নাগরিক প্রতিবাদ সভা

‘বিএম কনটেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ড কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড’

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক, অধ্যাপক, গবেষকসহ মানবাধিকার কর্মীরা। 

আজ শনিবার সকালে মানবাধিকার সংগঠন নাগরিকের আয়োজনে অনলাইনে নাগরিক প্রতিবাদ সভায় বক্তারা এ বিষয়ে কথা বলেন।

ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার সঞ্চালনায় প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন নাগরিক সংগঠনের আহবায়ক ড. সি আর আবরার।

মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন অধিকারকর্মী ও গবেষক রেজাউর রহমান লেনিন। ওয়াবিনারে বিশেষ আলোচক হিসেবে অংশ নেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক ডা. হারুন উর রশীদ, ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম, সর্বজনের অধিকারকর্মী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, গণসংহতি আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমী এবং গবেষক মাহা মির্জা। এছাড়াও, যুক্ত ছিলেন নাগরিক ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃস্থানীয় অধিকারকর্মী, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক- শিক্ষার্থী, শিল্পী এবং গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা।

মূল বক্তব্য উপস্থাপন করে রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বেসরকারি মালিকানাধীন বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড একটি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড, এখন পর্যন্ত মালিক পক্ষের কোনো ব্যক্তিকে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে দেখিনি এবং সরকারি সংস্থাগুলোকে এখনো কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা এমনকি পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ করা থেকে বিরত থাকছে কর্তৃপক্ষ। অবহেলা ছিল রাষ্ট্রের সরকারি সংস্থাগুলোর কেননা সীতাকুণ্ডের ঘটনায় মালিকপক্ষের কাউকে আসামি করা হয়নি। দুর্ঘটনায় আহত নুরুল আক্তার, খালেদুর রহমানকে এবং আরও অনেককে মামলার আসামি করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও মোকাবিলার জন্য যে ধরনের ফায়ার সেফটি প্ল্যান বা অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা থাকার কথা, সেটিও ছিল না বা থাকলেও কার্যকর ছিল না।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা অনিরাপত্তায় ভোগে, শ্রম পরিদর্শন হয় না ফলে কারখানা মালিকরা যা খুশি তাই করতে পারছে এবং শ্রমিকদের অনিরাপদ রেখেই কারখানা পরিচালনা করছে। ফায়ার ব্রিগেডের সক্ষমতা বৃদ্ধি, কারখানায় কাজের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে শ্রম পরিদর্শকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা দরকার, এই সংখ্যাটা বর্তমানে একটা কৌতুকের পর্যায়ে রাখা হয়েছে। সরকারের অবস্থানই হলো শ্রম পরিদর্শন কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নয়। এতে করে কারখানা মালিক যারা তারা যা খুশি তাই করতে পারে সে ব্যবস্থাই করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার মধ্যে এলে এধরনের ঘটনা ঘটবে না। কাঠামোগত যে পরিবর্তন হলে এই কাঠামোগত হত্যাগুলো আর হবে না সেটার কোনো ব্যবস্থা আমরা সরকারি নীতির মধ্যে পাই না, বাজেটের মধ্যে পাই না এমনকি প্রধানমন্ত্রীর মনিটরিং এ-ও পাই না। মন্ত্রীদের কথাবার্তায় তো নেই-ই। সেই ধারাটাই অব্যাহত রয়েছে। যারা খুব দ্রুত টাকা বানাচ্ছে মানুষের জীবনের বিনিময়ে, সম্পদের বিনিময়ে, বনের বিনিময়ে, নদীর বিনিময়ে এবং তাদের তৈরি জোট কীভাবে সরকার চালাচ্ছে এবং নাগরিকরা স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের পরও কীভাবে অবহেলা, তুচ্ছতাচ্ছিল্যের মধ্যে জীবনযাপন করছে তা লক্ষ্য করতে হবে।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ দাবি করেন, মালিক এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যারা তাদের আটক করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। স্বচ্ছ তদন্ত কমিটি করতে হবে এবং তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে। এই রিপোর্ট সাধারণত প্রকাশ করা হয় না। রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং কাঠামোগত পরিবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। যে অমূল্য জীবনগুলো চলে যাচ্ছে সেগুলোর ক্ষতিপূরণ তো কোনোভাবে সম্ভব নয়। ক্ষতিপূরণের কথা বলা হয় মৃত শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের জীবন নির্বাহের জন্য এবং যাদের কারণে শ্রমিক নিহত হলেন তাদের ওপর শাস্তি আরোপ হিসেবে। মালিকের সম্পত্তি আদালতের মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিপূরণের টাকা দিতে হবে, সরকার যে অর্থ দেয় তা জনগণের কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা মালিকের।

