নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ‘অনিরাপদ’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সন্ধ্যার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের চলাচল 'অনিরাপদ' হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন চবি শিক্ষার্থীরা।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি হেনস্তার ঘটনা ঘটলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। নারী শিক্ষার্থীকে সর্বশেষ হেনস্তার ঘটনা ঘটে গত রোববার।
গতকাল বিকেলে হাটহাজারী মডেল থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ওই শিক্ষার্থী মামলা করেছেন। হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুহুল আমিন দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, ওই শিক্ষার্থীর মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ক্যাম্পাস, শাটল ট্রেন ও হলের সামনে কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী হেনস্তা হওয়ায় তারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের অভিযোগ, এসব ঘটনায় বিচার চেয়েও এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।
ডেইলি স্টারের চবি প্রতিনিধি জানান, নারী শিক্ষার্থী হেনস্তার ঘটনার বিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে গতকাল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছেন। সেখানে অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন।
পরে শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের বিচার ও নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে গতকাল রাত ৯টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে ছাত্রীরা বিক্ষোভ করেন। সেসময় তারা ৪ দফা দাবি জানান। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি ও রেজিস্ট্রার এস এম মনিরুল ইসলাম ৪ দিনের মধ্যে এসব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে রাত সাড়ে ১২টায় শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান।
তাদের দাবিগুলো হলো—ক্যাম্পাসে ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা দিতে হবে। হল থেকে বের হওয়া বা প্রবেশের এবং মেডিকেলে যাওয়ার সময়সীমা তুলে দেওয়ার নির্দেশনা দিতে হবে; যৌন নিপীড়ন সেল ভেঙে নতুন কার্যকরী সেল গঠন করতে হবে। সেলে বিচারের ব্যবস্থা করার জন্য সর্বোচ্চ সময়সীমা থাকবে ১ মাস। সেটি না হলে সেলের শাস্তির বিধান গঠনতন্ত্রে থাকবে; যৌন নিপীড়ন সেলে চলমান কেসগুলোর বিচার করতে হবে আগামী ৪ কার্যদিবসের মধ্যে এবং ৪ কার্যদিবসের মধ্যে গত রোববারের ঘটনার বিচার না হলে প্রক্টরিয়াল বডি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।
সূত্র জানায়, চলতি বছরেই শাটল ট্রেনে চবির ২ নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণচেষ্টা করা হয়েছে। একইসঙ্গে আরও কয়েকজন ক্যাম্পাসেই হেনস্তার শিকার হয়েছেন।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, যথাযথ নিরাপত্তার অভাব ও বিচারহীনতার কারণেই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
সূত্র আরও জানায়, গত রোববার রাত ১০টায় বন্ধুর সঙ্গে ক্যাম্পাসে হাঁটছিলেন চবির এক নারী শিক্ষার্থী। সে সময় অজ্ঞাতনামা ৫ ব্যক্তি তাদের মারধর, ছিনতাই ও নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করেন।
ঘটনার সময় হেনস্থাকারীরা ওই শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করেন বলে অভিযোগ ওই শিক্ষার্থীর। পরবর্তীতে তাদের দুটি মোবাইল ফোন, ৩ হাজার টাকা ও ব্যাগ ছিনতাই করে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায় অজ্ঞাত ব্যক্তিরা।
পরদিন প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করেন ওই শিক্ষার্থী।
কিন্তু ঘটনার ২ দিন পরেও কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে সিসিটিভি ক্যামেরায় সন্দেহভাজন মোটরসাইকেলের ফুটেজ পাওয়া গেছে বলে ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া।
