মুক্তিযুদ্ধ

একাত্তরে রক্তাক্ত চুকনগর

চুকনগর বধ্যভূমিতে স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

তার নাম রাজকুমারী সুন্দরী দাসী। জীবনে জানতে পারেননি কে তার বাবা, কে মা, কারা আত্মীয় বা কোথায় আছেন স্বজনরা। সুন্দরীর জীবন এলোমেলো করে দিয়েছিল চুকনগরের গণহত্যা। এই গণহত্যায় মাত্র ৬ মাস বয়সী সুন্দরীর জীবন আচমকা সব বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

সুন্দরী নামটি তার পালক বাবা মান্দার দাসের দেওয়া। সুন্দরীর কখনো জানার সুযোগ হয়নি, জন্মের পর তার নাম কী রেখেছিলেন বাবা-মা বা স্বজনরা।

চুকনগরে নারকীয় গণহত্যা শেষে হানাদার সেনারা যখন ফিরে যায়, তখন পাতখোলার বিলে নিজের বাবার মরদেহ খুঁজতে গিয়েছিলেন স্থানীয় এরশাদ আলী মোড়ল। অজস্র  মরদেহের ভিড়ে মৃত মায়ের স্তন্যপানরত ৬ মাস বয়সী এক শিশুকে খুঁজে পেয়ে বাড়ি নিয়ে যান এরশাদ আলী। সেদিন সন্ধ্যায় চুকনগর বাজারে তার সঙ্গে দেখা বন্ধু মান্দার দাসের। নিঃসন্তান মান্দার দাসের হাতেই শিশুটিকে তুলে দেন তিনি। মান্দার দাস শিশুটির নাম রাখলেন রাজকুমারী সুন্দরী দাসী। সেদিনের সেই ৬ মাস বয়সী সুন্দরী আজ ৫২ বছরের, আর সেই ২৮ বছরের যুবক এরশাদ আলী মোড়ল বয়সের ভারে ন্যুব্জ।

সুন্দরী দাসী। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

সেদিনের অবুঝ সুন্দরীর গণহত্যার মনে না থাকলেও, সেই স্মৃতি আজও ভীষণ টাটকা এরশাদ আলীর। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানালেন নিজের অভিজ্ঞতা।

'সকাল ১০টা-১১টার দিক হবে তখন। আমি ও আমার আব্বা পাটের জমিতে ঘাস তুলছিলাম। হঠাৎ মিলিটারির ২টি গাড়ি সাতক্ষীরার দিক থেকে আসে। গাড়ি দেখে আব্বা বলল, শিগগির বাড়ির দিকে যা। আমি বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। আব্বার কাছে খানরা কী জিজ্ঞেস করল, জানি না। আমার আব্বার কাছে ছিল কাঁচি। সেটা শুধু একটু উঁচু করতেই গুলি করল আব্বাকে। গুলির শব্দ শুনে সবাই পালাতে শুরু করল। যখন গুলি থেমে গেল, তখন আমি আব্বাকে খুঁজতে পাতখোলা বিলে এসে দেখি, চারপাশে খালি মরদেহ আর মরদেহ। মাঠে-ঘাটে যেদিকেই তাকাই, শুধুই মরদেহ', বললেন তিনি।  

এরশাদ আলী গণহত্যার পরের দৃশ্য দেখলেও, গণহত্যার নির্মম পৈশাচিকতা দেখেছিলেন নিতাই গাইন। চুকনগর গণহত্যায় বাবাসহ পরিবারের ৮ সদস্যকে হারিয়েছিলেন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজন নিতাই গাইন। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

সম্প্রতি খুলনার বটিয়াঘাটার দাউনিয়াফাদ গ্রামে নিজ বাড়িতে বসে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, '১৯ মে রাতে আমরা আমাদের বাড়ি থেকে চুকনগরের উদ্দেশে ৩টি নৌকায় যাত্রা শুরু করি। ২০ মে সকাল সাড়ে ৯টায় চুকনগর পৌঁছাই। একটা দোকান ঘরের বারান্দায় কাঠ জোগাড় করে এনে রান্নাবান্নার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় খবর পেলাম, মিলিটারি অ্যাটাক শুরু হয়েছে। গুলি শুরু হয়ে গেল। তখন আর আমরা বের হতে পারলাম না। পাশেই ছিল মসজিদ ঘর। আমি মসজিদে গিয়ে ঢুকলাম।