গবেষক মাহা মির্জা তার বক্তব্যে স্মরণ করিয়ে দেন, গত বছরের হাশেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পরবর্তী সময়ের কথা। অগ্নিকাণ্ডের পর ভবন নির্মাণের আইন-বিধি না মানা, জরুরি নির্গমনের পথে বাধা সৃষ্টি করা, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকা, পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামাদি না থাকা, শিশু শ্রমিক নিয়োগ, প্রশিক্ষিত অগ্নিনিবার্পণে জনবল না থাকা এবং ফায়ার সার্ভিসের এনওসি না পাওয়াসহ নানা অনিয়মের কথা।

অন্যদিকে, পুলিশের করা কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স তাদের প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে বলে জানা গেছে, যদিও তাদের প্রতিবেদন সম্পূর্ণরূপে এখনও জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়নি। ইতোপূর্বে যেসব অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে এবং সেসব ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ উঠে এসেছে সেগুলোও যদি জনসম্মুখে প্রকাশিত হতো এবং আমলে নিয়ে বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয়া হতো এবং দোষীদের শাস্তি দেওয়া হতো তাহলেও সীতাকুণ্ডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হতো না।

গণসংহতি আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক হাসান মারুফ রুমী তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন, তিনি চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

তিনি বলেন, ক্ষতিপূরণ নিয়ে চলেছে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য, প্রথমে শুনেছি নিহতদের ৫০ হাজার এবং আহতদের ২০ হাজার টাকা করে দেবে পরবর্তীতে তা পরিবর্তিত হয়েছে।

রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, তারা মূলত চিকিৎসকদের সাথে কথা বলেছিলেন এবং তাদের কী কী বিষয়ে সহযোগিতা লাগবে সেই সব বিষয়ের দিকে নজর রেখেছিলেন, কিন্তু তাদের পরিদর্শন এবং মতামত ও আলাপ আলোচনার পর ফিরে আসবার সময় তাদের ওপর ক্ষমতাসীনরা আক্রমণ করেন এবং এলোপাতাড়ি গাড়ি ভাঙচুর করে এবং একটি পর্যায়ে মনে হচ্ছিল যে তাদের গাড়িতে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। তাদের ওপর আক্রমণের সময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নির্লিপ্ত ছিল বলে অভিযোগ করেন।

অধ্যাপক ডা. হারুন উর রশীদ বলেন, একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। ঘটনার তৃতীয় দিনে আমি ও আমাদের টিম সীতাকুণ্ডে যাই। সেখানে দায়িত্বরত ফায়ার ব্রিগেড এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের জিজ্ঞাসাবাদে কিছু তথ্য পাই। তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল এখনো কেন পুরোপুরি আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে নাই এবং এত ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের মূল কারণ কী? তারা জানান সেখানে এতবড় ঘটনায় মালিকপক্ষ তাদের সাথে যোগাযোগ করেননি, শ্রমিকেরা নিজেরাই ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং কেমিক্যালসহ রাসায়নিক পদার্থের যে মজুদ ছিল তা সম্পর্কে সঠিক তথ্য ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের জানানো হয়নি। তাই প্রথমবার ফায়ার সার্ভিসের যে টিম গিয়েছিল তার বেশিরভাগ নিহত এবং আহত হয়েছেন। যেহেতু রাসায়নিক পদার্থের কথা জানা ছিল না তাই পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টায় পরবর্তী বিষ্ফোরণ হয়। এতে হতাহতের এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।

