যেখানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি এক ও অভিন্ন
আদর্শের দিক থেকে দেশের দুটি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যোজন যোজন পার্থক্য থাকলেও শাসন পদ্ধতির মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় বেশি।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ফিপরেস্কি পুরস্কার পাওয়া প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না'কে আটকে দেওয়া হয়েছিল। তেমনি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে ৩ বছরের বেশি সময় ধরে আটকে আছে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত চলচ্চিত্র মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর 'শনিবার বিকেল'।
ধারণা করা হয়, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে তোষণ করতে নির্বাহী বিভাগ থেকে এই দুটি সিনেমার বেলায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 'মাটির ময়না'কে ছাড়িয়ে আনতে তারেক মাসুদ বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হয়েছিলেন।
জনমত বিবেচনায় সরকার 'শনিবার বিকেল'র ছাড়পত্র অতিসত্বর না দিলে ছবিটির নির্মাতা-প্রযোজক আদালতে যাবেন বলে তাদের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন। নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সিনেমা ছাড়াও অন্যান্য মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে দেশের দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকাকালে বিভিন্ন ধরনের আইন-কানুন বানিয়ে সংবিধান প্রদত্ত মানুষের মৌলিক অধিকার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করেছে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ পুরোপুরি শর্তমুক্ত না হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগানো হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে শর্তহীন করা হলেও মত প্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে শর্তহীন করা হয়নি। সেই সুযোগে স্বৈরাচারী কিংবা রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক সরকার বছরের পর বছর ভিন্নমত দমনের উদ্দেশে একটার পর একটা আইন ও নীতিমালা তৈরি করেছে।
ফলে ক্ষমতাসীনদের স্বাচ্ছন্দ্য দেয় না এমন কিছুর, বিশেষ করে সিনেমা, গান, সাহিত্য, সংবাদ, কবিতার চর্চা করলে নিষিদ্ধ তো মামুলি বিষয়। নির্মাতা, লেখক, শিল্পী, কবি বা সাংবাদিকদের স্থায়ী ঠিকানা হয়ে যেতে পারে কাশিমপুর অথবা কেরানীগঞ্জে! তারেক মাসুদের জন্মদিনে মনে পড়ছে, 'মাটির ময়না' নির্মাণের অপরাধে তার বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তুলেছিল।
ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের কী অদ্ভুত মিল! একইরকম অভিযোগে ইরান সরকার জেলে ভরেছিল কান, ভেনিস, বার্লিন জয়ী চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহিকে। বন্দি অবস্থায় মোবাইল ফোনে 'দিস ইজ নট অ্যা ফিল্ম' বানিয়ে বিশ্ববাসীকে এই নির্মাতা জানিয়ে দিয়েছিলেন, পারিপার্শ্বিকতা যাই হোক না কেন, তিনি সত্যিকারের যোদ্ধা। একজন যোদ্ধাকে থামিয়ে রাখার শক্তি কারো নেই। ফ্ল্যাশ ড্রাইভে করে জন্মদিনের কেকের ভেতর দিয়ে সিনেমাটি পৌঁছে যায় কান চলচ্চিত্র উৎসবে। বাংলাদেশেও চলচ্চিত্র বানিয়ে, কবিতা লিখে, সাংবাদিকতা করে জেল খেটেছেন অনেকে। এসব হয়েছে স্বৈরাচারী সরকার এবং গণতান্ত্রিক সরকারসহ সব আমলেই।
