়েছে, তা হলো নিজ শিল্প নিজের মতো করে প্রকাশের সুযোগ।

সাবস্ক্রিপশন মডেল এবং ব্যবহারের অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশে স্পটিফাই ফ্রিমিয়াম মডেলে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ এখানে অর্থের বিনিময়ে সংগীত শোনার 'প্রিমিয়াম' ব্যবস্থা যেমন রয়েছে, বহু ট্র‍্যাক বিনামূল্যে উপভোগের সুযোগও রয়েছে। প্যাকেজভেদে স্পটিফাই ১০ থেকে ৩১৯ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ছাড় রয়েছে।

স্পটিফাইয়ের প্রিমিয়াম সার্ভিসে বিজ্ঞাপন নেই, জনপ্রিয় সব পডকাস্টের গ্রাহক হওয়া যায়, এমনকি গান ও পডকাস্ট ডাউনলোড করে অফলাইনেও শোনা যায়।

অন্যদিকে সাউন্ডক্লাউডে এসবই ফ্রি। সাউন্ডক্লাউড গো এবং সাউন্ডক্লাউড গো প্লাস নামে প্ল্যাটফরমটির দুটি প্রিমিয়াম সেবা থাকলেও বাংলাদেশ থেকে সেগুলো ব্যবহার করা যায় না।

স্পটিফাইয়ের গানগুলোয় সাধারণত লিরিক লেখা থাকে, এটি সাউন্ডক্লাউডে নেই। তবে সাউন্ডক্লাউডে যা রয়েছে, তা হলো গানের কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তে মন্তব্য করবার সুযোগ, যা পরবর্তীতে অন্য শ্রোতারা দেখতে পাবে।

দুটি প্ল্যাটফরমেই রয়েছে নিজ পছন্দানুযায়ী গানের তালিকা তৈরি করবার সুযোগ। 

কন্টেন্ট এবং ব্যবহারকারী সংখ্যা

মূলধারার সংগীতের বাহক হিসেবে স্পটিফাইয়ের ব্যবহারকারী সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৪৩ কোটি ৩ লাখের বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে যার মধ্যে ১৮ কোটি ৮ লাখ ব্যবহারকারীই তাদের প্রিমিয়াম সেবার আওতাভুক্ত। তাদের সংগ্রহে প্রায় ৮ কোটি ট্র‍্যাক রয়েছে।

অন্যদিকে সাউন্ডক্লাউড যেহেতু সকল ধারার সংগীত এবং শিল্পীকেই স্থান দেয়, এর সংগ্রহে তাই গানও তুলনামূলক বেশি। প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি ট্র‍্যাক রয়েছে প্ল্যাটফরমটির ভাণ্ডারে। এটি ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি।

বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র 'মাটির ময়না'। তারেক মাসুদ পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটিতে 'শেরে খোদা' নামে একটি গান ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে ইউটিউব ছাড়া গানটি অন্য কোথাও খুঁজতে গেলে স্পটিফাইয়ে নয়, পাওয়া যাবে সাউন্ডক্লাউডে।

আবার হালে জনপ্রিয়তা পাওয়া কলকাতার গান 'কিচ্ছু চাইনি আমি'কে তার আদি ও অকৃত্রিম রূপে পেতে হলে যেতে হবে সাউন্ডক্লাউডে। সেখানে গানটির শিরোনাম- 'রাজকুমারীর গান'।

অর্থাৎ স্পটিফাই যেখানে রেকর্ড কোম্পানি নির্ভরশিল্পে বিশ্বাসী, সাউন্ডক্লাউড সেখানে কন্টেন্টের বৈচিত্র‍্যে বিশ্বাসী। তবে এটাও ঠিক যে সাউন্ডক্লাউডের এই মডেল সংগীত পাইরেসির শঙ্কা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। 

সবশেষে বলা যায়, স্পটিফাই হলো ছেঁকে তোলা মুক্তো, অন্যদিকে সাউন্ডক্লাউড হলো ছাইয়ের মতো, যেখানে বহু অমূল্য রতন ছড়িয়ে রয়েছে, যার খোঁজ হয়তো এখনো বহু শ্রোতা জানেনই না।

 

 

তথ্যসূত্র: স্পটিফাই ওয়েবসাইট, সাউন্ডক্লাউড ওয়েবসাইট, ভ্যারাইটি, বিজনেস ইনসাইডার, স্ট্যাটিস্টা, মিউজিশিয়ান ওয়েভ।

Comments

The Daily Star  | English

Drug sales growth slows amid high inflation

Sales growth of drugs slowed down in fiscal year 2023-24 ending last June, which could be an effect of high inflationary pressure prevailing in the country over the last two years.

17h ago