ব্রাহ্মণবাড়িয়া-নরসিংদীর ১১৯ লেভেলক্রসিং যেন ‘মরণফাঁদ’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭৩ কিলোমিটার রেলপথে ক্রসিং আছে ৭৯টি। এর মধ্যে ৫৭টি লেভেলক্রসিংয়ে নেই কোনো গেটম্যান। অপরদিকে, নরসিংদীতে ৪১ কিলোমিটার রেলপথে ক্রসিং আছে ৪৬টি। এর মধ্যে ৩৮টিতেই গেটম্যান নেই।
দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক সরেজমিনে দেখেন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তালিকার বাইরেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরও অন্তত ১৮টি ও নরসিংদীতে ৬টি লেভেলক্রসিং আছে। সেই হিসাবে এই ২ জেলায় অন্তত ১১৯টি লেভেলক্রসিং অরক্ষিত।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে ২০১৯ সালের পর নির্মিত নতুন ক্রসিংয়ের কোনো সঠিক তথ্য নেই।
অরক্ষিত এসব রেলক্রসিংয়ের উভয় দিকে সতর্কতামূলক নোটিশ টানিয়েই যেন দায় সেরেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। নোটিশ বোর্ডে লেখা হয়েছে, যে কোনো দুর্ঘটনার দায় শুধু পথচারী ও যানবাহন চালকদের।
বিপজ্জনক এসব লেভেলক্রসিংকে 'মরণফাঁদ' মনে করছেন স্থানীয়রা। তাদের মতে, এসব রেল ক্রসিংগুলোয় ট্রেন ও যানবাহন নিয়ন্ত্রণে কর্মী না থাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।
রেলওয়ে পুলিশের হিসাব অনুসারে, সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদী জেলার অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও যাত্রীসহ ১১ জন প্রাণ হারিয়েছেন।
গত ৪ জুন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার আমীরগঞ্জ রেলস্টেশনের কাছে হাসনাবাদ বাজার লেভেলক্রসিংয়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী আন্তঃনগর জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় পিকআপ ভ্যানের ৪ যাত্রী নিহত হন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার কাছাইট, ভাদেশ্বরা, মাছিহাতা, পাঘাচং, চিনাইরসহ কয়েকটি এলাকার লেভেলেক্রসিংয়ে গিয়ে দেখা গেছে, কোনো গেটেই গেটকিপার নেই। অরক্ষিত ক্রসিং দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ ও যানবাহন চলাচল করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছে, অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ের বেশিরভাগ সড়ক স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে। লেভেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তায় কোনো উদ্যোগ নেয় না এই অধিদপ্তর।
রেল কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে রেল ক্রসিংগুলোর একটা বড় অংশই অরক্ষিত।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ শিরাজুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মূলত জনবল সংকটের কারণে এলজিইডির সড়কে লেভেলক্রসিংগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। এলজিইডি ও রেলওয়ের যৌথ প্রতিনিধিদল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নিয়োগের ব্যাপারে কয়েকদিন আগে সমীক্ষা চালিয়েছে। কয়েকটি লেভেলক্রসিংয়ে গেটকিপার নিয়োগ করা হবে।'
রেলওয়ের আইন অনুযায়ী, রেলপথে ক্রসিং তৈরি করতে হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পূর্বানুমতি নিতে হয়। ক্রসিংয়ের স্থানে রেলপথের ২ পাশে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ফটক নির্মাণ করতে হয়।
এ ছাড়া, কমপক্ষে ৩ জন প্রহরীর মজুরি, সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার খরচও বহন করতে হয় সংশ্লিষ্টদের।
এরপর, সরেজমিনে পরিদর্শন করে রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের চূড়ান্ত পর্যবেক্ষণের পর নিকটস্থ রেলস্টেশন থেকে ওই ক্রসিংয়ের অনুমোদন দেওয়া হয়।
অনুমোদন নিয়ে লেভেলক্রসিং নির্মাণ ব্যয়বহুল হওয়ায় লোকজনের অনুমোদন ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছামতো রেলপথের ২ পাশে রাস্তা দেখিয়ে লেভেলক্রসিং ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
