বিপন্ন মানুষ ও আদার ব্যাপারীর জাহাজের খোঁজ নেওয়া

শুক্রবার সকালে ঘুমটা ভেঙেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকা বৃদ্ধি সংক্রান্ত যে খবরটা প্রথমে চোখে পড়েছে, সেটা আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য ভালো না মন্দ, তাই মেলানোর চেষ্টা করছিলাম। যদিও আমার মতো আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবরে কিছুই আসে যায় না।

এরপরেও জানার আগ্রহ বলে একটা কথা আছে। সেই উৎসাহেই জানতে চাইছিলাম। খবরটা হলো, 'সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা টাকার পরিমাণ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা।'

২০২১ সাল ছিল বিশ্বের জন্যই মন্দার বছর। ২০২০-২১ সাল ছিল করোনাকাল এবং সেইসময় বিশ্ব অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল। বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ করোনাকালে চরম অভাব-অনটনের মধ্যে দিন কাটিয়েছে। অনেক মানুষ কর্মহীন হয়েছে, বহু শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, কাজ হারিয়ে অনেকেই গ্রামে ফিরে গেছেন অথবা পথে পথে হাত পেতে খেয়েছেন। আমরা যারা কোনোভাবে সারভাইভ করেছি বা বেঁচে গেছি, তারা কোনোদিন এই ২ বছরের মহামারিকে ভুলতে পারবো না।

অথচ খবরে দেখছি এই করোনাকালেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। সেই মন্দা পরিস্থিতিতে এতো বিশাল অংকের টাকা বিদেশের ব্যাংকে যাওয়াটা চোখে পড়ার মতো ঘটনা অবশ্যই। এত টাকা আমাদের দেশের মানুষের আছে, যা তাদের নিজেদের দেশের ব্যাংকে রাখাও সমীচীন মনে করছেন না। তারা সেই টাকার গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য সুইস ব্যাংকের মতো উচ্চবংশীয় ব্যাংকে রাখাটাকে ভালো মনে করছেন।

আমরা যারা সাধারণ মানুষ, অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ বুঝি না, তারা যা কিছু খবর পাই সব গণমাধ্যম মারফত। আর নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পারি, সৎ পথে টাকা আয় করে সেই টাকা সঞ্চয় করাটা কতখানি চ্যালেঞ্জের।

একদিকে দেশের টাকা বিদেশি ব্যাংকে জমা হচ্ছে, অন্যদিকে এরচেয়েও বেশি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমরা নানান কাজের জন্য বিদেশ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছি। সেই ঋণের বোঝা যুগের পর যুগ ধরে সাধারণ মানুষ টেনে নিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের একটি দেশের মানুষের পক্ষে মহামারি চলাকালে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা হওয়াটা কি বিস্ময়কর নয়?

এতো বিশাল অংকের টাকা বাংলাদেশ থেকে কীভাবে বিদেশে যায়? কেন যায়? কেন এই টাকাগুলো বা টাকার একটা বড় অংশ দেশে বিনিয়োগ করা হচ্ছে না? এর কারণ কি শুধু বিনিয়োগ করার মতো সুযোগ নেই, নিরাপত্তা নেই, নাকি ইচ্ছা নেই? নাকি দেশবাসীকে তারা দেখাতেই চান না টাকার প্রকৃত মালিক কে? অবশ্য সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের পাচার করা অর্থের ব্যাপারে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই।

প্রায় বছর ২-৩ আগে দুর্নীতি দমন কমিশন জানিয়েছিল যে অর্থপাচার নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মুখে সুইস ব্যাংকের তথ্য জানার জন্য তাদের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ নিতে দুদক সংশ্লিষ্ট বিভাগকে চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু অগ্রগতির কোনো খবর মেলেনি। আসলে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, এর প্রবাহ বন্ধ করা এবং অর্থ ফিরিয়ে আনা—এই দুটোর জন্যই যে ধরণের রাজনৈতিক ও আইনি কাঠামো দরকার, সেটা আমাদের এখানে অনুপস্থিত।

ভারত একটা সমঝোতা স্মারক করেছে, যার মাধ্যমে তারা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করে। দুদকও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিল যেন সুইস ব্যাংকের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের সমঝোতা করে। অর্থ পাচার বন্ধের জন্য গঠিত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট একবার গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল যে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশি যাদের টাকা জমা আছে, তাদের বেশির ভাগই বিদেশে থাকেন। সব টাকাই যে মানি লন্ডারিং হয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকে একজন আমেরিকানের কত টাকা আছে, তা জানা সম্ভব। কারণ বাংলাদেশ সরকার একটি চুক্তিতে সই করেছে যে, যদি আমেরিকান কোনো নাগরিক বাংলাদেশে বাড়ি কেনেন কিংবা ব্যাংকে টাকা রাখেন কিংবা বিনিয়োগ করেন, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক আইআরএসকে (আমেরিকান ইন্টারনাল রেভিনিউ সিস্টেম) জানাবে যে তার ওমুক নাগরিকের এখানে এই পরিমাণ টাকা আছে বা বিনিয়োগ করেছে।

