হেঁটে বাংলাদেশ: সাগর ফেরত জেলেদের সঙ্গে আড্ডা

সাম্পান
ডাঙায় তুলে রাখা মাছ ধরার নৌকা। ছবি: বিনয় ভদ্র/আশানুর রহমান খান

আগের রাতে হাঁটা থামিয়ে প্রায় ১৪ কিলোমিটার গাড়িতে করে ইনানি গিয়েছিলাম। সৈকতে ক্যাম্পিং করে রাত কাটানোর পরিকল্পনা করি। রাত ১১টার পর তাঁবু, ব্যাকপ্যাক নিয়ে বিচে চলে যাই। 

তাঁবু খাটানোর আগেই ঝুম বৃষ্টি। অগত্যা ব্যাগপত্র নিয়ে রীতিমতো পালিয়ে মেরিন ড্রাইভে যাই। একটা দোকানের বারান্দায় আশ্রয় নিয়ে পরে থাকার জন্য রুম খুঁজতে বের হই। একটা রিসোর্টে সস্তায় রুমও পেয়ে যাই।

বুধবার ভোরেও ঝুম বৃষ্টি। রেডি হয়েও রওনা দিতে অনেক দেরি হয়ে গেল। জুতো ভিজে গেলে সমস্যা। বৃষ্টি থামলে রওনা হলাম। আগের রাতে যেখানে হাঁটা থামিয়েছিলাম, সেখানে পৌঁছে হাটা শুরু করলাম।

শুরুর এক কিলোমিটারের মধ্যে বিজিবির একটা চেকপোস্ট পড়ল। কী করি জানতে চাইলে বললাম 'ভ্যাগাবন্ড। আপাতত বেকার তাই হেঁটে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছি।'

মেরিন ড্রাইভের ওই এলাকার আশপাশে বসতি নেই বললেই চলে। বৃষ্টি শুরু হলে আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ নাই। কি আর করা, বৃষ্টির মধ্যেই হাঁটতে থাকি।

মাছ ধরার নৌকা। ছবি: বিনয় ভদ্র/আশানুর রহমান খান

মেরিন ড্রাইভ রোডটা আসলে হাঁটার জন্য সুবিধাজনক না। রোড ডিভাইডার নেই, ব্যাটারিচালিত রিকশার আধিক্য। আর পর্যটকদের নিয়ে মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশাও অনেক বেশি। বারবার মূল সড়ক থেকে সরে আসতে হয়, কিন্তু সেখানে নেই কোনো ফুটপাত। রাস্তার পাশে বুনোফুলের গাছ, লতা-গুল্মে ফুটপাতের জায়গা পুরোটাই আবৃত।

মেরিন ড্রাইভের পূর্বপাশের সিংহভাগ জায়গা ঢাকার বিভিন্ন শিল্পপতিদের দখলে। সেখানে বসানো সাইনবোর্ড দেখে তা জানলাম। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এই এলাকাই হবে দেশের সবচেয়ে বড় অর্গানাইজড ট্যুরিস্ট জোন।

গাড়ির চাপ সামলাতে না পেরে সৈকত ধরে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলাম। তার আগে রাস্তায় একটা অস্থায়ী দোকানে কলা ও পেয়ারা খেয়ে নিলাম। কেনার সময় মনে হলো, এখানে পর্যটকদের কারণে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করার প্রবণতা বেশি।

সৈকত বেশ নিরিবিলি, জনমানবহীন বলা যায়। ঢেউয়ের তালে সাগরের গর্জনে চারপাশ মুখরিত। জোয়ার-ভাঁটার উদ্বেলিত সাগরপাড় ধরে হাঁটতে থাকি। 

মেরিন ড্রাইভের অন্তত ৯০ শতাংশ এলাকায় পর্যটকের আনাগোনা নেই বলেই মনে হলো। পর্যটকেরা প্রধানত জনপ্রিয় বিচগুলোতে যেতে পছন্দ করেন।

হঠাৎ এক জায়গায় দেখলাম জেলেরা মাছ ধরার নৌকাগুলো ডাঙায় তুলে রেখেছে। রঙ-বেরঙের পতাকায় শোভিত নৌকাগুলোর দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য বড়ই মনোমুগ্ধকর। সাগর থেকে মাছ ধরে ফেরার পর নৌকা পাড়ে তোলার দৃশ্যও দারুণ। নৌকার নিচে অস্থায়ী চাকা লাগিয়ে দড়ি বেধে জিপ বা ট্রাক্টর দিয়ে টেনে উঠানো হয়। 

মাছ ধরার এই নৌকাগুলোকে স্থানীয়ভাবে সাম্পান বলা হয়। প্রতিটি সাম্পান ডাঙায় উঠাতে গাড়ি খরচ ৩০০ টাকা এবং চাকা খরচ ২০০ টাকা।

সদ্য মাছ ধরে সাগর ফেরত জেলেদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা হলো। তারা জানালেন, সমুদ্র এখন শান্ত। প্রচুর মাছ পাওয়ায় তারা বেশ খুশি।

ভবিষ্যতে তাদের সঙ্গে সাগরে যাওয়ার ইচ্ছে জানালে তারাও আমাদের স্বাগত জানালেন।

ছবিতে বিনয় ভদ্র ও আশানুর রহমান খান।

সকালে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার হেঁটে ইনানি বিচ পৌঁছালাম। রিসোর্টে চেক আউট ছিল ১১টায়। ব্যাকপ্যাকগুলো রিসোর্টের রিসিপশনে রেখে উত্তম কাব্য ও হাবিবকে বিচে চলে আসতে বলি। বিচে দুজনের জন্য বেডসহ একটা বিচ চেয়ার ঘণ্টা প্রতি ৫০ টাকায় ভাড়া করে ঘুম দেই। উপরে ছাতাও ছিল। আরামের তুলনায় ভাড়া বেশ সস্তা মনে হলো।

বিকেল ৪টা থেকে আবার হাঁটা শুরু করি। ইনানি বাজারের ব্রিজ পার হয়ে বামে সৈকতে নামি। সাগরে ভাটা চলছিল। ভাটার টানে সদ্য ভেসে ওঠা সৈকত ধরে হাঁটতে থাকি। আকাশে  মেঘ ছিল বলে রোদের তেজ একেবারেই ছিল না। দ্রুত সামনে এগোতে থাকি। বিচে বিভিন্ন জায়গায় ফুটবল খেলায় মেতেছিল কিশোরের দল।

সৈকত দিয়ে হাঁটার মূল সমস্যা হয় পথে কোনো খাল বা পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝিরি পড়লে। অনেকটা পথ ফিরে কালভার্ট সংলগ্ন রাস্তায় উঠতে হয়। এবারও যে খাল পড়ল, পানি এড়িয়ে সেটি পার হতে অতিরিক্ত আরও প্রায় দেড় কিলোমিটার হাটতে হতো। 

তাই খাল পার হওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়ে আমাদের একজন জুতো খুলে অপরজনকে কাঁধে নিয়ে খাল পার হয়ে গেলাম। দুজনের জুতা-মোজা খোলা প্রয়োজন হয়নি।

সৈকতের কাছেই সাগরে অনেকে নীল জাল পেতে গলদা চিংড়ির রেণু আহরণ করে। রেণু আলাদা করাও খুব ঝামেলার কাজ বলে মনে হলো। খড়কুটো ময়লামিশ্রিত পানি থেকে রেণু আলাদা করতে হয়।

রেণু
গলদা চিংড়ির রেণু আহরণ। ছবি: বিনয় ভদ্র/আশানুর রহমান খান

সন্ধ্যা হয়ে গেলে মেরিন ড্রাইভে উঠে পড়ি। হেডল্যাম্প ও বিব পরে হাঁটতে থাকি। দৌঁড়ে সংকীর্ণ রেজুখাল ব্রিজ পার হই। জায়গা দেখে মনে হলো, কর্তৃপক্ষ চাইলে এই ব্রিজটা একটু প্রশস্ত করে বানাতে পারত।

