শিক্ষক হত্যা: অভিযুক্ত শিক্ষার্থী কিশোর গ্যাং সদস্য, স্কুল কমিটির সভাপতির নাতি
আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমারকে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।
স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে দ্য ডেইলি স্টার জানতে পেরেছে, অভিযুক্ত শিক্ষার্থী হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হাজী হজরত আলীর নাতি (ভাগ্নের ছেলে)।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অভিযুক্ত শিক্ষার্থী এলাকার কিশোরদের নিয়ে একটি 'কিশোর গ্যাং' পরিচালনা করে। মেয়েদের উত্যক্ত করার অভিযোগে কলেজে একাধিকবার তার বিচারও হয়েছে।
গত ২৫ জুন দুপুরে সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্কুল শাখার ছাত্রীদের আন্তঃশ্রেণি ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় খেলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বিদ্যালয়ের পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের শিক্ষক এবং শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি উৎপল কুমার সরকার (৩৭)। সে সময় ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থী অতর্কিত একটি স্টাম্প দিয়ে উৎপল কুমার সরকারের ওপর হামলা করেন। স্টাম্প দিয়ে উপর্যুপরি উৎপল কুমারের পেট ও মাথায় আঘাত করে তাকে রক্তাক্ত করে। এরপর সেখান থেকে চলে যায়।
এরপর সেই স্টাম্প হাতে কলেজের পেছনের মাঠে ঘুরলেও কেউ তাকে আটক করতে যায়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এই ঘটনাটি যাদের সামনে ঘটেছে তাদের মধ্যে ছিলেন বিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিষয়ের শিক্ষক সফিকুল ইসলাম। আজ মঙ্গলবার সকালে ঘটনার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, 'যখন ঘটনাটি ঘটে, আমি তখন মাঠের আরেক পাশে ছিলাম। আমি সেখানে পৌঁছে ওই শিক্ষার্থীকে বাধা দিতে গেলে সে বলে, "গায়ে হাত দিয়ে দেখ"। পরে তার সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে আগে উৎপল স্যারকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।'
অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর সম্পর্কে তিনি বলেন, 'সে এমনিতেই বখাটে স্বভাবের। তার পরীক্ষার ফলও ভালো না। সে নিয়মিত স্কুলে আসতো না, স্কুলের নিয়ম-কানুনও মানতো না। এসব নিয়ে স্কুলে অনেকবার বিচার বসেছে। শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হওয়ায় প্রায় সব বিচারেই ছিলেন উৎপল কুমার সরকার। তিনিসহ কমিটির সবাই অনেকভাবে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, তার অভিভাবকের সঙ্গেও কথা বলেছে।'
আজ দুপুর আড়াইটায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে সরেজমিনে দেখা যায়, একটি ছোট মাঠের দুই পাশে দুটি সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। পাশের তিন তলা ভবনে শিক্ষা কার্যক্রম চলে। মাঠটির পূর্ব পাশে এই হামলার ঘটনায় রক্ত পড়ে থাকার চিহ্নও রয়েছে।
উৎপল কুমারকে যে স্টাম্প দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল, সেটিও রয়ে গেছে স্কুলেই। স্টাম্পটি দেখান প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ।
সিসিটিভি ফুটেজ সম্পর্কে জানতে চাইলে স্কুলটির অফিস সহকারী আব্দুল আলিম বলেন, 'মাঠে আমদের ২টা সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। পুরো ঘটনাই রেকর্ড হতো। কিন্তু, ঘটনার সময় বিদ্যুৎ ছিল না। এ কারণে ঘটনাটির ভিডিও নেই।'
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ওই সময়ে বিদ্যুৎ না থাকার বিষয়ে আলিমের দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে মন্তব্য পাওয়া যায়।
ঘটনাটি ঘটেছিল দুপুর দেড়টার দিকে। স্থানীয়দের অনেকে বলছেন ওই সময় বিদ্যুৎ ছিল, অনেকে বলছেন ছিল না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পাশের এক দোকানমালিক বলেন, 'ওই সময় বিদ্যুৎ ছিল। শুনেছি অভিযুক্ত শিক্ষার্থী নাকি স্কুলের মেইন সুইচ বন্ধ করে দিয়ে এই কাজ করেছে, যাতে কোনো ভিডিও না হয়।'
ওই এলাকায় সে সময়ে বিদ্যুৎ ছিল কি না, জানতে চাইলে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১'র জামগড়া জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. মনির হোসাইন খান বলেন, 'এ তথ্য নিতে হলে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করতে হবে। এ ছাড়া তথ্য দেওয়া যাবে না।'
হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছেন, সে ভালো ছাত্র না। তার আচরণও ভালো না। সব সময় প্রভাব খাটাতো। কেউ তার কথা না শুনলে নানাভাবে শাস্তি দিতো। উৎপল স্যার এগুলো দেখে তাকে অনেকবার প্রিন্সিপালের কাছে নিয়ে গেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
একাদশ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সে দশম শ্রেণিতে পড়লেও একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীকে উত্যক্ত করতো। এ নিয়ে উৎপল স্যার প্রিন্সিপাল স্যারসহ তার পরিবারের কাছে অভিযোগ দেন। এ ঘটনায় স্কুল কমিটির সভাপতি হাজী ইউনুস আলীর ছেলে সুমন তাকে বকা দেন। সুমন সম্পর্কে তার মামা। এতেই রাগান্বিত হয়ে সে স্যারকে হত্যা করেছে।'
একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, স্কুলের শিক্ষার্থীদের চেয়ে বাইরের ছেলেদের সঙ্গে বেশি সময় চলতো সে। তার নেতৃত্বে একটি 'কিশোর গ্যাং' চলে। তাদের গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়স ১৭-১৮ এর মধ্যে।
তারা আরও জানায়, স্কুল কমিটির পরিচালক মো. সুমন অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবার মামাতো ভাই। সেই ক্ষমতা দেখিয়েই সে এত অপরাধ করে। তার অপকর্মে অনেকবার বিচারের জন্য বসা হলেও অজানা কারণে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মো. সাইফুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের স্কুল ও কলেজে ৫৫ জন শিক্ষক রয়েছেন। উৎপল স্যার এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। ঘটনার সময় আমি ছিলাম না। তবে ঘটনাটি শুনে দ্রুত স্কুলে আসি এবং গত দুই দিন তার সঙ্গে হাসপাতালেই ছিলাম। স্যারের অপারেশনে ৩০ ব্যাগ রক্ত লেগেছে। তবুও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।'
'অভিযুক্ত শিক্ষার্থী একদমই ভালো ছেলে না। উৎপল স্যারই অনেক সময় আমার কাছে তাকে ধরে আনতেন। আমিসহ বাকি স্যাররা বিচার করতাম। এসব নিয়ে তার অভিভাবককেও অনেকবার বলেছি, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি', বলেন তিনি।
এই ঘটনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'প্রাথমিকভাবে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া, আমরা তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করব।'
এত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সামনে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী যখন উৎপল কুমারকে আঘাত করল এবং সেখান থেকে চলে যাচ্ছিল, তখন কেন তাকে আটক করা হয়নি? এ প্রশ্নের জবাবে সাইফুল ইসলাম বলেন, 'শিক্ষকরা আহত উৎপল স্যারকে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। যে কারণে তাকে আটকানো সম্ভব হয়নি।'
এ বিষয়ে জানতে হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হাজী হজরত আলীর নম্বরে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। স্কুল কমিটির পরিচালক মো. সুমনের নম্বরে ফোন করলে তিনিও ধরেননি।
শিক্ষক হত্যার ঘটনায় আশুলিয়া মডেল থানায় গত ২৬ জুন একটি মামলা হয়েছে। মামলার পর দুই দিন পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
এ বিষয়ে আশুলিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম কামরুজ্জামান বলেন, 'আমাদের কয়েকটি টিম আসামিকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে। একইসঙ্গে এই ঘটনায় আর কেউ যুক্ত ছিল কি না, সে বিষয়ে তদন্ত চলছে। আশা করছি দ্রুত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হবে।'
আলামত হিসেবে হামলায় ব্যবহৃত স্টাম্পটি জব্দ করার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, 'স্টাম্প জব্দ করা হয়েছে।'
অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারের দাবিতে আজ সাভার উপজেলা চত্বরে মানববন্ধন করেছে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ। এ ছাড়া, চিত্রশাইল এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। মানববন্ধনকারীরা ঘটনার সময় সেখানে থাকা অন্য শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
Comments