আর আমেরিকার আইনে আছে, যদি তিনি ১০ হাজার ডলারের বেশি বাংলাদেশের ব্যাংকে রাখেন, তাহলে তাকে ট্যাক্স দিতে হবে। ফলে তারা তাদের নাগরিকের তথ্য সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যায়। কিন্তু, বাংলাদেশের নাগরিক উত্তর আমেরিকায় টাকা রাখলে, তা আমাদের জানার সুযোগ নেই।

একজন আমেরিকান বা কানাডিয়ান বাংলাদেশের ব্যাংকে টাকা রাখলে সেই তথ্য আমরা সেই দেশের সরকারকে জানাচ্ছি। কিন্তু, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক সেসব দেশে টাকা রাখলে সেই তথ্য তারা আমাদের জানাচ্ছে না। তথ্য চাইলেও পাচ্ছি না, এরকমটা কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ তথ্য চাইলেও তারা দিতে পারবে না। কারণ উত্তর আমেরিকার ফেডারেল সরকার এসব নিয়ে ডিল করে না।

অর্থনীতিবিদরা সবসময়ই বলে আসছেন, শুধু সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতেই নয়, এখন কানাডা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফলে কঠোর বার্তা না থাকায় টাকা পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না।

এ কথার সত্যতা মেলে বছর দুয়েক আগের একটি খবরে। একজন বাংলাদেশির বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি টাকা নাকি অলসভাবে পড়ে আছে সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংকে। আরও বিস্ময়কর হচ্ছে, বিশাল অংকের এই টাকার কোনো দাবিদার নাই। বাংলাদেশ সরকার সেই টাকার মালিকানা দাবি করেছে। চেষ্টা করছে টাকাগুলো দেশে ফিরিয়ে আনতে। একাউন্টটি কার সে সম্পর্কে দুদকের আইনজীবী কোনো তথ্য দেননি। তবে বলেছেন, এই একাউন্টের যিনি মালিক বাংলাদেশের 'কোনো একটি মামলায়' তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। তার স্ত্রী-সন্তানরা আছেন, কিন্তু তারাও এই টাকার মালিকানা দাবি করতে যাচ্ছেন না।

পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, মালয়েশিয়া সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে যে বিদেশিদের জন্য মালয়েশিয়ান সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী দেশ। যদিও দেশ থেকে বিদেশে কোনো টাকা নিতে হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। জানা গেছে, গত বছরে মালয়েশিয়ায় বিনিয়োগের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাউকে কোনো অনুমোদন দেয়নি। সবই আসলে ম্যাজিক, টাকা পাচারের ম্যাজিক।

২০১৯ সালের ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিদেশে টাকা পাচারে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। সংস্থাটি জানায়, এই টাকার বেশিরভাগ বৈদেশিক বাণিজ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে পাচার করা হয়।

জিএফআই বলেছিল, দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েছে বেশ কয়েক বছর যাবত। সেই ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৯৮ হাজার কোটি টাকা। তখনই বলা হয়েছিল এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে ৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২ প্রক্রিয়ায় এই অর্থ পাচার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং)। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ না হওয়ায় টাকা পাচার বেড়েছে। এ ছাড়া, দুর্নীতিও টাকা পাচারের অন্যতম কারণ।

আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর নিতে নিতেই এবং নানা কিছু ভাবতে ভাবতেই দেশে বন্যার ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা নিউজ ফিডে ভেসে আসতে থাকলো। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এর আগে কখনোই দেশের একটি বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা হয়নি। অন্যদিকে পানি ঢুকে পড়ছে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোণায়। সব নদীতে পানি বাড়ছে।

এমন সময়ে কিছু মানুষের বিত্ত বৈভবের খবর পড়ে, বিভিন্ন ব্যাংকে চোরা টাকার হিসাব জানতে পেরে কেবলই মনে হচ্ছে, এত টাকার একটিও তারা কবরে নিয়ে যেতে পারবেন না। যদি এই সময় কিছু টাকা দুর্গত মানুষের জন্য ব্যয় করতেন, তাহলেই এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সহজ হতো। আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরও উচিৎ, যে যতটুকু পারি তাই নিয়ে এগিয়ে যাওয়া।

শাহানা হুদা রঞ্জনা: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Specific laws needed to combat cyber harassment

There is an absence of a clear legal framework and proper definitions when it comes to cyber violence against women, speakers said at an event yesterday.They urged for specific legislation to combat such crimes..The roundtable, titled “Scanning the Horizon: Addressing Cyber Violence agains

2h ago