শিল্পের ক্ষেত্রে যত খড়গ নেমেছে, এসবের অজুহাত হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেশের ভাবমূর্তি এবং সুনাম ক্ষুণ্নের বিষয়টিকে ঢাল বানিয়ে সামনে আনা হয়েছে। পোশাক রপ্তানি দিয়ে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের একটা ব্র্যান্ড ভ্যালু এবং সুনাম আছে ঠিক, কিন্তু একইসঙ্গে বিশ্বে বাংলাদেশকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারও আছে। যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভিন্নমত দমন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, আইনের শাসনের অভাব, দুর্নীতি, ঢালাও মুদ্রাপাচার প্রভৃতি। এসব নেতিবাচক প্রচারের সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো কবি, শিল্পী বা নির্মাতার সৃষ্টির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ নেই।
ভাবমূর্তি বিনষ্টের আসল কারণ বন্ধে কোনো সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটিও দৃশ্যমান নয়। অথচ নির্বাহী বিভাগের সব রাগ ও ক্ষোভ সবসময় উগরে উঠে নিরীহ শিল্পী ও তার শিল্পকর্মের বেলায়, সেখানে ধমক আর শাসন যেন তরল পদার্থের মতো নিম্নগামী।
শাসন মাঝে মধ্যে দুঃশাসন ও ক্ষমতার অপব্যবহার মনে হয়, যখন অকারণেই পাকিস্তান যুগের সেন্সর আইনের কাঁচি দিয়ে একটি সিনেমা কেটে দেওয়া হয়। কাটাকাটির সুযোগ না পেলে নিয়মিত বিরতি দিয়ে পুরোপুরি আটকেই দেওয়া হচ্ছে। যদিও আইনটাকে সংশোধিত বলা হয়, আদতে এর কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়নি দুই-একটা শব্দ যোগ, বিয়োগ ও প্রতিস্থাপন ছাড়া। অথচ আধুনিক পৃথিবী অনেক আগেই সিনেমার সেন্সর প্রথা বাতিল করে গ্রেডিং পদ্ধতিতে চলে গেছে।
প্রতিটি সরকার কথায় কথায় সিনেমার উন্নয়নে নিজেদের অবদানের কথা শুনিয়ে বাহবা নিতে চায়। সরকারি অনুদানের নামে দলীয় লোকজনকে দিয়ে প্রপাগান্ডা নির্ভর সিনেমা তৈরির জন্য যদি জনগণের টাকার অপচয়কে চলচ্চিত্রের উন্নয়ন মনে করা হয়, তাহলে বলার কিছু নেই। অথচ এখন পর্যন্ত কোনো সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম স্কুল তৈরির উদ্যোগ নেয়নি। এখানকার ফিল্মমেকাররা স্বদেশি অগ্রজ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন চলচ্চিত্রকারের কাজ দেখে সিনেমা বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেই চেষ্টার ফল হিসেবে প্রতি বছর আমরা কিছু চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতা করতে দেখি। হাতেগোনা এই কয়েকটি চলচ্চিত্রই আমাদের নিজস্ব চিত্রভাষার বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছে।
দেশের যেসব ছবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাচ্ছে এগুলো কোনো ফর্মুলাকেন্দ্রিক নয়। এগুলোতে নির্মাতার নিজের মতো গল্প বলার চেষ্টা থাকে। শিল্পী তার সময়কে ধারণ করেন। সময়ের প্রতি শিল্পীর ক্ষোভ থাকতে পারে। সেই ক্ষোভের প্রতিফলন তার সিনেমায় থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এ ধরনের সিনেমা বা যেকোনো শিল্পকর্ম হয়তো ক্ষমতাবান বা ক্ষমতার কাছে থাকা মানুষদের আরাম দেয় না, দেওয়ার কথাও না। এমন চলচ্চিত্র তাই রাষ্ট্রযন্ত্রের আক্রোশের শিকার হচ্ছে বেশি। সেই আক্রোশ থেকে নির্মাতার চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করতেই সেন্সরের পাশাপাশি নতুন নতুন নীতিমালা করা হচ্ছে, যা পুরোটাই মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব নীতিমালা ও সেন্সর আইন বাতিল করে সিনেমায় গ্রেডিং পদ্ধতি চালু করে দর্শকের পছন্দকে অগ্রাধিকার দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
জসিম আহমেদ: চলচ্চিত্র নির্মাতা
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments