হেঁটে বাংলাদেশ: চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা

কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে যাত্রা। শুরু করতে বেশ দেরি হয়ে গেল। হোটেলে চেক-আউট করে দুপুর ১২টা ২৩ মিনিটে হাঁটা শুরু করি। আজ (সোমবার) থেকে অবশ্য ভাড়া করা হায়েস মাইক্রোবাসটি আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। হাঁটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সঙ্গে থাকবে। এটাই আমাদের ক্যারাভান।

আমাদের বন্ধু মেসাইংউ মারমা অর্গানিক শরবত বানিয়ে নিয়ে আসে; শরবত খেয়ে চাঙ্গা হয়ে রওয়ানা দেই।

কলাতলী মোড়ে, যেখানে মেরিন ড্রাইভ শুরু হয়েছে— সেখান থেকে হাঁটা শুরু করি। আকাশ মেঘলা থাকায় রোদ একেবারেই ছিলো না। বেশ দ্রুত এগুতে থাকি। শহরের রাস্তায় এই এক্সপেডিশনে প্রথম হাঁটা। মহাসড়কেও প্রথম দিনের মতো। মহাসড়ক ধরে হাটা ব্যাপক যন্ত্রণাদায়ক। ইজিবাইক, রিকশা, সিএনজি চালিত অটোরিকশা এসে ডাকে, জিজ্ঞেস করে কোথায় যাবেন। ওদের বোঝানো কষ্টের যে আমরা হাঁটতে বেরিয়েছি। বললেও বিদ্রুপের হাসি দেয়। 

কক্সবাজার টার্মিনালে বাসের হেলপাররা পারলে গাড়িতে উঠিয়ে ফেলে। আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ওদের শোনার সময় নেই। এরা ভাবছে, আমরা ভাড়ার টাকার অভাবে হাঁটছি। একজন ৬০ টাকা কমে চট্টগ্রাম নিয়ে যেতে সাধছিল। সব এড়িয়ে সামনে এগোতে থাকি। 

কক্সবাজার চট্টগ্রাম মহাসড়ক সিঙ্গেল রাস্তা, খুব ব্যস্ত। হাঁটার জন্য ফুটপাত বলতে কিছু নেই। পুরাটাই লতা-গুল্মের দখলে। আর আছে কাদা, বৃষ্টির জমে যাওয়া পানি। দ্রুত হাঁটা অনেকটা বাধাপ্রাপ্ত হয়।

একসময় বাঁকখালী নদীর ব্রিজ অতিক্রম করি। মিয়ানমার থেকে আসা কিছু স্রোতধারা বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়িতে মিলিত হয়ে বাঁকখালী নাম নিয়েছে। নদীটি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা ও কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মহেশখালী চ্যানেলে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এই নদীর মোহনায় থাকা ঘাট থেকে মহেশখালী যেতে হয়। 

রেললাইনের কাজ কক্সবাজার পর্যন্ত চলে এসেছে। দ্রুত এগিয়ে চলছে কাজ। পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধায় এই রেললাইন ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

স্থানীয় একটা বাজারে ফেরিওয়ালা একটা ফল বিক্রি করছিল। দেখতে সবুজ মাকাল ফল। আনারকলি নামে কক্সবাজার অঞ্চলে প্রচলিত। কতবেলের মতো করে চিনি, মরিচের গুড়ো ঢুকিয়ে চামচ দিয়ে খেতে হয়। কক্সবাজারের পাহাড়ে এই ফল পাওয়া যায়। ইন্টারনেট ঘেটে এই ফলের আসল নাম জানলাম 'প্যাশন ফ্রুট'। 

বৃষ্টি শুরু হলে রাস্তার পাশে একটা রেস্তোরাঁয় দুপুরের খাবার খেয়ে নেই। দেশি মোরগ ও হাঁস দিয়ে খাই। খুব ঝাল ছিল। এখানকার রেস্তোরাঁগুলোতে রান্নাকরা তরকারি হাঁড়ি এবং কড়াইতে সাজিয়ে সামনে রাখে। 

হাঁটতে থাকি। রাস্তার পাশে তেচ্ছিরপুল জামে মসজিদের পুকুর দেখে সাঁতার কাটার লোভ জাগে। দ্রুত নেমে পড়ি। ৪০ মিনিটের মতো পানিতে ছিলাম। পুকুরে বেশকিছু শাপলা ছিল। যদিও ফুলগুলো তখন ফুটন্ত ছিল না। অনেকদিন পর পুকুরে গোসল করলাম। সাঁতার কাটায় পায়ের ব্যথা অনেকাংশে কমে গেছে। 

রামু বাইপাস পয়েন্টে দৃষ্টিনন্দন ফুটবলের ভাস্কর্য। সোজা রাস্তা রামু চলে গেছে। বামদিকে চট্টগ্রাম। একটা টং ঘর থেকে ডাব খেয়ে নেই। চা বাগান নামে একটা এলাকা পড়ে। কিন্তু ওই এলাকায় কোনো চা বাগানের অস্তিত্ব নেই। বয়ষ্ক দুজন লোককে জিজ্ঞেস করলে জানান, তারা কখনো চা বাগান দেখেননি। ব্রিটিশ আমলে ছিল, এখন নেই। 

অন্ধকার হয়ে গেলে ভেস্ট ও হেডল্যাম্প পরে নেই। রামু রাবার বাগানের মধ্য দিয়ে রাস্তা। চারপাশে ঘন বন। আশপাশের ডোবা থেকে ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছিল। অল্প কিছু জোনাকি পোকাও ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হেডল্যাম্প অফ করে নেই। একটা কালভার্টে বসে ব্যাঙের ডাক ও জোনাকির আলো উপভোগ করতে থাকি। আমার বেড়ে উঠা গ্রামে। শৈশবে এগুলো নিয়মিত দেখতাম। জোনাকি পোকা এখন প্রায় বিলুপ্ত, দেখাই যায় না।

প্রথম ৮-১০ কিলোমিটার বেশ দ্রুত হাঁটা যায়। পরে গতি কমে যায়। আকাশ মেঘলা থাকায় হাঁটতে কোনো বেগ পেতে হয়নি। খুব একটা ঘামেনি। 

লক্ষ্য ছিল ৪০ কিলোমিটার হাঁটার। একবার অ্যাপ বন্ধ করে বিশ্রাম নিয়ে হাঁটা শুরুর পর চালু করতে ভুলে যাই। বেখেয়ালের জন্য হাঁটা পরিমাপের অ্যাপ স্ট্রভায় প্রায় ৩ কিলোমিটার কম আসে। মাইলফলকে কক্সবাজার দেখাচ্ছিল ৩১ কিলোমিটার দূরে। বৃষ্টি শুরু হলে হাঁটা থামিয়ে দেই। স্ট্রভায় হাটার পরিমাণ দেখায় ২৮ দশমিক ২৮ কিলোমিটার। 

এখান থেকে কক্সবাজার ও চকরিয়া প্রায় সমান দূরত্বে। হোটেল ভাড়া সস্তা, তাই কক্সবাজারে ফেরার সিদ্ধান্ত নেই। কক্সবাজার ছেড়ে আসলেও আবার ফিরি। এই নিয়ে ৬ রাত কক্সবাজার থাকা হলো। 

 

ছবি: বিনয় ভদ্র ও আশানুর রহমান খান

 

Comments

The Daily Star  | English
Adani

Adani, under bribery scrutiny, pressed by Bangladesh to reopen power deal

Bangladesh's interim govt has accused Adani Power of breaching a multi-billion-dollar agreement by withholding tax benefits

2h ago