চবিতে যৌন নিপীড়ন: অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাসে গত ১৭ জুলাই রাতে এক নারী শিক্ষার্থীকে যারা যৌন নিপীড়ন করেছেন, তারা ছাত্রলীগের কর্মী। পুলিশ ও চবি শাখা ছাত্রলীগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

হাটহাজারী থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রত্যক্ষদর্শী ও যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ থেকে আমরা জানতে পেরেছি, অভিযুক্তরা সবাই ছাত্রলীগ কর্মী। কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজ থেকে এখনো তাদের চেহারা শনাক্ত করা যায়নি।'

চবির প্রক্টর অফিস সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১৩৫টি সিসিটিভি ক্যামেরা রয়েছে। তবে সেগুলোর মধ্যে অর্ধেকের নাইট ভিশন আছে।

হাটহাজারী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, 'এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে আমরা কাজ করছি। সিসিটিভি ফুটেজ অপরিষ্কার ও নিম্নমানের হওয়ায় তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে আমার টিম কাজ করছে এবং আমরা আশা করছি খুব শিগগির ফলাফল পাব।'

তবে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রলীগ কর্মীদের জড়িত থাকার বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়েছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চবি প্রশাসনের গাফিলতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

ঘটনার পর চবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা ফেসবুকে বর্তমান ছাত্রলীগ নেতাদের ভূমিকার সমালোচনা করে যৌন নিপীড়নকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

১৭ জুলাইয়ের ঘটনায় ওই নারী শিক্ষার্থী বাদী হয়ে বুধবার রাতে অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে হাটহাজারী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।

মামলার বিবৃতিতে তিনি বলেন, রোববার রাতে ৫ জনের একটি দল তাকে ও তার বন্ধুকে জোরপূর্বক হতাশার মোড় থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে তুলে নিয়ে যায়।

তারা প্রথমে দুজনকে মারধর করে এবং পরে বাদীকে বেঁধে যৌন নিপীড়ন করে। তার বন্ধু তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে যৌন নিপীড়নকারীরা তাদের একটি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায়।

এ ঘটনায় থানায় মামলা করার আগে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী প্রক্টর অফিসে লিখিত অভিযোগ করেন।

চবি প্রশাসন অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে নারী শিক্ষার্থীদের 'এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে' রাত ১০টার টার মধ্যে হলে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

'প্রশাসনের গাফিলতি'

চবির শিক্ষার্থীরা জানান, অভিযোগ পাওয়ার পরেও প্রক্টরিয়াল বডি পুলিশকে যৌন নিপীড়নের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেনি।

তবে, প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা পুলিশকে জানালেও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী প্রাথমিকভাবে সহযোগিতা করতে রাজি হননি।

তিনি বলেন, 'ঘটনার একদিন পর সোমবার সকালে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী আমাদের কাছে আসেন। আমরা তৎক্ষণাৎ সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করা শুরু করি। কিন্তু সেই শিক্ষার্থী ঘটনাটি কখন ঘটেছে, তা নির্দিষ্টভাবে মনে করতে পারেননি। তখন আমরা তাকে পুলিশের কাছে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু প্রথমে তিনি মামলা করতে চাননি।'

প্রক্টর আরও বলেন, 'সেই শিক্ষার্থী রাজি হলে আমি ও ২ সহকারী প্রক্টর তাকে থানায় নিয়ে যাই।'

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল না বলেও দাবি করেন তিনি।

শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের বিচার ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে বুধবার রাতে ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন নারী শিক্ষার্থীরা।

বুধবার রাত ৯টার দিকে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হলের শিক্ষার্থীরা বের হয়ে হলের সামনে থেকে শহীদ মিনারের দিকে যেতে চাইলে প্রক্টরিয়াল বডি তাদের বাধা দেয়। এরপর অন্য ৩টি হল থেকে শিক্ষার্থীরা এসে প্রীতিলতা হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন। পরে তারা সবাই ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন।

৪ কর্মদিবসের মধ্যে বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান না করতে পারলে প্রক্টরিয়াল বডির পদত্যাগ দাবি করেন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীরা এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ৪ দফা দাবি পেশ করেছেন। দাবিগুলো হলো—ক্যাম্পাসে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা দিতে হবে। হল থেকে বের হওয়া বা প্রবেশের এবং মেডিকেলে যাওয়ার সময়সীমা তুলে দেওয়ার নির্দেশনা দিতে হবে; যৌন নিপীড়ন সেল ভেঙে নতুন কার্যকরী সেল গঠন করতে হবে। সেলে বিচারের ব্যবস্থা করার জন্য সর্বোচ্চ সময়সীমা থাকবে ১ মাস। সেটি না হলে সেলের শাস্তির বিধান গঠনতন্ত্রে থাকবে; যৌন নিপীড়ন সেলে চলমান কেসগুলোর বিচার করতে হবে আগামী ৪ কার্যদিবসের মধ্যে এবং ৪ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার না হলে প্রক্টরিয়াল বডি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি ও রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল ইসলাম ৪ দিনের মধ্যে এসব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে বুধবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান।

তবে নির্ধারিত সময়ে দাবি মানা না হলে আবারও আন্দোলন করবেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের বিচার ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা গতকাল বৃহস্পতিবার ক্লাস বর্জন করে র‌্যালি ও মানববন্ধন করেছেন।

বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় ক্লাস বর্জন করে প্রথমে তারা বিভাগের সামনে অবস্থান নেন। পরবর্তীতে র‌্যালি নিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে যান তারা। শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রায় ১৫ মিনিট অবস্থান করেন। এ সময় তারা দ্রুত সময়ের মধ্যে যৌন নিপীড়নের বিচার ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবি করেন।

তারা পরবর্তীতে র‌্যালিটি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে গিয়ে মানববন্ধন করেন। একই স্থানে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ব্যানারে আরেকদল শিক্ষার্থী একই দাবিতে মানববন্ধন করেন।

শিক্ষার্থী হেনস্তার বিচার ও নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতের দাবিতে গতরাতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেছে চবি ছাত্রলীগ।

রাত ৮টার দিকে সাবেক মেয়র আ জ ম নাসির উদ্দীনের অনুসারী নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিল শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখেন নেতা-কর্মীরা।

চবি ছাত্রলীগের বিবৃতি

সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে যৌন নিপীড়নের ঘটনার একদিন পর চবি ছাত্রলীগ সভাপতি রেজাউল হক রুবেলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল-নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য শৃঙ্খলা পরিপন্থি কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে চবি ছাত্রলীগ সভাপতিকে ৩ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন।

ছাত্রলীগের কেউ কেউ মনে করছেন, রুবেল ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দায়ের না করতে বলেছিলেন। এ কারণে তাকে এই নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

তবে, রুবেল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাংগঠনিক কিছু দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায় আমাকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমার প্রতিপক্ষরা এখন আমাকে ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করছে।'

তার দাবি, তিনি কাউকে অভিযোগ দায়ের করতে নিষেধ করেননি। বরং তিনি সরাসরি এক সহকারী প্রক্টর ও দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানান।

চবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তাদের একমাত্র পরিচয় হলো, তারা যৌন নিপীড়নকারী।'

চবি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. আলমগীর টিপু বলেন, 'যারা ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাদের অ্যাকাডেমিক ও আইনগতভাবে শাস্তি হওয়া উচিত। যদি কোনো নেতা এই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন, তাদেরকেও পদ থেকে প্রত্যাহার করা উচিত।'

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

8h ago