সামরিক নয়, অর্থনৈতিক যুদ্ধে চীন বিপদে ফেলবে তাইওয়ানকে

'যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত সবাই চাপ দেবে যেন বাংলাদেশ তার পক্ষে থাকে। পরিস্থিতি সামরিক সংঘাত বা যুদ্ধাবস্থায় যাবে বলে মনে হয় না। চীন এই যুদ্ধে জড়াতে চাইবে না। তবে তাইওয়ানকে বড় পরিসরে অর্থনৈতিকভাবে বিপদে ফেলার চেষ্টা করতে পারে চীন। কারণ চীনের সেই সক্ষমতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে তেমন কোনো সহায়তা করতে পারবে না।'

কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান।

যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনায় হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে তা ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। চীনের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও কেন পেলোসি তাইওয়ানে গেলেন? যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনায় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রভাব কী? বাংলাদেশেই বা কেমন প্রভাব পড়তে পারে?

দ্য ডেইলি স্টারের প্রশ্নের বিশ্লেষণ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান।

দ্য ডেইলি স্টার: চীনের পক্ষ থেকে তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও তাইওয়ানে মার্কিন হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ ন্যান্সি পেলোসি সফর করলেন। যুক্তরাষ্ট্র-তাইওয়ান-চীনের উত্তেজনা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে এই সফরের তাৎপর্য কী?

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে কৌশলগত প্রতিযোগিতা রয়েছে, যা বর্তমানে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। সেটাকে ধরে চীনকে নতুন একটি বার্তা দেওয়া যে, সব শর্ত যুক্তরাষ্ট্র নির্ধারণ করতে পারে। এ ছাড়া, তাইওয়ানকে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাতে নতুন মাত্র যোগ করলো।

অল্প কথায় বলতে গেলে, এটা 'এক চীন নীতি'র বাইরে যাওয়া। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দেয়নি, তবে বার্তাটা এর কাছাকাছি। বিশেষ করে যেখানে চীন সরকারের পক্ষ থেকে কেবল আপত্তি জানিয়েই শেষ করা হয়নি, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন এই সফরের আগে। তারপরও যখন পেলোসি তাইওয়ান সফরে গেলেন, তার মানে যুক্তরাষ্ট্র এটাকে খুব গুরুতর একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করতে চাচ্ছে।

যদিও তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন বলেছেন এটা ব্যক্তিগত সফর, কিন্তু এটা কূটনৈতিক বক্তব্য। ন্যান্সি পেলোসির এই সফর কোনোভাবেই ব্যক্তিগত হওয়ার কথা না। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে পদমর্যাদার হিসেবে পেলোসির অবস্থান তৃতীয়। তিনি মার্কিন সামরিক বাহিনীর রেজিস্টার্ড এয়ারক্রাফটে সেখানে গিয়েছেন। এর একটা গভীর তাৎপর্য আছে। দুই দেশের ভেতরে যে ধরনের কৌশলগত প্রতিযোগিতা আছে, সেটা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেল।

ডেইলি স্টার: চীন এই অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় যে শক্তি প্রদর্শন করছিল, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র কি ছোট ছোট অন্য দেশগুলোকে নতুন কোনো মেসেজ দিলো?

মুনীরুজ্জামান: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাইওয়ানের যে সম্পর্ক সেটা অন্য কারো সঙ্গে নেই। এই কারণে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্ক মেলানো ঠিক হবে না। তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রিটি চুক্তি আছে। তাইওয়ানের মর্যাদা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে একেবারেই আলাদা। চীনের কৌশলগত 'ওয়ানম্যানশিপ' খেলার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র 'ওয়ানম্যানশিপ' দেখালো যে, আমি তোমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে সেখানে গেলাম। এটা হয়তো চীন আবার অন্য কোথাও দেখিয়ে দেবে। কৌশলগত প্রতিযোগিতার যে ধারা, সেটার মধ্যেই এই খেলাটা হচ্ছে।

ডেইলি স্টার: এটা কি যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে যেতে পারে?

মুনীরুজ্জামান: চীন যতটা বাস্তববাদী এবং আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে তার যে যোগাযোগ, পাশাপাশি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে আন্তঃনির্ভরশীলতা আছে, তাতে এটা সংঘাতপূর্ণ বা যুদ্ধ পর্যায়ে যাবে বলে আমি মনে করি না। তবে সংঘাতপূর্ব পর্যায়ে যতটুকু প্রদর্শন করা যায়, ততটুকু চীন হয়তো করার চেষ্টা করবে। আপনি দেখছেন যে তারা কিছু লাইভ ফায়ার ড্রিল করছে এবং সেটাও তাইওয়ানের জলসীমা ও আকাশসীমার প্রায় ভেতরে।

এ ক্ষেত্রে নতুন যে দুটি বিষয় লক্ষ্য করছি তা হচ্ছে, চীন সাইবার অ্যাটাক শুরু করছে। আরেকটা নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে, চীন তাইওয়ানকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলবে বলেছে।

ডেইলি স্টার: যুক্তরাষ্ট্র এভাবে তাইওয়ানে পাশে থাকার পরও চীনের পক্ষে অর্থনৈতিকভাবে চাপ তৈরি করা সম্ভব?