আমাদের সঙ্গে আসা বাড়ির পাশের একটি মেয়ে মসজিদের বারান্দায় আমাকে মাদুর দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছিল, যেন আমাকে পাকিস্তানি আর্মি দেখতে না পায়। আমার মা-বাবা-চাচাসহ বাকিরা সবাই সেই দোকান ঘরের সামনে ছিল। মসজিদের সামনে একটা বড় বটগাছ ছিল। আমাকে দেখতে না পেলেও আমার চোখের সামনেই আমার বাবা, কাকা, কাকাতো ভাই, পিসেমশাইসহ আমার পরিবারের ৮ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।'

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার ৫ নম্বর আটলিয়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম চুকনগর। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেওয়ার পথ হিসেবে চুকনগরের রুটটি ছিল আদর্শ। মে মাসের আগ পর্যন্ত শরণার্থীদের ভিড় কিছুটা কম থাকলেও, ধীরে ধীরে সেখানে শরণার্থীর ভিড় বাড়তে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী ২০ মে সকালে চুকনগরে এক প্লাটুন সেনা পাঠায়।

চুকনগর গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও তৎকালীন ছাত্রনেতা সিরাজুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন,  '২০ তারিখ সকালে আমরা চুকনগরে দেখলাম লাখ লাখ মানুষের ঢল। শুধু মানুষ আর মানুষ।  হঠাৎ ১১টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি গাড়ি চুকনগর-সাতক্ষীরা রোড ধরে মালতিয়া মোড়ের ঝাউতলার সামনে এসে থামল। তখন রাস্তার ধারে আমাদের মালতিয়ার এক লোক খেতে পাটের কাজ করছিলেন। তিনি যখন আর্মির গাড়ির শব্দ শুনে দেখতে গেলেন, তখন তার হাতে কাস্তে দেখতে পেয়ে গুলি করল পাকিস্তানি আর্মি। এরপর পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়ি সামনে এগিয়ে গেল। সামনে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত কালভার্ট ভাঙা থাকায় গাড়ি থেকে নেমে ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে পায়ে হেঁটে এক ভাগ মালোপাড়া- রায়পাড়ার দিকে, এক ভাগ বাজারের দিকে, আরেক ভাগ নদীর ধারে গুলি করতে করতে এগিয়ে গেল। 

প্রত্যক্ষদর্শী সিরাজুল ইসলাম। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

গুলির শব্দ শুনে পাতখোলার মাঠে থাকা হাজার হাজার মানুষ প্রাণভয়ে পালাতে শুরু করল। ওরা নির্বিচারে ব্রাশফায়ার করে মানুষকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করল। এরপর একদল শেখ বাড়ির দিক দিয়ে গুলি করতে করতে এগিয়ে গেল। নৌকায় যারা লুকিয়ে ছিল, নৌকায় ঢুকে ঢুকে ওরা তাদের হত্যা করল। গাছে উঠে যারা প্রাণে বাঁচতে চেয়েছিল, খুঁজে খুঁজে বের করে তাদের হত্যা করল। মালোপাড়ার ঝোপওয়ালা গাছে উঠে বহু মানুষ লুকিয়ে ছিল। তাদেরকেও পাখির মতো গুলি করে হত্যা করল। একটা পানিশূন্য পুকুর ছিল, সেখানে গিয়েও মানুষ লুকানোর চেষ্টা করেছিল। তবুও রেহাই পায়নি হানাদারদের হাত থেকে।  

চুকনগরের পাতখোলা বিল থেকে চুকনগর বাজারের চাঁদনী মন্দির, ফুটবল মাঠ, চুকনগর স্কুল, মালতিয়া, রায়পাড়া, মালো পাড়া, দাসপাড়া, তাঁতিপাড়া, ভদ্রা ও ঘ্যাংরাইল নদীসহ চুকনগরের সবখানেই সেদিন মরদেহ আর মরদেহ। চুকনগরের পাশের ভদ্রা ও ঘ্যাংরাইল নদী যেন পরিণত হয় রক্তের মহাসমুদ্রে।'

