শ্রদ্ধাঞ্জলি

মাহবুব তালুকদার: ‘এক নিঃসঙ্গ শেরপা’

মাহবুব তালুকদার

নির্বাচন কমিশনার হিসেবে সাধারণত ইতিবাচক ইমেজ তৈরি হয় না। কিন্তু, মাহবুব তালুকদারের হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ৫ বছরের পুরো সময়কালে অত্যন্ত কঠিন ও কঠোর পরিস্থিতিতে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ কে নুরুল হুদার নেতৃত্বে যে নির্বাচন কমিশন, সেই নির্বাচন কমিশনের পরিচিতি কোনো অর্থেই ইতিবাচক নয়। জনআস্থাহীন নির্বাচন কমিশন ভোটারবিহীন ও রাতে ভোটের কমিশন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সেই নির্বাচন কমিশনের একজন সদস্য মাহবুব তালুকদার সম্পর্কে জনমানুষের পারসেপশন তৈরি হয়েছে যে, তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে। জনমানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সব রকমের প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে স্রোতের প্রতিকূলে অবস্থান নিয়ে সদা সত্য কথা বলে গেছেন। অন্য কেউ যে কথাটি বলেননি, তিনি সেই কথাটি বলেছেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে। নির্বাচনী ব্যবস্থার ত্রুটি নিয়ে, নির্বাচন রাতে হয় সেটা বলা থেকে শুরু করে, কোন জায়গায় ত্রুটি, কোন নির্বাচনগুলো সঠিকভাবে হয়নি, গণতন্ত্র বিপন্ন— এই বিষয়গুলো তিনি তার পুরো সময়কালে মানুষের সামনে উপস্থাপন করে গেছেন।

কালোকে কালো ও সাদাকে সাদা বলার মতো মানুষ বর্তমান সময়ে খুব বেশি নেই। এক্ষেত্রে মাহবুব তালুকদার সামনের সারির একজন হিসেবে নজির রেখে গেছেন।

নির্বাচন কমিশনার হওয়ার অনেক আগে থেকেই আমলা পরিচয়ের বাইরে লেখক মাহবুব তালুকদারের আলাদা পরিচিতি ছিল।

তিনি বাংলাদেশের প্রথম সারির গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক। তিনি গল্প, কবিতা, ছড়া, উপন্যাস, গল্প, নাটক, গবেষণা-ধর্মী লেখা লিখেছেন। সাহিত্যের সবগুলো অঙ্গনে তার বিচরণ ছিল। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির পত্রিকাগুলোতে তার পদচারণা ছিল। তার গল্প, উপন্যাস ছাপা হতো সাপ্তাহিক বিচিত্রায়, যখন বিচিত্রা এ দেশের অন্যতম প্রধান পত্রিকা।

নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পরে হয়তো লেখক মাহবুব তালুকদারের পরিচিতি কিছুটা চাপাই পড়ে গিয়েছিল। যে লেখাগুলোর কথা বললাম, এর বাইরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্ষমতার কেন্দ্রের এক প্রামাণ্য দলিল মাহবুব তালুকদারের দুটি বই 'বঙ্গভবনে পাঁচ বছর' ও 'আমলার আমলনামা'।

আমরা জানি যে মাহবুব তালুকদার বঙ্গবন্ধু সরকারের সহকারী প্রেস সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছেন। বাকশাল গঠনের পর বঙ্গবন্ধু নিজে মাহবুব তালুকদারকে বলেছেন, 'মাহবুব তুমি আমার সঙ্গে থাকবে।' বঙ্গবন্ধু অন্য সবাইকে যেমন আদর-স্নেহ করতেন, একইভাবে মাহবুব তালুকদারকেও করতেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মাহবুব তালুকদারের ওপর খড়গ নেমে আসে। তাকে ওএসডি করা হয়, পদাবনতি দেওয়া হয়, নানাভাবে তার ওপর অন্যায়-অনিয়ম করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, নিজের লেখা বইয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, 'পঁচাত্তরের পট-পরিবর্তনের পর ওএসডি হওয়া আমার জন্য ছিল এক গৌরবজনক ঘটনা। যেন রাজপুরুষের কপালে রাজটিকা পড়ল এতদিনে। বঙ্গবন্ধু যখন সপরিবারে নিহত হয়েছেন, তখন আমার এই সামান্য ভোগান্তি বরণ করার মধ্যে এক ধরনের সহমর্মিতা অনুভব করলাম। এ যেন আমার স্বাভাবিক প্রাপ্য। পরে মনে হলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থাকার প্রতিফলে চাকরিক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় সম্মান আর হয় না। চাকরি চলে গেলেও আমার কোনও কুণ্ঠা ছিল না। তাই ওএসডি হওয়া স্বাভাবিক বলে মনে করলাম।' (আমলার আমলনামা)