একসময় উখিয়া উপজেলা অতিক্রম করে রামু উপজেলায় প্রবেশ করি। বেশ দ্রুত এগোতে থাকি। মারমেইড রিসোর্ট সংলগ্ন একটা দোকানে ব্রেক নেই। সেখানে হেডল্যাম্পও চার্জ দিয়ে নিলাম। ডাব খেলাম। প্রতিটি ডাবের দাম পড়ল ২৪০ টাকা। আবারও মনে হলো-পর্যটকের আধিক্যের কারণে দোকানিরা বাড়তি দাম আদায় করছেন। টেকনাফ বা ইনানিতে এই ডাব ৮০-১০০ টাকা দাম ছিল।

কিছুদূর যাওয়ার পর হিমছড়ি পৌঁছালাম। হিমছড়ি থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দূরে কক্সবাজার। পা আর চলছিল না। তবুও মনের জোরে আগাতে থাকি। 

বাকিটা পথ দৌঁড়ে যাওয়ার চিন্তা করলেও, তা সম্ভব হয়নি। কারণ আমাদের একজনের কাঁধে ছিল জেবিএল এক্সট্রিম ত্রি স্পিকার। স্পিকারটা হাঁটাপথে সবসময় সঙ্গ দেয়। অঞ্জন দত্ত বা সঞ্জীব চৌধুরীর গানে মশগুল হয়ে পথ পাড়ি দেওয়া যায়।

হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানে ঢুকে স্পিকার বন্ধ করি। বনে উচ্চশব্দ করা যাবে না। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বসতি নাই, দোকানপাট নাই। মাঝেমধ্যে কিছু গাড়ি হনহন করে ছুটে যায়। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার অজানা আশঙ্কা তৈরি হয় মনের মধ্যে। 

সবকিছু খোয়াতে হতে পারে ভাবতে ভাবতে একসময় একটা প্যারাসেইলিং সংলগ্ন এলাকায় চলে আসি। টেকনাফ থেকে হেঁটে আসছি শুনে সেখানকার ক্যাফেতে তারা বসালেন। আমাদের হেঁটে হেঁটে হজ করতে যাওয়ারও পরামর্শ দিলেন তারা।

রাত সাড়ে ১১টার দিকে কলাতলী মোড়ে পৌঁছে অ্যাপস অফ করি। বিকেল থেকে মোট ২৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার হাঁটা হলো। 

কয়েকদিন ধরে হোটেল-রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে ঘরের খাবার খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল। তাই রাত ৯টার দিকে আমাদের বন্ধু আজমিনা তোড়াকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম রাতের খাবারের আয়োজন করতে। তোড়া চাকরি সূত্রে কক্সবাজার থাকে। 

একটি হোটেলে গিয়ে রুম নিয়ে দ্রুত রেডি হয়ে শিকদার পাড়ায় তোড়ার বাসায় যাই। সেখানে হরেক রকম মজাদার খাবার খেয়ে হোটেল রুমে পৌঁছাতে রাত আড়াইটা বেজে যায়।

অফ সিজন থাকায় কক্সবাজারে হোটেল ভাড়া বেশ কম পেলাম। ৪ জনের জন্য ১টা এসিরুম ভাড়া মাত্র ১৫০০ টাকা। 

বুধবার দুইবার মিলিয়ে মোট ৩৮ দশমিক ৯ কিলোমিটার হাঁটা হয়েছে। ক্লান্ত শরীরে খুব দ্রুতই নিদ্রা দেবীর কোলে ঢলে পড়লাম।

Comments

The Daily Star  | English

Palak admits shutting down internet deliberately on Hasina's order

His testimony was recorded by the International Crime Tribunal's investigation agency following a questioning session held yesterday

17m ago