পরে যখন তিনি বার্ন ইউনিটে যান সেখানে দেখতে পান স্বল্পস্থানে অনেক রোগী। শরীরের পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আরও অনেক ঝুঁকিতে আছেন তারা। যার চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি এবং ব্যয়বহুল হবে। পরবর্তীতে তারা যখন প্রেসক্লাবে মিটিং এ যোগ দিতে যান সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা বাধা দেন এবং স্থানীয় নেতারা হামলা চালান। তিনি জানান, এই ঘটনার দায়ভার মালিকপক্ষকে নিতেই হবে, কারণ যে রাসায়নিক পদার্থের কারণে এই দূর্ঘটনা সেই রাসায়নিক পদার্থের কোনো অনুমোদন নেই এবং তা যে পরিবেশে রাখার কথা ছিল সেই পরিবেশ নিশ্চিত না করে রাখায় এই ঘটনার উদ্ভব। এই ঘটনায় মালিক পক্ষকে আইনের আওতায় না আনা হলে যারা নিহত এবং আহত হয়েছেন তাদের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তার জবাবদিহি থাকবে না। তিনি দাবি করেন, এই সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আইনের আওতায় আনা হোক দোষীদের।

ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম বলেন, গত ৫০ বছর আমরা দেখছি সংবিধান স্বীকৃত জীবনের অধিকার রক্ষা করবার ক্ষেত্রে আমরা বারবার ব্যর্থ হচ্ছি, এই ব্যর্থতা আমাদের সবার, একইসাথে আমি মনে করি, জীবনের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। যদি কোনো মামলা নাও করা হয় তবে উচ্চ আদালত জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় উদ্যোগী হয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। একইসাথে আইনজীবীদেরও রয়েছে জীবন রক্ষার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ আদায়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা আইনজীবীরা আমাদের ভূমিকা এবং উচ্চ আদালতকে সাহায্য করতে ব্যর্থ হচ্ছি।

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্বের বক্তব্যে নাগরিক সংগঠনের আহবায়ক ড. সি আর আবরার বলেন, আজকের আলোচনায় কতগুলো বিষয় উঠে এসেছে, আমাদের কাছে একটি বিষয় প্রথম থেকে পরিষ্কার যে, শ্রমিকদের শ্রম অধিকার এবং জীবন-জীবীকার অধিকারের প্রতি কখনও নজর দেওয়া হয় না, দ্বিতীয়ত, যখন এমন ধরনের কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং নাগরিকরা আক্রান্ত হন, তখন আইন না মেনে এবং মানবাধিকার সমুন্নত না রেখে একদল লোক ক্ষতিপূরণের দাবি তোলেন কিন্তু একটি মানুষের জীবনের মূল্য কি আর্থিক হিসাব দ্বারা নির্ণয় করা সম্ভব? যদি ক্ষতিপূরণ দিতে হয় তবে অবশ্যই একটি বিষয় নজর রাখা প্রয়োজন সেটি হলো জীবিত অবস্থায় নিহত ব্যক্তি যত পরিমাণের আর্থিকভাবে উপার্জন করতেন তার দ্বিগুণ পরিমাণের অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসাবে দিতে হবে। তৃতীয়ত, সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান সঠিক এবং প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত দায়িত্ব পালন করবার কথা সেই সব দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে না এবং সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে, উপরন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি মালিক পক্ষকে বাঁচানোর এক রকমের পরোক্ষ চেষ্টা, যা আসলে অপরাধমূলক। চতুর্থত, যে সব নাগরিকরা আহত ব্যক্তিদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চেয়েছেন, সেই সব ব্যক্তিদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কর্মীদের দিয়ে আক্রমণ করা হচ্ছে এবং একইসাথে উন্নয়নের কথা বলা ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্লিপ্ততা খুবই দুঃখজনক।

Comments

The Daily Star  | English

Power, Energy Sector: Arrears, subsidies weighing down govt

The interim government is struggling to pay the power bill arrears that were caused largely by “unfair” contracts signed between the previous administration and power producers, and rising international fuel prices.

7h ago