মঙ্গলবার প্রক্টরকে আহ্বয়াক করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চবি কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া, গতকাল থেকে সব নারী শিক্ষার্থীদের রাত ১০টার মধ্যে হলে প্রবেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রক্টর।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, চবিতে যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম শাটল ট্রেন। আর সেখানেই নিয়মিত হেনস্তার শিকার হচ্ছেন নারী শিক্ষার্থীরা। বিশেষত রাতে যাতায়াতের বিষয়টি এক ধরনের 'আতঙ্কে'র হয়ে পড়েছে।
চলতি বছরের ১৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় শাটল ট্রেনে তৃতীয় বর্ষের এক নারী শিক্ষার্থীকে বহিরাগত ২ জন ধর্ষণের চেষ্টা করেন। এর ২ মাস পর ২৮ জুন সকালে শাটল ট্রেনেই বহিরাগত এক ব্যক্তি চবির অর্থনীতি বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। পরক্ষণে তাকে আটক করে থানায় সোপর্দ করা হয়।
অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ওই শিক্ষার্থী বলেন, 'নিজের ক্যাম্পাস বা নিজেদের শাটল ট্রেনেই যদি আমাদের এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, তাহলে এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিছু হতে পারে না। আমি এখনো সে দিনের ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারিনি।'
শিক্ষার্থীরা বলছেন, শুধু শাটল নয়, নিজ ক্যাম্পাসও নারী শিক্ষার্থীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। সন্ধ্যা হলেই তারা ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন।
সূত্র জানায়, গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর টিউশন শেষে ক্যাম্পাসে এসে হেনস্থার শিকার হন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ ও তৃতীয় বর্ষের ২ নারী শিক্ষার্থী। অভিযোগ পাওয়া যায়, চবি ছাত্রলীগের ৪ কর্মী—রাজু, ইমন, জুনায়েদ ও রুবেল তাদের হেনস্তা করেন। ওই ঘটনায় চবি যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেলের কমিটি গঠন করা হয়। ১০ মাসে পেরিয়ে গেলেও কমিটি কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি।
ওই শিক্ষার্থী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ও আমার সিনিয়র আপু গত বছর ক্যাম্পাসেই হেনস্তার শিকার হই। ১০ মাস পার হয়ে গেলেও হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। তারা ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, উল্টো প্রশাসন ১০টার আগে মেয়েদের হলে ঢোকার নির্দেশ দিচ্ছে। বিষয়টি এমন হচ্ছে যে, মাথাব্যথা হলে ওষুধের কথা না ভেবে মাথা কেটে ফেলতে হবে। এই বিচারহীনতাই দোষীদের আরও দোষ করতে উৎসাহ দিচ্ছে।'
এ বিষয়ে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নিরোধ সেলের সদস্য অধ্যাপক লায়লা খালেদা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কমিটিতে মানবাধিকারকর্মী, হাইকোর্টের আইনজীবী ও ইউজিসির সদস্যরা রয়েছেন, তাই একটু সময় লাগছে। একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছি, সেটি ভিসিকেও দেওয়া হয়েছে।'
চবি ছাত্রলীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির চবি কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হেনস্তাকারীরা কোনো দল বা সংগঠনের হতে পারে না। তাদেরকে আমি মানুষ হিসেবেই গণ্য করি না। ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে নিরাপত্তা জোরদার, পর্যাপ্ত আলো ও সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা দরকার।'
রবিউল হাসান ভূঁইয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কমিটি একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তবে মূল মিটিং এখনো বাকি। কমিটির সদস্যরা একত্রিত হতে সময় লাগছে বলে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি।'
'রোববার রাতের ঘটনায় ভিসি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। প্রক্টর, রেজিস্ট্রার ও শিক্ষার্থী উপদেষ্টাদের নিয়ে জরুরি মিটিংও ডেকেছিলেন মঙ্গলবার সকালে। প্রশাসন চেষ্টা করছে দ্রুত দোষীদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনতে', বলেন তিনি।
ক্যাম্পাস 'অনিরাপদ' হয়ে উঠছে; শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে যা করার, আমরা চেষ্টা করছি।'
এসব বিষয়ে জানতে চবি ভিসির নম্বরে ২ বার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
Comments