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার আউশখালী গ্রামের বাসিন্দা সুরেন্দ্রনাথ বৈরাগীরা ছিলেন ৫ ভাই। চুকনগর গণহত্যা থেকে সুরেন্দ্রনাথ বৈরাগী ভাগ্যক্রমে বাঁচতে পারলেও, হানাদারদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে পারেননি তার বাকি ৪ ভাই। সুরেন্দ্রনাথ বৈরাগীর সঙ্গে সম্প্রতি কথা হয় দ্য ডেইলি স্টারের।

প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজন সুরেন্দ্রনাথ বৈরাগী। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

তিনি বলেন, 'জ্যৈষ্ঠ মাসের ৪ তারিখ (১৯ মে ৪ জ্যৈষ্ঠ ছিল) বিকেল ৪টার দিকে নৌকা করে আমরা বাড়ির থেকে যাত্রা করলাম। সেদিন রাতে চুকনগরের পাশের গ্রামের এক ঠাকুরবাড়িতে ছিলাম। সকালে উঠে চুকনগর গিয়ে পৌঁছলাম। রান্না শুরু হয়েছে, চুলায় চাল। ভাত একটু হয়ে এসেছে, এ সময় পাকিস্তানি মিলিটারির গুলির শব্দ। ভাত আর খাওয়া হলো না। মানুষ পালাতে লাগল। আমি নদীর তীরে গেলাম। সেখানেও তারা মানুষ মারল। গোলাগুলি থেমে গেলে আমার বউ আমার কাছে এসে বলল, ''আপনার ভাইদের একজনও বেঁচে নেই।'' আমাদের পাশের বাড়ির ৩ জনের লাশ তখন আমগাছে পড়ে আছে।'

সকাল ১১টায় শুরু হওয়া এই পৈশাচিক গণহত্য পাকিস্তানি হানাদারদের গুলির সংকটের কারণে শেষ হয়েছিল বিকেল ৫টায়। মাত্র ১ প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা ৬ ঘণ্টায় হত্যা করেন ১০ হাজারের বেশি মানুষ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যা সর্ববৃহৎ গণহত্যা।

চুকনগর গণহত্যার পর সৎকারের অভাবে বেশিরভাগ মরদেহই ভাসিয়ে দেওয়া হয় পাশের ভদ্রা নদীতে।

ভদ্রা নদী সেদিন পরিণত হয়েছিল রক্তের নদীতে। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

চুকনগর কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী এবিএম শফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেই পরিস্থিতি ভাষায় বর্ণনা করার মতো না। চারদিকে কেবলই মরদেহ আর মরদেহ। যেহেতু এত মরদেহ, তাই সৎকারের উপায় ছিল না। তাই গণহত্যার পরদিন চুকনগর বাজার কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, সব মরদেহ নদীতে ফেলা হবে।

প্রত্যক্ষদর্শী এবিএম শফিকুল ইসলাম। ছবি: আহমাদ ইশতিয়াক

তখন চুকনগর বাজারে পাটের গুদামে কাজ করতেন, এমন ৪৪ জনকে নিয়ে ২২টি দল করে নদীতে মরদেহ ফেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ঠিক করা হলো, প্রতিটি মরদেহ ফেলার বিনিময়ে তাদের ৪ আনা করে পয়সা দেওয়া হবে। কয়েক ঘণ্টা মরদেহ ফেলার পর তারা বিশ্রাম নেবেন। মরদেহের সঙ্গে থাকা টাকা, গয়নাও সংগ্রহ করা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশিরভাগ মরদেহ ফেলার পর দেখা গেল, এত সংখ্যক মরদেহ ছিল যে,  পকেট বা গাঁট থেকে সংগৃহীত টাকার পরিমাণই হয়েছে ৩- ৪ বস্তা।  সঙ্গে ৪-৫ সের রূপার ও  ২ সেরের মতো সোনার গয়না। এত মরদেহ নদীতে ফেলেছিল যে, খরস্রোতা ভদ্রা নদীর স্রোত পর্যন্ত আটকে গিয়েছিল। গণহত্যার পর কয়েক মাস গ্রামের মানুষ নদীর মাছ খাওয়া তো দূরে থাক, নদীর পানিও ব্যবহার করতে পারেনি।' 

Comments

The Daily Star  | English

How a 'Dervish Baba' conjured crores from a retired nurse

Want to earn easy money? Just find someone who thinks their partner is cheating on them, then claim to be a “Genie King” or “Dervish Baba,” and offer solutions to “relationship problems” for a fee

1h ago