মাহবুব তালুকদার: একের ভেতর অনেক

মাহবুব তালুকদার

একাত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালীন ভারতে গিয়ে প্রবাসী সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছিলেন। মাহবুব তালুকদার ২০১৭ সালে যখন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেন, দেশের চলমান নির্বাচনী ব্যবস্থার গলদ তখন সবার কাছেই স্পষ্ট ছিল। কিন্তু এ নিয়ে কথা বলার সাহস দেখাতে পারেননি কেউই। এ অবস্থায় তার কল্যাণেই মানুষ দেশের নির্বাচনে প্রাতিষ্ঠানিক অনেক ফাঁকফোকরের কথা জানতে পারে।

এই গলদের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছেন, কাজ করেছেন। সফল না হলেও শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করেছেন। 

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সদস্য মাহবুব তালুকদার বিভিন্ন বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন। ইভিএমসহ বিভিন্ন বিষয়ে একাই কমিশনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। 

ইভিএম নিয়ে বিরোধিতা করে 'নোট অব ডিসেন্ট' দেওয়া থেকে শুরু করে কমিশন সভা বর্জন করার ঘটনাও ঘটিয়েছেন মাহবুব তালুকদার।

সাংবিধানিক পদে থেকে বৃহৎ শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে অনেক সময়ই অনেক সত্য কথা বলা যায় না। এক্ষেত্রে মাহবুব তালুকদার ছিলেন ব্যতিক্রম। 

নির্বাচন নিয়ে মাহবুব তালুকদারের জমানো আরও অনেক কথা নিয়ে তিনি রচনা করেছিলেন 'নির্বাচননামা' ১ হাজার ২০০ পৃষ্ঠার একটি বৃহৎ গ্রন্থ। কিন্তু হয়তো বিদ্যমান পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় নিয়ে বেঁচে থাকা অবস্থায় তা প্রকাশে বিরত ছিলেন তিনি। এ ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, বইটি তার মৃত্যুর আগে প্রকাশ করা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন না। 

এমন অনেক কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে মাহবুব তালুকদারকে 'বিএনপির মনোনীত' হিসেবে দেখে এসেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। বিভিন্ন সময়ে তার সমালোচনায় মুখর হতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী ও শীর্ষ নেতাকে। অথচ তিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও কাজ করেছেন।

আবার কেবল আমলা হিসেবেই নয়, লেখক ও কবি হিসেবেও খ্যাত ছিলেন মাহবুব তালুকদার।

খ্যাতনামা প্রকাশনা সংস্থা দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ, কাব্যগ্রন্থ, শিশুসাহিত্য, ছড়ার বই ও ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে মাহবুব তালুকদারের বইয়ের সংখ্যা ৪৮। ২০১২ সালে তিনি লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরষ্কার।

মাহবুব তালুকদারের রচিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হলো 'বঙ্গভবনে পাঁচ বছর', 'আমলার আমলনামা', 'বধ্যভূমি', 'চার রাজাকার', 'সুপ্রভাত আমেরিকা', 'কবিতাসমগ্র', ইত্যাদি।

নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, মাহবুব তালুকদার ১৯৪২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলায়। তিনি ঢাকা নবাবপুর হাইস্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। 

পরে তিনি ঢাকা জগন্নাথ কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। 

১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তাকে উপসচিবের পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির স্পেশাল অফিসার নিযুক্ত করেন। রাষ্ট্রপতি মুহম্মদ উল্লাহর জনসংযোগ কর্মকর্তাও ছিলেন তিনি। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মাহবুব তালুকদার তার সহকারী প্রেস সচিবের (উপসচিব) দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাকে তদানীন্তন ক্যাডার সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা পরে বিসিএস প্রশাসন হিসেবে রূপান্তরিত হয়। 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মাহবুব তালুকদারকে ওএসডি করা হয়।বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থেকে কাজ করাই ছিল তার অপরাধ। মাহবুব তালুকদার তার 'আমলার আমলনামা' বইয়ে লিখেছেন:

'পঁচাত্তরের পট-পরিবর্তনের পর ওএসডি হওয়া আমার জন্য ছিল এক গৌরবজনক ঘটনা। যেন রাজপুরুষের কপালে রাজটিকা পড়ল এতদিনে। বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হয়েছেন, তখন আমার এই সামান্য ভোগান্তি বরণ করার মধ্যে এক ধরনের সহমর্মিতা অনুভব করলাম। এ যেন আমার স্বাভাবিক প্রাপ্য। পরে মনে হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকার প্রতিফলে চাকরিক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় সম্মান আর হয় না। চাকরি চলে গেলেও আমার কোনও কুণ্ঠা ছিল না। তাই ওএসডি হওয়া স্বাভাবিক বলে মনে করলাম।'

একসময় মাহবুব তালুকদার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন। চাকরিজীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সংসদ সচিবালয়ে অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। তিনি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব শুরু করেন। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে যার মেয়াদ শেষ হয়।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

16h ago