‘মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করতে না পারলে সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে’

রামেন্দু মজুমদার
রামেন্দু মজুমদার। ছবি: সংগৃহীত

একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার বাংলাদেশের মঞ্চ নাটকের ইতিহাসে অগ্রগণ্যদের অন্যতম। শুধু সাংস্কৃতিক আন্দোলন নয়, যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রয়েছে তার অবদান। খ্যাতনামা নাটকের দল 'থিয়েটার' এর অন্যতম প্রধান তিনি।

ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউটের বর্তমান অনারারি প্রেসিডেন্ট ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির দুইবারের সভাপতি ছিলেন তিনি।

আজ ৯ আগস্ট তার জন্মদিন। ৮১ বছর শেষ করে ৮২ বছরে পা দিলেন রামেন্দু মজুমদার।

জন্মদিনে শিল্প ভাবনা, থিয়েটার, বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ নানা বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

জীবন বলতে যা বোঝায়, সেই জীবনের শুরুটা কখন?

১৯৬১ সাল থেকে সেই জীবনের শুরু, যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সে সময় থেকেই সত্যিকারের জীবনের শুরু, নিজেকে চেনা শুরু। তখন থেকেই জেনে বুঝে নাটক শুরু করি। আমার সামনে নতুন পৃথিবী খুলে যায়। সুযোগটি হয়েছিল দুজন মানুষের কল্যাণে। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার কথা বলতেই হয়। তিনি মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তখনই আমার জীবনের নতুন সূর্যের উদয় হয়।

আপনার জীবনের দর্শন কী?

আমি সৎ ভাবে বেঁচে থাকতে চেয়েছি। সততা নিয়ে থাকতে চেয়েছি। যাই করেছি নিষ্ঠার সঙ্গে করার চেষ্টা করেছি। মানুষের কল্যাণ চেয়েছি। আমাকে দিয়ে উপকার না হোক, ক্ষতি যেন না হয়, জ্ঞানত কারও ক্ষতি করার চেষ্টা করিনি কখনো। এটাই ছিল আমার জীবনের দর্শন।

ফেলে আসা জীবনে সংগ্রাম বা সংকটের মুখোমুখি হতে হয়েছে কখনো?

প্রথম জীবনে প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছে। অনেক সংগ্রাম ও সংকট গেছে। আবার সংকট কেটেও গেছে। কিন্তু ধৈর্য হারাইনি। অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। করাচি, দিল্লি ও ঢাকায় চাকরি করেছি। সবখানে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। সংগ্রামের দিনগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় ভালোবাসাই বেশি পেয়েছি।

আপনার জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বঙ্গবন্ধুর প্রভাব কতটা?

আমার জীবনে এই দুজনের প্রভাব অনেক। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দুই দিন পর আমার জন্ম।  রবীন্দ্রনাথ এবং বঙ্গবন্ধু আমার জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছেন। একজন শিল্প সাহিত্যে, আরেকজন রাজনীতিতে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা বলি, কী করে একজন মানুষ এত কিছু সৃষ্টি করতে পারেন? অতি মানব না হলে সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের তুলনা রবীন্দ্রনাথ নিজেই।

আর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ১৯৬৪ সালে। আমি তখন ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দাঙ্গা শুরু হয়েছে। রাতের বেলা ট্রেন থামিয়ে লোকজন হত্যা করা হচ্ছে। আমাদের আত্মীয় ছিলেন অজিত গুহ। তিনি বঙ্গবন্ধুকে ফোন করেন। আমি ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। ভোরবেলা বঙ্গবন্ধু জিপ নিয়ে উপস্থিত। বললেন, দুই মিনিট সময় দিলাম। আমার সঙ্গে চলুন  সবাই। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিয়ে গেলেন। বেগম মুজিব সবার খাবারের ব্যবস্থা করলেন। এই যে মানুষের বিপদের সময় এগিয়ে আসা, বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সেই সাহস ছিল। কলকাতায়ও তিনি দাঙ্গার সময় সেই সাহস দেখিয়েছেন।

রামেন্দু মজুমদার
রামেন্দু মজুমদার। স্টার ফাইল ফটো

অনেক পরে বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি বই লিখেছিলাম 'মাই বাংলাদেশ' নামে। বইটি লিখেছিলাম ইংরেজিতে। ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি বইটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই। তিনি খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন, বাংলায় করো। করেছিলামও। কিন্তু তিনি দেখে যেতে পারেননি। 

এই সময়ে এসেও সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে, শিক্ষককে অসম্মান করা হচ্ছে। দেশেও নানা সংকট দেখা দিচ্ছে। আশার আলোটা কি ফুরিয়ে আসছে?

আমরা গর্ব করে বলি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, অসাম্প্রদায়িক শক্তির পক্ষের সরকার ক্ষমতায় আছে। সমাজটা তো মৌলবাদীদের দখলে চলে গেছে। কিন্তু রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার বেড়েছে। বঙ্গবন্ধুর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্ত পরে সেটা আর থাকেনি। অনেক দলের পুঁজিই ধর্ম। উত্তরণের পথ কঠিন। করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করতে হবে। সংস্কৃতি চর্চা বাড়াতে হবে। শিক্ষার পরিবেশ আনতে হবে।  সব দলকে অঙ্গিকার করতে হবে, তারা যেন ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে না মেশায়। তাহলেই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তৈরি হবে।

গত ৫০ বছরে আমাদের অর্জন কতটুকু?

গত ৫০ বছরে বৈষয়িক অনেক উন্নতি হয়েছে। সবশেষ পদ্মা সেতু। নিজেদের টাকায় এটা করা হয়েছে। এটা গর্বের বিষয়। আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে অনেক। অর্জন আছে অনেক। একই সঙ্গে মূল্যবোধের অবক্ষয় হয়েছে। এটা পীড়া দেয়। যদি এটা রোধ না করতে পারি তাহলে সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে।

আজ আপনার জন্মদিন। বিশেষ এই দিনটি এলে কী মনে হয়?

মনে হয় সময় দ্রুতই ফুরিয়ে আসছে। আরেকটু যদি বাঁচতে পারতাম। বাঁচার আকাঙ্ক্ষা শেষ হয় না।

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

1h ago