ডিজিটাল ডিভাইস আসক্তি দূর করার উপায়

কোনো কিছু জানতে গুগল করা, বন্ধুকে মেসেজ করা, কিংবা গ্রুপচ্যাটের মেসেজের টুংটাং। ফোন হাতের কাছে পেলে তখনই রিপ্লাই। দুই মিনিট দেরি হলেই যেন সব শেষ!

প্রযুক্তি পরিচর্যা সংস্থা অ্যাসুরিয়ন পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারীরা দিনে গড়ে ৯৬ বার তাদের ফোন চেক করেন৷ যা প্রতি ১০ মিনিটে একবার। মুদি দোকান কিংবা হাট বাজার হাটা দূরত্বে হলেও নিত্যব্যবহার্য জিনিসের জন্যও অনলাইন নির্ভরতা তো আছেই। এরপর তো ফোন কিংবা ল্যাপটপের কিছু হলে মাথা খারাপ হওয়ার দশা।

ডিজিটাল ডিটক্স প্রযুক্তি এবং ডিভাইসের প্রতি আসক্তি প্রতিরোধে সাহায্য করে। ডিজিটাল ডিটক্স হল এমন একটা সময়সীমা যেখানে একজন ব্যক্তি ইন্টারনেট কানেক্ট করা যায় এমন সমস্ত যন্ত্র যেমন স্মার্টফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার থেকে দূরে থাকেন। নিজের জন্য একটি সময়সীমা ঠিক করে (হতে পারে কয়েক ঘণ্টা কিংবা কয়েকদিন) এই সমস্ত স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ দূরে সরিয়ে রেখে এই সময়টায় ইন্টারনেট থেকে, সোশ্যাল মিডিয়া, টেলিভিশন এবং ভিডিও গেমস থেকে সম্পূর্ণ ডিসকানেক্ট করে নেন নিজেকে।

প্রতিমুহূর্তে বিশ্বে কী ঘটছে তা নিয়ে ক্রমাগত আপডেট থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সারাক্ষণ প্রযুক্তিও বিভ্রান্তিকর, ক্ষতিকর।

ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ভার্চুয়াল এনভায়রনমেন্ট কমিউনিকেশন টেকনোলজি অ্যান্ড অনলাইন রিসার্চ প্রধান জেসি ফক্স বলেন, 'যদি আধ ঘণ্টায় ৫ মিনিট পর পর নিজেকে এভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ দেন তাহলে পুরো সময় আসলেই আপনি কোনো কাজে মনোনিবেশ করেননি।'

কেনো প্রয়োজন ডিজিটাল ডিটক্স

শারীরিক ও মানসিক উভয়ক্ষেত্রেই প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের নেতিবাচক প্রভাব বেশ তীব্র।

ডেলয়েট পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৫৯ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ঘুমোতে যাওয়ার ৫ মিনিটের মধ্যে এবং ঘুম থেকে ওঠার ৩০ মিনিটের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম চেক করেন৷ প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহার ঘুমের গুণমান হ্রাস, চোখ টনটন করা, মাইগ্রেন, দৃষ্টিশক্তির সমস্যাসহ নানারকম জটিলতা সৃষ্টি করে।

ঘুমের উপর সেলফোন, কম্পিউটারের মতো জনপ্রিয় ডিভাইসের প্রভাব গবেষণায় দেখা যায়, স্ক্রিন থেকে নির্গত আলো মেলাটোনিন (একটি গুরুত্বপূর্ণ জৈব নিয়ন্ত্রক রাসায়নিক যা ঘুমের সময় এবং ধরণকে নিয়ন্ত্রণ করে) হরমোনের উৎপাদনকে প্রতিহত করে। ফলে ব্যাঘাত ঘটে স্বাভাবিক ঘুমে।

কম্পিউটারের সামনে বসে বসে কাজ করার ফলে যেহেতু শারীরিক পরিশ্রম হয় না। বরং ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চিপস, ফ্রোজেন আইটেম, কোল্ডডিংক্স ঠিকই খাওয়া হয়। ফলে শরীরে জমছে অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট। বাড়ছে ডায়াবেটিস, স্থূলতার ঝুঁকি।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, সোশ্যাল মিডিয়াতে তো সামাজিক মিথস্ক্রিয়া হচ্ছে। পরিবার, বন্ধুরা কে কোথায় কী করছে তা দেখছি, কমেন্ট করছি। কিন্তু বাসায় সবচেয়ে কাছের মানুষগুলো ঠিক কেমন আছে সে খোঁজ কজন নিচ্ছে বা নিজের খোঁজ কেউ নিচ্ছে কিনা সেটাও ভাবা জরুরি। সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটাতে গিয়ে সামনের মানুষটার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে ভুলে যাওয়ার ফলে বাড়ছে অভিমান, ভুল বুঝাবুঝি।

অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে যা পোস্ট করেন, সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা কিংবা জীবন নিয়ে যে রকম উদ্দীপনা দেখান তা নিজের সঙ্গে না মিললে মনে হয় নিজের জীবনের উদ্দীপনা কম, আনন্দ নেই, তৈরি হয় হতাশা, হীনমন্যতা।

৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক তরুণের উপর করা একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, তারা যত বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেছে, তাদের জীবন নিয়ে সন্তুষ্টির মাত্রা তত বেশি কমে গেছে। কারণ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং অন্যদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে উৎসাহিত করে। তাই, প্রযুক্তি তাদের আত্মসম্মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

পৃথিবীতে এ নিয়ে হাজার হাজার গবেষণায় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, প্রযুক্তি থেকে ছুটি নেওয়ার ফলে তাদের স্ট্রেস কমে গিয়ে মানসিক শান্তি ফিরে এসেছে।