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর অনুলেখক ছিলেন মাহবুব তালুকদার। বঙ্গবন্ধু বলবেন, তিনি রেকর্ড করে লিখবেন। জন্মকাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত টাইপ করা ৩০০ পাতা আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতও হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট মাহবুব তালুকদার তার অফিসের ড্রয়ারে রেখে এসেছিলেন। ১৫ আগস্টের পর আর তা উদ্ধার করতে পারেননি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু আমলের বহু নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলেন এরশাদ। ধারণা করা হয়, পুড়িয়ে ফেলা নথির মধ্যে হয়তো বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপিও ছিল।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি বক্তব্য রেকর্ড করার দায়িত্ব ছিল সহকারী প্রেস সচিব মাহবুব তালুকদারের। স্পুলে ধারণ করা বক্তৃতা, বহু গুরুত্বপূর্ণ নথি, বঙ্গবন্ধুকে লেখা ব্যক্তিগত চিঠি, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার নথিসহ বহুকিছু মাহবুব তালুকদারের কাছে রক্ষিত ছিল। নির্বাচন কমিশনার থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালে যা তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে হস্তান্তর করেছিলেন। এসবই তিনি তার অপ্রকাশিত 'নির্বাচননামা' বইয়ে বিস্তারিত লিখে গেছেন।

যদিও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের পরিচিতি তৈরি হয়েছে, তিনি আওয়ামী লীগের বিরোধী ও বিএনপির পক্ষের। এ কথা সত্য যে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তার নাম বিএনপি প্রস্তাব করেছিল। বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। তার বক্তব্য ছিল এমন, আমি 'বঙ্গভবনে পাঁচ বছর' বইয়ে জিয়াউর রহমানের কঠোর সমালোচনা করেছি। বেগম খালেদা জিয়ার সময়ে ১ হাজার ২২৩ দিন ওএসডি ছিলাম। বঙ্গবন্ধু, শেখ কামাল, ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ মনি, সবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলতে আমার খুব কষ্ট হয়। কিন্তু দেশ ও জাতির কথা ভেবে কথা না বলে উপায় নেই। তিনি সাজানো নির্বাচন ও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় দেশকে অনিশ্চিত গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন।'

এসব কথা আরও বিস্তৃত পরিসরে 'নির্বাচননামা'য় লিখে গেছেন।

১৯৭১ সালে মাহবুব তালুকদার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার প্রভাষক ছিলেন। চলে যান কলকাতায়। তাজউদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ১৯৯৯ সালে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর নিয়েছেন। কর্ম জীবনে তিনি শিল্পকলা একাডেমীসহ বিভিন্ন জায়গার মহাপরিচালক ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন।

কর্মজীবনের শুরুতে ইত্তেফাকে সাংবাদিকতা করেছেন। শিক্ষকতা করেছেন জগন্নাথ কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মাহবুব তালুকদার অত্যন্ত গোছানো, যোগ্য, দক্ষ ও কর্মঠ মানুষ ছিলেন। প্রতিনিয়ত নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে যে কথাগুলো বলে গেছেন, কেবল সেই কথার মধ্যেই তিনি নিজের কার্যক্রম সীমিত রাখেননি। যে ৫ বছর তিনি নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই সময়ে যা যা ঘটেছে, তার যে পর্যবেক্ষণ, যেসব অন্যায়-অনিয়ম বা নেপথ্যের ঘটনা, সেসব নিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ পৃষ্ঠার বই লিখে গেছেন।

আলাপকালে তিনি একটি কথা বলেছিলেন, 'আমি জীবিত থাকাকালে এই বইটি প্রকাশ করা সম্ভব হবে না, প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এতে স্পর্শকাতর বহু তথ্য আছে। এই বইটি প্রকাশিত হবে আমি মারা যাওয়ার পরে।'

বইটি প্রকাশিত হলে জানা যাবে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন সংক্রান্ত বহু অজানা কাহিনি।

মাহবুব তালুকদার বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন, বহু দিকে তার বিচরণ ছিল। তিনি যোগ্য আমলা, দক্ষ প্রশাসক, শক্তিশালী লেখক। বহুদিকে যাদের বিচরণ, তাদের একটি দিক বেশি স্ফুটিত হলে অন্য দিকগুলো অনেক ক্ষেত্রে চাপা পড়ে যায়। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের পরিচিতির পাশে হয়তো তার লেখক পরিচিতি কিছুটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। তবে বাংলাদেশের মানুষ মাহবুব তালুকদারকে মনে রাখবে তার সাহসী, দৃঢ়তাপূর্ণ অবস্থান, সত্য বচন ও সততার জন্য।

মাহবুব তালুকদার যখন নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নিতে আসেন, তখন তিনি জানতেন তার আয়ু শেষ হয়ে আসছে। শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ছে। কতদিন বাঁচবেন, মোটামুটি একটি ধারণা করেছিলেন। মৃত্যু চিন্তা বা হা-হুতাশ করে বাকি দিনগুলো নষ্ট করেননি। জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে কাজে লাগিয়ে গেছেন।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের ৫ বছর কেটেছে একাকী, নিঃসঙ্গভাবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ পুরো কমিশনের আচরণ ছিল আজ্ঞাবহ। ব্যতিক্রম ছিলেন মাহবুব তালুকদার। সোজা মেরুদণ্ডসম্পন্ন মানুষ যে এখনো আছেন, সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে যে সম্মিলিত আজ্ঞাবহতাকে একা চ্যালেঞ্জ করা যায়, সেই নজির তিনি তৈরি করে গেছেন। ক্ষমতাসীনরা তার ওপর রুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু, মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন মাহবুব তালুকদার।

mortoza@thedailystar.net

Comments