আখাউড়া রেলওয়ে জংশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থেকে কসবার সালদা নদী রেলস্টেশন পর্যন্ত প্রায় ৪৬ কিলোমিটার রেলপথ। আখাউড়া রেলওয়ে জংশন থেকে বিজয়নগর উপজেলাধীন হরষপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত সিলেট রুটে প্রায় ২৭ কিলোমিটার রেলপথ। রেলওয়ের হিসাব অনুসারে, এই দীর্ঘ রেলপথে থাকা ৭৯ লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২২টির অনুমোদন রয়েছে।
পূর্বাঞ্চল রেলপথের আখাউড়া ও ভৈরব রেলওয়ে জংশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নরসিংদী জেলার ১১৪ কিলোমিটার রেলপথে মোট ১২৫ লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে রেলওয়ের অনুমোদিত মাত্র ৩০টিতে গেটম্যান আছে।
গেটম্যানহীন বাকি ৯৫ লেভেলক্রসিং অরক্ষিত। এখানে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুঝুঁকির আশঙ্কা আছে। অরক্ষিত এসব লেভেলক্রসিংকে বৈধতা দেওয়ার পাশাপাশি এগুলোয় গেটম্যান নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের মাছিহাতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আল-আমিনুল হক পাভেল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাঘাচং রেলস্টেশনের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তের ২ রেলক্রসিং অনুমোদনহীন। এগুলোয় গেটকিপার নেই।'
'এই পথ দিয়ে চাঁন্দপুর তমিজউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অনার্স কলেজ, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা চাঁন্দপুর বাজার ও মাছিহাতা ইউনিয়ন পরিষদে প্রতিদিন যাতায়াত করেন। এত সংখ্যক মানুষ ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করলেও এই ২ লেভেলক্রসিংয়ের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।'
তিনি আরও বলেন, 'এই ক্রসিংয়ে গেটম্যান নিয়োগের দাবিতে রেল মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।' মানুষের জানমাল রক্ষায় এখানে গেটকিপার দেওয়ার দাবি জানান এই ইউপি চেয়ারম্যান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নাগরিক ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান পারভেজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রেল রাষ্ট্রের এত বড় একটা সেক্টর, অথচ জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে তারা। বিষয়টি খুবই লজ্জার।'
আখাউড়ার গঙ্গাসাগর রেলগেটের কাছেই তাজুল ইসলামের দোকান। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, '১৯৯৭ সালে গঙ্গাসাগর রেলগেটে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছিল। স্থানীয় রাণীখার গ্রামের ৫ জন নিহত হন। এরপর এখানে গেটকিপার দেওয়া হয়। এখন দুর্ঘটনা কমেছে।'
আখাউড়া রেলওয়ে জংশনের উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) মনিরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রেলওয়েতে লোকবলের অভাব। স্থানীয়ভাবে যত্রতত্র লেভেলক্রসিং করা হচ্ছে। বিদ্যমান লোকবল দিয়ে এসব রক্ষণাবেক্ষণ রেল কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। বৈধ ক্রসিং নষ্ট হলে আমরা দ্রুত মেরামতের চেষ্টা করি।'
ভৈরব রেলওয়ে জংশনের সহকারী প্রকৌশলী মো. নাজমুল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রেলওয়ের অনুমতি ছাড়া যত্রতত্র লেভেলক্রসিং করা অবৈধ ও রেলের আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অনেকেই এই আইন মানছেন না।'
'গেট আর কর্মী নিয়োগের পরও ট্রেন আসার আগমুহূর্তে পথচারী ও যানবাহন চালকদের মধ্যে তড়িঘড়ি করে পারাপারের প্রবণতা আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের পাশাপাশি জনসাধারণকেও দেখে-শুনে চলাচল করতে হবে,' যোগ করেন তিনি।
যেসব লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নেই, সেগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'রেল আইন অনুযায়ী, যারা সড়ক নির্মাণ করবে, লেভেলক্রসিং নির্মাণ ও সেখানে গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া তাদের কাজ। তারা তাদের কাজ করছে না।'
Comments