মুনীরুজ্জামান: তাইওয়ানকে অর্থনৈতিকভাবে বিপদে ফেলার ক্ষমতা চীনের আছে। চাইলে তাইওয়ানকে বড় পরিসরে বিপদে ফেলতে পারবে চীন। কারণ চীনে এখন তাইওয়ানের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আছে। এ ক্ষেত্রে চীন যদি চাপ দিতে চায়, তাহলে তাইওয়ানের ইন্ডাস্ট্রি বা ট্রেডিংয়ের ওপর বড় ধরনের আঘাত আসতে পারে।

ডেইলি স্টার: সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয় তাইওয়ানকে রক্ষা করবে?

মুনীরুজ্জামান: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে পুরোপুরি রক্ষা করতে পারবে না। এটা তো চীনে তাইওয়ানের সরাসরি বিনিয়োগ। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে দুটো দেশই আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থায় গভীরভাবে সম্পৃক্ত।

ডেইলি স্টার: আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিকভাবে এর কী প্রভাব পড়তে পারে?

মুনীরুজ্জামান: উদ্বেগটা এখন বেড়ে গেল। আমাদের এই অঞ্চলে যে কৌশলগত উদ্বেগ বিরাজ করছিল, সেটার মাত্রা বেড়ে গেল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে সমস্যাগুলো আমরা ইতোমধ্যে দেখছিলাম, তার মধ্যে আরও বেশ কিছু জটিলতা চলে এলো।

আমরা এটাও জানি, এমন কিছু পণ্য চীন ও তাইওয়ানের কাছে আছে যেগুলো সরবরাহে কোনো ধরনের সমস্যা হলে তার প্রভাব সারা পৃথিবীতে পড়বে। যেমন তাইওয়ানের চিপ তৈরির সক্ষমতা বিশ্বে এক নম্বর। এখানে সমস্যা হলে কম্পিউটার, গাড়ি থেকে শুরু করে সবকিছুতে এর প্রভাব পড়বে। আমাদের সবচেয়ে সতর্কভাবে যেটা দেখতে হবে সেটা হচ্ছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের কোনো আঘাত আসছে কি না।

ডেইলি স্টার: সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে?

মুনীরুজ্জামান: চীন আমাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার, এক নম্বর বাণিজ্যিক অংশীদার। সেখানে যদি সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো সমস্যা হয় তাহলে তার প্রভাব বাংলাদেশে অবশ্যই পড়বে। সেই সম্ভাবনা তো আছেই।

যদি কোনো সরবরাহ ব্যবস্থায় সমস্যা হয়, অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর এর প্রভাব পড়ে কিংবা বাণিজ্যিক রুটে উদ্বেগ বৃদ্ধি করে। এতে করে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ইনস্যুরেন্সের রেট বেড়ে যায়, এর সঙ্গে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। যেহেতু চীন আমাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার, আমাদের খুব সতর্কভাবে দেখতে হবে যে কোনো জায়গাতে কোনো ধরনের রিপল ইফেক্ট আসছে কি না।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এ অঞ্চলে ইতোমধ্যে কিছু টেনশন আছে। বিশেষ করে চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে। এখানে বড় একটা বিতর্কিত স্থল সীমান্ত আছে, যেখানে যেকোনো সময় উত্তেজনা তৈরি হতে পারে। কাজেই একটা জায়গায় যখন কৌশলগত চাপ আসে, তখন অন্য জায়গায় তা প্রয়োগ করার চেষ্টা করে। এটা দেখতে হবে, এর সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো জায়গায় কৌশলগত চাপ প্রয়োগ করে কি না।

যেমন আমরা দেখতে পাচ্ছি ইতোমধ্যে ডোকলামে একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ডোকলাম কিন্তু আমাদের একেবারে কাছে। আমাদের জিওস্ট্র্যাটেজিক লোকেশনের কাছাকাছি যেসব সম্ভব্য চীন-ভারত টেনশন আছে, ওই জায়গাগুলোতে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। পরিস্থিতি খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে কি না তা বিবেচনায় রাখতে হবে।

ডেইলি স্টার: বাংলাদেশের তো যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখার একটা ব্যাপার আছে। সেটা কী বর্তমান পরিস্থিতিতে বেশ কঠিন মনে হচ্ছে?

মুনীরুজ্জামান: আমাদের যে নেভিগেশন স্পেস, তা আরও জটিল হয়ে যাচ্ছে। আমরা যে 'সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়' নীতি মেনে চলছি এখন পর্যন্ত, সেই জায়গাটা আরও জটিল ও ছোট হয়ে আসছে। এখানে বিরোধী সবাই উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। সবাই আশা করবে, এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ তাদের পক্ষে থাকবে। কিন্তু আমরা তো কারো পক্ষে প্রকাশ্যে থাকতে চাই না। নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার চাপ বেড়ে যাচ্ছে। সবদিক থেকে চাপ বেড়ে যাবে। সবাই চাইবে যে আমরা তাদের সঙ্গে থাকি। পক্ষে না থাকলেও, আশা করবে যে আমরা কারো পক্ষে যাব না।

কাজেই এ ক্ষেত্রে কতটুকু সামলে চলা যাবে তা আমাদের দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে। খুবই সতর্কতা, সক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে আমাদের। যেন আমরা কোনোভাবেই প্রকাশ্যে কারো পক্ষে অবস্থান না নিয়ে ফেলি।

Comments

The Daily Star  | English

‘Shockingly insufficient’

"The proposed decision to allocate USD 250 billion per year for all developing countries is shockingly insufficient," said the adviser

1h ago