‘আনন্দের চেয়ে আগস্ট আমার জন্য ভয়াবহ স্মৃতির মাস’

জনপ্রিয় কবি মহাদেব সাহার ৮৯তম জন্মদিন আজ। ১৯৪৪ সালের আজকের দিনে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়া গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। প্রেম ও দ্রোহের কবি হিসেবে পরিচিত তিনি।

১৯৬৪ সালে মহাদেব সাহা বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে বাংলা সাহিত্যে অনার্স করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

১৯৬৯ সালে তৎকালীন সাপ্তাহিক পূর্বদেশ পত্রিকার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন মহাদেব সাহা। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেছেন। সর্বশেষ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা থেকে অবসর নেন।

মহাদেব সাহা সাহিত্য কীর্তির জন্য ১৯৮৩ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০০১ সালে একুশে পদক লাভ করেন। স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন ২০২১ সালে। জন্মদিন উপলক্ষে তিনি কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

কেমন আছেন?

মহাদেব সাহা: এই বয়সে কেউ কী ভালো থাকে। 

কী হয়েছে?

মহাদেব সাহা: বিদেশে ছিলাম অসুস্থ। দেশে ফিরেও ফুসফুস ও হার্টের সমস্যায় ভুগছি।

একদিন দেখা করতে চাই, আপনার জীবন ও সাহিত্য নিয়ে কথা বলার সময় হবে?

মহাদেব সাহা: সেটা হবে না মনে হয়। আমার বাসার দরজা খোলার লোকও নেই। কেউ আসে না, আমিও কোথাও যাই না। ফোনে বলুন।

লেখালেখি করতে পারছেন?

মহাদেব সাহা: পারি বলতে এমন—আমি বলি কেউ একজন লিখে নেয়।

আপনার প্রথম বই কবে বের হয়েছে? সেই স্মৃতি মনে পড়ে?

মহাদেব সাহা: হ্যাঁ, ১৯৭২ সালের এপ্রিলে। প্রথম কবিতার বই 'এই গৃহ এই সন্ন্যাস' নামে। স্বাধীনতার পরে কবি-লেখকদের মধ্যে মনে হয় আমারই বই প্রথম প্রকাশিত হয়। সে কী আগ্রহ, উচ্ছ্বাস ভাষায় প্রকাশ করার মতো না!

৫ আগস্ট আপনার জন্মদিন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি আমরা। এই মাসটাকে কীভাবে দেখেন?

মহাদেব সাহা: এই মাসে কেবল আমারই জন্মদিন না। একই দিনে শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের জন্মদিন, ৮ তারিখে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন। ১০ তারিখ আমার বাবা মারা যান, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হারালাম। সব মিলিয়ে আনন্দের চেয়ে আগস্ট আমার জন্য ভয়াবহ স্মৃতির মাস।

১৫ আগস্ট নিয়ে কিছু লিখেছিলেন?

মহাদেব সাহা: হ্যাঁ, আমার একটা বই আছে 'আত্মস্মৃতি ১৯৭৫: সেই অন্ধকার সেই বিভীষিকা'। বইটিকে বলা যায়, অশ্রুময় এক অখণ্ড গদ্যকাব্য আমার। যেখানে ওঠে এসেছে মহাজীবনের এক অসামান্য ইতিহাস। শোকাহত, ব্যথিত কবির আত্মস্মৃতিতে মহামানবের জীবন কাহিনীর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এই বাংলার জীবনচিত্র। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ, সাহস ও শৌর্যের বিবরণ, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা—তথা এক জীবনের মধ্যে অসংখ্য জীবন, অসংখ্য ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে।

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু সংবাদ কীভাবে পেলেন?

মহাদেব সাহা: সে সময় ঢাকার আজিমপুর আমার বাসা ছিল। সকালের দিকে ঘুমাচ্ছি, ঘরে রেডিওতে সংবাদ পায় আমার স্ত্রী। খবর শুনেই আমায় ডাকে-'এই শুনছো, বঙ্গবন্ধু তো নাই'। আমি লাফ দিয়ে উঠেই রেডিওতে শুনতে পাই মেজর ডালিমের কণ্ঠ। এত খারাপ লেগেছে বলে বোঝানো যাবে না!

আগেই বলেছি ১০ তারিখ আমরা বাবাকে হারালাম। সেই শোকে আমরা মাটিতে পাটি বিছিয়ে ঘুমাই। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চলাফেরাই বন্ধ হয়ে যায়। দুটো বিষয় আমার জন্মদিনের আনন্দকে শেষ করে দিয়েছে।

আগস্টের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার একটা কবিতা পড়েছিলাম। 'আমি কি বলতে পেরেছিলাম'-নামে। কবিতাটা মনে আছে?

মহাদেব সাহা: হ্যাঁ।

'… তোমার রক্ত নিয়েও বাংলায় চালের দাম কমেনি

তোমার বুকে গুলি চালিয়েও কাপড় সস্তা হয়নি এখানে,

দুধের শিশু এখনো না খেয়ে মরছে কেউ থামাতে পারি না

বলতে পারিনি তাহলে রাসেলের মাথার খুলি মেশিনগানের

গুলিতে উড়ে গেল কেন?

তোমাকে কিভাবে বলবো তোমার নিষ্ঠুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে

প্রথমে জয়বাংলা, তারপরে একে একে ধর্মনিরপেক্ষতা

একুশে ফেব্রুয়ারি ও বাংলাভাষাকে হত্যা করতে উদ্যত হলো তারা।'

আপনার কতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে?

মহাদেব সাহা: ৮২টি কবিতার বই, ৭ খণ্ডে কবিতা সমগ্র, ৩ খণ্ডে গদ্য, ১ খণ্ডে শিশুসাহিত্য ও নির্বাচিত কলাম।

জীবনের কোনো বিষয়ে কষ্ট পান? তা কী ভাবায়?

মহাদেব সাহা: না। তবে আমার একটা বই আছে 'কাকে এই মনের কথা বলি'। পড়ে দেখবেন।

মৃত্যু নিয়ে ভাবেন?

মহাদেব সাহা: মৃত্যু নিয়ে ভাবতে গেলে মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখার মতো করে বলতে হয়—'জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে, চিরস্থির কবে নীর, হায় রে জীবন-নদে…'।

Comments