সীতাকুণ্ডের অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা নয়, অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড: বাম গণতান্ত্রিক জোট
'চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোর অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা নয়, এটি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড।'
আজ বুধবার সকালে এমন মন্তব্য করেছেন বাম গণতান্ত্রিক জোট নেতারা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শনের পর আজ সকাল সাড়ে ১১টায় মুক্তিভবনের মৈত্রী মিলনায়তনে বাম গণতান্ত্রিক জোট সংবাদ সম্মেলন করে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন পরিদর্শন দলের সদস্য বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)'র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।
তিনি বলেন, 'ঘটনার পরপরই এই বিস্ফোরণকে দুর্ঘটনা বলে প্রচার করা হচ্ছে। নাশকতাসহ নানা কথা বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এই বিস্ফোরণ শুধুমাত্র দুর্ঘটনা নয়, এটি অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড।'
'এ ঘটনায় প্রকৃত তথ্য খুঁজে বের করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন এবং ওই কমিটিতে বেসরকারি বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ডিপো মালিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের, গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। অনুমোদন না নিয়ে, যথাযথ নিয়ম না মেনে এই ডিপোতে বিস্ফোরক রাখা—এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত তদারকি সংস্থার যেসব কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।'
'আহতদের সুচিকিৎসা, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ, কাজের নিশ্চয়তা, আইএলও কনভেনশনের ১২১ ধারা অনুযায়ী নিহতদের আজীবন কাজের মজুরির সমান ক্ষতিপূরণ ও পরিবারের পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। রাসায়নিক দূষণ দূর করতে বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা নিতে হবে।'
রুহিন হোসেন প্রিন্স আরও বলেন, 'ফায়ার ব্রিগেডের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাই জানতেন না এই ডিপোতে রাসায়নিক বা বিস্ফোরক পদার্থ আছে। বিস্ফোরণের ঘটনার পরপর তারা এসেও মালিকপক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাউকে না পাওয়ায় কোন কনটেইনারে কী আছে তা জানতে পারেনি। এজন্য আগুন নেভানো এবং উদ্ধার কাজে সমস্যা হয়েছে। যথাসময়ে কনটেইনার সরানো যায়নি। এখনো অনেক কনটেইনার আছে, যে কোনো সময় সমস্যা হতে পারে। প্রকৃত তথ্য পেলে হয়তো ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীসহ এত মানুষের প্রাণহানি হতো না। এলাকার মানুষের আতঙ্ক কাটেনি। শিশুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দূরে আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন, দিচ্ছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'চিকিৎসাধীন অনেকের পরিবার আহতদের জীবন বাঁচানো নিয়ে শঙ্কিত। এত বড় ঘটনার পরও থানায় কোনো মামলা হয়নি। মালিক আওয়ামী লীগেরও নেতা। মালিকপক্ষের কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। বরং বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে মালিকপক্ষ নিজেদের সাফাই গেয়ে চলেছেন। রাসায়নিক দূষণ এমন এক বিষয় এটা এক জায়গায় থেমে থাকে না। সাধারণ মানুষের চোখে দেখা না গেলেও এসব রাসায়নিক দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশ এবং মানুষের ক্ষতি করে।'
বিস্ফোরণের পরপরই চট্টগ্রাম ও আশেপাশের এলাকার যেসব ছাত্র-যুবসহ সাধারণ মানুষ অসহায় মানুষের পাশে ছুটে এসেছিরেন সংবাদ সম্মেলনে তাদের অভিনন্দন জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে রুহিন হোসেন প্রিন্স আরও বলেন, 'এ ধরনের ঘটনা প্রথম নয় নিমতলী, চুড়িহাট্টা, রানা প্লাজা, তাজরিন ও সেজান জুসসহ বিভিন্ন কারখানার অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের খবর সবার জানা। এর কোনোটির বিচার হয়নি। বরং অনেককে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সরকারের নিয়মনীতির প্রতি উদাসীনতা, মালিক তোষণ আর মালিকের মুনাফার বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। নিয়ম না মেনে ব্যবসার নামে মানুষের জীবন, পরিবেশ, প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।'
সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার বলেন, 'জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার ক্ষমতায় থাকলে এ অবস্থা হতে পারতো না। তিনি বলেন, সারাদেশ অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। চলমান আওয়ামী সরকারের দুঃশাসন এই অনিয়মকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। মালিক ও শোষকরা সরকারের কাঁধে ভর করে এই অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছে। এর বিরুদ্ধে জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে।'
পরিদর্শন টিমের সদস্য বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, 'অতীতে অনেক তদন্ত কমিটি হয়েছে, অনেক সুপারিশ শুনেছি কিন্তু কোনোটাই কার্যকর হয়নি। কোনো তদারকি সংস্থাই ভূমিকা পালন করে না। এদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এবারও প্রকৃত নিহত হওয়াদের তথ্য নিয়ে নানা মত শোনা যায়।' এ ছাড়া তিনি নিহত-আহতদের প্রকৃত তালিকা প্রকাশের দাবি জানিয়ে বলেন, 'বিস্ফোরণের পর মানুষ যে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছে তার ওপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হবে।'
পরিদর্শন টিমের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. হারুন উর রশীদ বলেন, 'রাষ্ট্রের সীমাহীন অবহেলায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।' তিনি চিকিৎসকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, 'তারা সাধ্যমত চেষ্টা করছেন তবে আগুনে পোড়া রোগীদের আলাদা রেখে চিকিৎসা করাটা জরুরি। যাতে নতুন কোনো সংক্রামণ না হয় এটাও নজরে রাখতে হবে।'
এ সময় বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, সিপিবি সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম, পরিদর্শন টিমের সদস্য বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশিদ ফিরোজ, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. হারুন উর রশীদ, বাসদ (মার্কসবাদী)-এর কেন্দ্রীয় নেতা মানস নন্দী, ওয়ার্কার্স পার্টির (মার্কসবাদী) নেতা বিধান দাস। বাসদের সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, বাসদের (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ডা. ফজলুর রহমানসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
Comments