টাকা পাচার অব্যাহত থাকবে?

বাংলাদেশ টাকা 'রপ্তানিকারক' দেশ, হাসি-রসিকতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ১ বছরের বাজেট ১০ হাজার ৫১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। পি কে হালদার একাই আত্মসাৎ করে পাচার করেছে ১০-১১ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ টাকা 'রপ্তানিকারক' দেশ, হাসি-রসিকতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ১ বছরের বাজেট ১০ হাজার ৫১৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা। পি কে হালদার একাই আত্মসাৎ করে পাচার করেছে ১০-১১ হাজার কোটি টাকা।

ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখেন, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ একজন পি কে হালদার আত্মসাৎ করেছে। সেই টাকা ভারত, কানাডাসহ বিদেশে পাচার করেছে। এই পরিমাণ টাকা একদিনে আত্মসাৎ করেনি, বস্তায় ভরে উড়োজাহাজে করেও নিয়ে যায়নি। ব্যাংকিং চ্যানেলেও নেওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে টাকা পি কে হালদার কীভাবে পাচার করল?

টাকা হুন্ডির মাধ্যমে এমন একটি দেশে নেওয়া হয়েছে, যেদেশে টাকার উৎস জানতে চাওয়া হয় না। দুবাই এমন একটি জায়গা।

বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে দুবাইয়ে নিয়ে যাওয়া অর্থ বৈধভাবে ব্যাংকে রাখার সুযোগ থাকে।

বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ দুবাইয়ে বাড়ি কিনেছেন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। কেউ কেউ আবার স্থায়ীভাবে দুবাইয়ে থাকছেন। দুবাই থেকে সুবিধামতো যেকোনো দেশে যেতে পারছেন। এমন ২ জন রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ীর সঙ্গে বছর তিনেক আগে দেখা হয়েছিল ব্যাংককে।

কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, রাজনৈতিক কারণে তারা দেশে থাকতে পারছেন না। দুবাইয়ে ব্যবসা করছেন। তাদের একজন চিকিৎসার জন্য নিয়ম করে থাইল্যান্ডে আসেন। আরেকজন জানালেন, স্থায়ী ঠিকানা এখন দুবাই হলেও অধিকাংশ সময় থাকেন লন্ডনে, মেডিকেল চেকআপের জন্য আসেন ব্যাংককে। এই ২ ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদ যে ঋণ জালিয়াতি বা ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করে পাচার করেছেন, তেমন নয়। তবে তারা দেশ থেকে টাকা নিয়েছেন অবৈধ প্রক্রিয়া হুন্ডির মাধ্যমেই। কারণ দেশ থেকে বৈধ পথে বিদেশে টাকা নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যতদূর জানা যায়, তারা কানাডা ও লন্ডনেও একাধিক বাড়ি কিনেছেন। সেই টাকা তারা দুবাই থেকে বৈধ পথেই কানাডা বা লন্ডনে নিয়েছেন। দুবাই থেকে টাকা অন্য দেশে সহজেই নেওয়া যায়।

বাংলাদেশ থেকে যারা ঋণ জালিয়াতি বা লুটপাট করা টাকা বিদেশে পাচার করেন, তাদের জন্যে এটা একটা প্রক্রিয়া। তাদের নিশ্চয়ই আরও অনেক প্রক্রিয়া জানা আছে। বাংলাদেশ থেকে টাকা ভারতে নেওয়ার ক্ষেত্রে হুন্ডি সহজ একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু একটু বড় অংকের অর্থ হলে তা সহজে ভারতের ব্যাংকে রাখা সম্ভব না। ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি টাকা লুটপাটকারী পি কে হালদার তার টাকার বড় একটা অংশ ভারতে নিয়েছেন। এই টাকা তিনি সরাসরি ভারতে নিয়েছেন, না দুবাই বা অন্য কোনো তৃতীয় দেশের ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে নিয়েছেন?

এখনকার সবচেয়ে জরুরি বিষয় সেটা তদন্ত করা।

সরকার আন্তরিক হলে পি কে হালদারকে ভারত থেকে দেশে ফেরত আনা যাবে। কীভাবে সে টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেছে, তা বের করা মোটেই কঠিন নয়। প্রশ্ন হলো, সরকার সে পথে যাবে কি না? সরকারের সামনে কোনো বাধা আছে কি না?

সাধারণভাবে দেখলে সরকারের সামনে সে পথে না যাওয়ার কথা নয়। কোনো বাধাও থাকার কথা না। কিন্তু একটু গভীর পর্যবেক্ষণে বোঝা যায় সরকারের সামনে বেশ বড় বাধা কাজ করে। কারণ পি কে হালদার অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন লম্বা সময় ধরে। কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক থেকে পি কে হালদার অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। পি কে হালদারের এই অর্থ আত্মসাৎ প্রক্রিয়া জানা ও প্রতিরোধের দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নিশ্চয় তা জেনেছিলেন, কিন্তু তারা প্রতিরোধ করেননি। অভিযোগ আছে, তারা সহায়তা করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন ২ ব্যক্তির একজন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর এবং সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পি কে হালদারসহ আরও অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটপাটকারীদের তারা সহায়তা করেছে, নিজেরা লুটপাটের অংশীজন হয়েছে। তাদের পদ থেকে সরানো হয়েছে, দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কিন্তু তাদের বিষয়ে সরকারের অবস্থান কতটা কঠোর সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান নিয়ে সন্দেহ বা সংশয় নতুন কিছু নয়। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল ২০২০ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বক্তব্যে।

'আপনারা কাগজে কানাডার যে বেগমপাড়ার কথা লেখেন, সেখানে বাংলাদেশের কাদের কাদের বাড়ি আছে, এমন একটা তথ্য আমরা গোপনে সংগ্রহ করেছি। নন-অফিসিয়ালি এই তথ্য আমরা নিয়েছি। এটা ভেরিফাইড তথ্য নয়। একজন প্রবাসী বাংলাদেশি এই তথ্য আমাদের দিয়েছেন। সেখানে বেশ অবাক করা তথ্য পাওয়া গেছে। কারণ আমাদের সচরাচর ধারণা যে, এগুলো হয়তো রাজনীতিবিদরা করেন। কিন্তু, সেখানে দেখা গেল এদের অধিক সংখ্যক সরকারি চাকরি করেন। অবসর নিয়েছেন বা এখনো চাকরিতে আছেন, তারা বাড়ি কিনেছেন। তাদের ছেলে-মেয়েরা সেখানে থাকেন বড় বড় বাড়িতে। কিছু বাড়ি কিনেছেন আমাদের ব্যবসায়ীরা। সামথিং ইন্টারেস্টিং। সরকারি অফিসারদের পরিচিতি তো দিনে আনেন, দিনে খান। এরমধ্যে বিদেশে কানাডাতে বাড়ি কিনলেন!' (পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দ্য ডেইলি স্টার, ২০ নভেম্বর ২০২০)

কিন্তু সরকার বিষয়টি নিয়ে কোনো তদন্ত করেছে, এমন কোনো তথ্য জানা যায়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের কয়েকদিন পরে অর্থমন্ত্রী সংসদে বললেন, কারা টাকা পাচার করে আমি জানি না। তিনি বিরোধী দলের কাছে টাকা পাচারকারীদের তালিকা চেয়েছিলেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাচারকারীদের তথ্য পেলেও অর্থমন্ত্রী তা জানলেন না কেন? পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্ত্রণালয় থেকে অর্থমন্ত্রীর মন্ত্রণালয়ের দূরত্ব আসলে কতটা!

নাটোরের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল কানাডার স্কারবারো শহরে ১৪ লাখ ৫৬ হাজার কানাডিয়ান ডলার বা ১২ কোটি টাকায় একটি বাড়ি কিনেছেন তার স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতীর নামে। সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলেও, অর্থ মন্ত্রণালয় বা সরকারের কোনো সংস্থা তদন্তের উদ্যোগ নেয়নি। ফরিদপুরের ২ আওয়ামী লীগ নেতা ভাইদ্বয় পাচার করেছে কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকা। তারা গ্রেপ্তার হয়েছেন। আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফরিদপুরে গিয়ে বলেছেন, 'আওয়ামী লীগ করে যারা কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে, তাদের চিহ্নিত করুন' (প্রথম আলো, ১২ মে ২০২২)। আওয়ামী লীগ করে শত শত কোটি টাকা পাচারের কথা এই প্রথম আওয়ামী লীগের কোনো নেতা স্বীকার করলেন।

লক্ষ্মীপুর ২ আসনের এমপি মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপলু অর্থ ও মানবপাচার মামলায় দণ্ডিত হয়ে কুয়েতে জেল খাটছেন।

বাংলাদেশের একজন ব্যবসায়ী সিঙ্গাপুরে একাধিক পাঁচ তারকা হোটেল কিনেছেন। সিঙ্গাপুরের গণমাধ্যম সেই সংবাদ প্রকাশ করেছে। আলোচিত-সমালোচিত শিকদার গ্রুপ থাইল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশে সম্পদ কিনেছে, ব্যবসা করছে।

দেশ থেকে প্রতি বছর যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যায়, এগুলো তার অতি ক্ষুদ্র নমুনা। এর বাইরে ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানির দাম কারসাজি করে প্রতি বছর পাচার করেন কমপক্ষে ৭০ হাজার কোটি টাকা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) রিপোর্ট প্রকাশ করে এ তথ্য বারবার জানিয়েছে। কিন্তু সরকার এসব তথ্য বিবেচনায় নেয়নি।

পি কে হালদার ভারতে গ্রেপ্তারের পর অর্থ পাচারের পুরনো বিষয় নতুন করে আলোচনায় এসেছে। নতুন আরেকটি বিষয় সামনে এলে, তা আবার হয়তো চাপা পড়ে যাবে।

তাহলে জনগণের টাকা আত্মসাৎ ও পাচার কি অব্যাহত থাকবে?

s.mortoza@gmail.com

Comments

The Daily Star  | English

An economic corridor that quietly fuels growth

At the turn of the millennium, travelling by road between Sylhet and Dhaka felt akin to a trek across rugged terrain. One would have to awkwardly traverse bumps along narrow and winding paths for upwards of 10 hours to make the trip either way.

8h ago