রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া ইউরোপের শীত কাটবে কীভাবে
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইউরোপের আবহাওয়া নিয়ে অন্য অনেক দেশের মানুষের মতো বাংলাদেশিরাও এখন আগ্রহী। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ—এই কয়েক মাস ইউরোপে ঠাণ্ডা আবহাওয়া বিরাজ করে।
তবে এবার ইউরোপে শীতের প্রভাব কেমন হবে তা কেবল প্রকৃতি নয়, বরং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল ও গতি-প্রকৃতির ওপরেও নির্ভর করতে পারে।
গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপদাহে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাপমাত্রার নতুন নতুন সব রেকর্ড হচ্ছে। কোথাও কোথাও জঙ্গলে দাবানল দেখা দিচ্ছে। তা সত্ত্বেও চায়ের কাপে ঝড় তুলছে আসন্ন শীতের আলোচনা। সবার আশঙ্কা, যদি কোনো কারণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা গাজপ্রমকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করার নির্দেশ দেন, তাহলে কী হবে?
বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে বিষয়টি আত্মঘাতী। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরোপ করা অসংখ্য বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা প্রতিশোধ হিসেবে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না একেবারেই।
ইউরোপের গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি
রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর আগের হিসাব অনুসারে, ইউরোপের সামগ্রিক জ্বালানি ব্যবহারের ২৫ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে আসে। এর ৪০ শতাংশ সরবরাহ করে রাশিয়া। এই গ্যাসের একটি বড় অংশ বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে পৌঁছায়।
নর্ড স্ট্রিম চালু হওয়ার আগে ২০০৯ সাল পর্যন্ত রাশিয়া থেকে মূলত ১২টি পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্যাস সরবরাহ করা হতো। এগুলোর মধ্যে ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া ও লাটভিয়ার সঙ্গে সরাসরি ৩টি পাইপলাইন রয়েছে। বেলারুশের মাধ্যমে ৪টি পাইপলাইন গেছে লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ডে এবং ইউক্রেনের মাধ্যমে ৫টি পাইপলাইন গেছে স্লোভাকিয়া, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডে।
২০১১ সালে সরাসরি জার্মানিতে গ্যাস পাঠানোর জন্য নর্ড স্ট্রিম-১ পাইপলাইনের উদ্বোধন হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে বছরে মোট ৫৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জার্মানিতে পাঠাচ্ছিল রাশিয়া।
পরবর্তীতে নর্ড স্ট্রিম-২ নামের আরেকটি পাইপলাইন নির্মাণ করা হলেও তা এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। ইউক্রেনে হামলার শাস্তি হিসেবে এর অনুমোদন প্রক্রিয়া স্থগিত রাখা হয়েছে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের।
জুনে গাজপ্রমের গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে
জুনের মাঝামাঝি সময় 'নষ্ট টার্বাইন সংস্কারের' অজুহাত দেখিয়ে হঠাৎ করেই গ্যাসের সরবরাহ ৪০ শতাংশে নামিয়ে আনে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম।
অনেকেই এই উদ্যোগকে একটি পরোক্ষ হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছেন। বিশ্লেষকদের মতে, গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে রাশিয়া ইউরোপকে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছে যে, আসন্ন শীতে গ্যাসের সংরক্ষণাগারগুলো খালি থাকতে পারে।
আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার প্রধান ফাতিহ বিরল জুনে ইউরোপের দেশগুলোকে রাশিয়া থেকে আসা জ্বালানি সরবরাহের ওপর দ্রুত নির্ভরতা কমানোর বিষয়ে সতর্ক করেন। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তিনি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ না করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎসের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
এ ব্যাপারে তার ভাষ্য ছিল, 'শীত যত এগিয়ে আসছে, রাশিয়ার উদ্দেশ্য ততটাই পরিষ্কার হচ্ছে। তারা আলোচনার টেবিলে শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে চায়। এজন্য তারা ইউরোপের দেশগুলোকে গ্যাসের মজুত পূর্ণ করতে দিচ্ছে না।'
জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, স্লোভাকিয়া ও বুলগেরিয়া জানিয়েছে, এ বছর রাশিয়া থেকে তারা প্রত্যাশার তুলনায় কম গ্যাস পেয়েছে। ফরাসি প্রতিষ্ঠান জিআরটিগ্যাজ জানিয়েছে, তারা ১ মে থেকে নর্ড স্ট্রিমের মাধ্যমে কোনো গ্যাসই পায়নি। একই সময় ইতালি ৫০ শতাংশ সরবরাহ পাওয়ার কথা জানিয়েছে।
গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হলে কী হতে পারে
রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির সাবেক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও দেশের দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট পুতিন যদি গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেন, তাহলে ইউরোপের বাসাবাড়িতে জ্বালানি খরচ ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাষ দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস।