নিয়মিতভাবে এই ডিজিটাল ডিটক্স আইআরএল (ইন রিয়েল লাইফ)  অর্থাৎ বাস্তব জীবন এবং নেট দুনিয়ার সঙ্গে একটি সুস্থ ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।

মোটকথা, ডিজিটাল ডিটক্স হলো প্রযুক্তি বিচ্ছিন্ন হওয়ার মাধ্যমে জীবন সংযুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া।

ডিজিটাল ডিটক্স এর কৌশল

চাইলেই ডিজিটাল ডিটক্স শুরু করা খুব সহজ না। তবে ধীরে ধীরে এগোনো সম্ভব।

১. প্রথমেই ঘনঘন ফোন চেক করার অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শুরুতেই অসম্ভব একটা টার্গেট না নিয়ে প্রথম দিন ২০ মিনিট ফোন, ল্যাপটপ চেক না করা দিয়ে শুরু করা। পরের দিন সেটা হতে পারে আধা ঘণ্টা বা ২০ মিনিটের একাধিক ব্রেক। ধীরে ধীরে বাড়িয়ে অর্ধেক দিন বা সপ্তাহের অন্তত একটি দিন ফোন, কম্পিউটার ছাড়াই থাকার চেষ্টা।

এছাড়াও শারীরিক ব্যায়াম, খাওয়া,শপিংয়ের সময়েও মনস্থির করে রাখা ফোনের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। ছোট ছোট টার্গেটে অভ্যস্ত হতে পারলে তা মেনে চলা সহজ হবে।

২. স্ক্রিন টাইম নির্দিষ্ট করতে হবে। গুগলে কোনো উত্তর খোঁজা, সময় কিংবা তারিখ চেক করা, মেসেজ দেওয়া এসব কাজে বার বার ফোন বা ল্যাপটপ না নিয়ে ডায়েরীতে টুকে সব একসঙ্গে স্ক্রিন টাইমের মধ্যে শেষ করতে হবে।

বেশিরভাগ সময় ফোন স্ক্রল করা হয় পরিত্রাণের  মাধ্যম হিসেবে। ঠিক মুখের সামনে যা ঘটছে, তা থেকে নিজেকে এড়িয়ে নেওয়ার বাসনায় বা একদল লোকের মাঝে একা লাগলে কিছু নিয়ে ব্যস্ততায় মুখ গুঁজে থাকতে। এরপর থেকে ফোন বের করে আনলক করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে, ফোনটা এখন কতটুকু প্রয়োজন। নিজের কাছে সদুত্তর পেলে তবে আনলক করা উচিত নাহলে আবার ব্যাগ বা পকেটে রাখতে হবে।

৩. মাঝে মাঝে ফোন বাড়িতে রাখার অভ্যাস করা যায়। অনেক সময়ই ফোন না নিয়ে বের হলে কোন অসুবিধা হয় না। বরং নিজেকে সময় দেওয়া যায়। অন্যদের সঙ্গে যেকোনো সময় যোগাযোগ করতে পারাটা আসলে কতটা দরকার সেটা অনেক সময়ই নিজেদের অনুমাননির্ভর।

৪. সেটিংসে গিয়ে জরুরি ছাড়া অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন অফ করে দেওয়া। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে বেশিরভাগ 'জরুরি' আমাদের কল্পনা। নোটিফিকেশন ছাড়া থাকা অভ্যাস করলে দেখা যাবে, অনেক 'জরুরি' আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হবেনা।

৫. সবকিছুতেই সন্তুষ্ট থাকার মনোভাবও থাকতে হবে দৃঢ়।

৬. অবসর সময়ে ফোন রেখে প্রাধান্য দিতে হবে বই।

৭. রাতে খাবার সময় খাবার টেবিলে সবাই যাতে তাদের সারাদিনের ঘটনা বলতে পারে। ডাইনিং রুম, বেডরুম করতে হবে ফোন, ল্যাপটপ বা টিভির 'নো এন্ট্রি জোন'। একই সঙ্গে বাড়ির নির্দিষ্ট অংশ সাজিয়ে ফেলা যায় বই কিংবা বিভিন্ন ধরনের ইনডোর গেম দিয়ে।

৮. বাচ্চাদের মোবাইল আসক্তি এড়াতে তাদের নিয়ে বাইরে যাওয়া, পার্কে-মাঠে দৌঁড়ে খেলতে উৎসাহ দিতে হবে।

সবকিছুই নির্ভর করে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকার উপর।

যতক্ষণ আমরা ফোন দেখছি, মেইল বা নোটিফিকেশন চেক করি ততক্ষণ 'লিভিং ইন দ্য মোমেন্ট' বা বাস্তবের মাটিতে থাকি না। ফোন থেকে দূরে থাকার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানো শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একবার দেখা উচিত কত সুন্দর, কত ছোট ছোট জিনিস মিস করে যাচ্ছি আর জীবন থেকে কত মূল্যবান সময় প্রযুক্তিই কেড়ে নিচ্ছে।

ডিজিটাল জগত থেকে দূরত্ব তৈরি করতে পারলেই প্রিয় সম্পর্কগুলো আবার বেঁচে উঠবে। একে অপরের সঙ্গে শুধু ফেসবুকে নয়, ইমোশনালি কানেক্ট করতে পারলে আবার প্রাণ ফিরে আসবে জীবনঘনিষ্ঠ আড্ডায়।

Comments

The Daily Star  | English

What if the US election ends in a Trump-Harris tie?

While not highly likely, such an outcome remains possible, tormenting Americans already perched painfully on the edge of their seats ahead of the November 5 election

2h ago