বিশ্বখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানটি সতর্ক করে বলছে, এমন পরিস্থিতিতে জার্মানি ও ইতালিতে সিমেন্ট এবং রাসায়নিক উপাদান উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার ৮০ শতাংশ কমাতে হবে। এতে ২ দেশের জিডিপি যথাক্রমে ৩ ও ৪ শতাংশ কমতে পারে।
সাধারণত শীতের মোকাবিলায় ইউরোপের দেশগুলো নভেম্বরের মধ্যে তাদের গ্যাসের সম্পূর্ণ মজুদের ৮০ শতাংশ পূরণের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেয়।
তবে জুনে রাশিয়া গ্যাসের সরবরাহ সামান্য এদিক-ওদিক করাতেই ইউরোপীয় দেশগুলো বিপাকে পড়েছে।
ইনভেসটেকের তেল ও গ্যাস বিষয়ক বিশ্লেষক নাথান পাইপার জানান, অনেক বেশি অর্থ খরচ না করে গ্যাসের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
বিকল্প উৎস
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে এশিয়ার মাধ্যমে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) পাঠাচ্ছে। তবে এই জ্বালানি তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল।
এ মুহূর্তে আমেরিকা থেকে জাহাজের মাধ্যমে জ্বালানি আমদানি করা কিংবা নরওয়ে ও আজারবাইজানের মতো অন্যান্য গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ থেকে সরাসরি পাইপের মাধ্যমে গ্যাস আনা ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাতে তেমন কোনো বিকল্প নেই।
আরেকটি বিকল্প হতে পারে টেকসই জ্বালানির ব্যবহার, পুরনো পরিবেশ দূষণ সৃষ্টিকারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো আবার চালু করা অথবা সম্পূর্ণ নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণ। তবে এর প্রতিটি উদ্যোগের জন্যই প্রয়োজন প্রচুর সময়। এছাড়া কয়লা বা এ ধরনের কাঁচামাল ব্যবহার করে জ্বালানি উৎপাদন করা হলে জলবায়ুর ওপরেও বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা থাকে।
ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশ ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে সার্বিকভাবে গ্যাসের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা এ বিষয়ে ১০টি সুপারিশও করেছে। এর মধ্যে আছে বায়ু ও সৌরশক্তিভিত্তিক জ্বালানি উৎপাদন, গ্যাস মজুতের লক্ষ্যমাত্রা কমানো এবং বায়োএনার্জি ও পারমাণবিক উৎস থেকে জ্বালানি উৎপাদনসহ আরও কিছু উদ্যোগ।
তবে স্বল্প মেয়াদে কোনো কার্যকর বিকল্প না থাকায় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে আসন্ন শীতে জ্বালানির ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে দেশের সরকার বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমে বিভিন্ন শিল্পে গ্যাসের ব্যবহার সীমিত করতে পারে। ফলে কিছু পণ্যের উৎপাদন খরচ দ্রুত বেড়ে যাবে এবং সেগুলো বর্তমান মূল্যে বিক্রি করা অলাভজনক হয়ে পড়বে। এতে বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতির চাপ।
বাধ্যতামূলকভাবে সড়কবাতির উজ্জ্বলতা কমিয়ে দেওয়া অথবা বিনোদন কেন্দ্রগুলো তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও আসতে পারে। জার্মানিতে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
তবে এ ধরনের উদ্যোগ শাঁখের করাতের মতো হতে পারে। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্নালেনা বেরবকের পর্যবেক্ষণ হলো, এ ধরনের উদ্যোগে জনমনে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে জার্মানিতে জ্বালানি বিল ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষ বিল পরিশোধ না করে প্রতিবাদ জানানোর কথা ভাবছে।
১২ আগস্ট প্রকাশিত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, জার্মানি তাদের জ্বালানি ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমাতে সক্ষম হয়েছে। আগামী মার্চের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে অনেকদূর এগিয়েছে দেশটি।
রাশিয়ার বিবেচ্য বিষয়গুলো
ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া রাশিয়ার জন্য খুবই ব্যয়বহুল একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেন্টার ফর ইকোনমিক রিকভারি ও ইজিবিজনেস নামক গবেষণা সংস্থার এক সমীক্ষায় জানা গেছে, শিগগির ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার দৈনিক খরচ ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, যুদ্ধের প্রথম ৫ দিনেই রাশিয়া ৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে।
তবে রাশিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুসারে, সামরিক খাতে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে তারা সর্বমোট ২৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে।
প্রকৃত পরিমাণ যতই হোক, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে গ্যাস বিক্রি থেকে পাওয়া রুবল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদ সংস্থার দেওয়া তথ্য বলছে, এ বছরের শেষে নাগাদ গ্যাস খাত থেকে রাশিয়া বাড়তি ১ ট্রিলিয়ন রুবল (১৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার) উপার্জন করতে যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করা হলে তা রাশিয়ার জন্যেও বিপদের কারণ হতে পারে।
Comments