ডেমরা গণহত্যা: ৫০ বছরেও স্বীকৃতি পাননি ৮ শতাধিক শহীদ

ডেমরা গণহত্যাকাণ্ডে নিহত খোরশেদ প্রাং, চাচা খবির প্রাং ও ইউসুফ আলিকে একসঙ্গে দাফন করা হয় এই কবরে। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

১৯৭১ সালের ১৪ মে। পাবনার ফরিদপুর উপজেলার তৎকালীন দুর্গম গ্রাম ডেমরায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

পাবনা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম ডেমরায় পাবনা শহর ও আশেপাশের অনেক মানুষ আশ্রয় নেন। তবে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে প্রায় ৮০০ জনেরও বেশি নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে, পুরিয়ে দেয় বসত ঘর, নির্যাতন করে শিশু ও নারীদের।

১৯৭১ সালের ১৪ মে দিনটি ছিল হাটবার। হাটের বেচাকেনা শেষ করে সবাই যখন নিত্যদিনের মতো ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখনই অতর্কিত নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর আক্রমণ করে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী।

শুরু হয় গুলি, জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ঘর-বাড়ি। গ্রামবাসী প্রাণ ভয়ে ছোটাছুটি করলেও পালানোর পথ খুঁজে পায় না। পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা পুরো গ্রাম ও সাঁথিয়া উপজেলার রূপসী, বাউসগারি গ্রামেও একইসঙ্গে শুরু করে গণহত্যা। মুহূর্তেই শান্তিপ্রিয় গ্রামে এমন নির্মমতায় সবাই স্তব্ধ হয়ে পরে।

রাতভর গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে গিয়ে চালানো হয় হত্যাযজ্ঞ, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগ। তাদের নির্মমতার শিকার হয় গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবার। পাকিস্তানি সেনারা রূপসী গ্রামে গোরস্তানের সামনে একটি গর্ত করে একসঙ্গে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষের মরদেহ পুতে রাখে।

তাদের রাতভর হত্যাযজ্ঞের পর ডেমরা, বাউসগারি ও রূপসী গ্রামের রাস্তা আর বাড়িগুলোতে থাকে লাশ আর লাশ। পুরে ছাই হয়ে যায় গ্রামের কয়েকশ ঘর-বাড়ি।

ডেমরা গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধকালীন পাবনা জেলার সবচেয়ে বড় গণহত্যা। হত্যার শিকার অনেকেরই পরিচয় আজও অজানা রয়ে গেছে।

ডেমরা গ্রামের মানুষ আজও সেই দিনের ভয়াল স্মৃতি আকরে বেঁচে আছেন। তাদের আক্ষেপ, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেড়িয়ে গেলেও সেই সব শহীদ পাননি স্বীকৃতি।

ডেমরা বাসস্ট্যান্ডে নির্মিত শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু/স্টার

ডেমরা বাজারের কাপড় ব্যবসায়ী অশোক কুণ্ডু বলেন, 'আমার বাবা জগদীশ কুণ্ডু তখন ডেমরা বাজারে কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন। আমাদের সম্পদও ছিল অনেক। সবাই বাবাকে ভারতে চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু, তিনি দেশ ছেড়ে না যাওয়ার সংকল্প করেন। পাকিস্তানি বাহিনী যখন গ্রামে হামলা চালায়, তখন আমার বাবা ও কাকা ২ জনেই গ্রামের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটতে থাকেন। আমি, আমার ছোট ভাই ও কাকী একটি রাস্তা ধরে রূপসী গ্রামের দিকে এগুতে থাকি। কিন্তু আমাদের আটকে দেয় হানাদার বাহিনী।'

তিনি বলেন, 'মায়ের সঙ্গে গ্রামের একটি খালে প্রায় পুরো রাত আমরা লুকিয়ে ছিলাম। ভোরের দিকে একটি বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে উঁকি দিয়ে দেখি আমার কাকা জতীশ কুণ্ডুর মরদেহ পরে আছে পাশেই। ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে তার দেড় বছর বয়সী শিশুটি। তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখি, বিশাল বাড়ির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। সব পুরে ছাই।'

তিনি আরও বলেন, 'এক রাতেই বাবা ও কাকাকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে যাই। পাশাপাশি বাড়ি-ঘর দোকানপাট সব পুরিয়ে দেওয়ায় এক রাতের মধ্যেই আমাদের সচ্ছল পরিবারটি রাস্তায় নেমে আসে।'

'সব হারিয়েও যখন বিজয়ের পতাকা দেখি, তখন খুশি হয়ে যাই। যাদের রক্তে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার বাবা ও কাকাও আছেন,' যোগ করেন তিনি।

অশোক কুণ্ডু বলেন, 'স্বাধীন দেশে একটাই চাওয়া, আমার বাবা ও কাকাসহ যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে গেলেন, তাদের যেন শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়।'

একই সুর ভেসে আসে সেদিন ডেমরা গ্রামে শহীদ প্রতিটি মানুষের পরিবারের কাছ থেকে।

ডেমরা বাজারের ব্যবসায়ী রতন কুমার নন্দি বলেন, 'আমার বাবা মনিন্দ্রনাথ নন্দিকে পাকিস্তানি বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে বাড়ির সামনের রাস্তায়। গাছের ওপর লুকিয়ে ছিলাম। নিজ চোখে দেখেছিলাম সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য। আজও সেই দৃশ্য যেন চোখের সামনে ভাসে।'

'আর সব শহীদের মতোই বাবার মরদেহটিও রূপসী-বাউসগারির গণকবরে কোনো সৎকার ছাড়াই সেদিন মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়। আমার বাবার নামটি শহীদের তালিকায় দেখব, এই আশা নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিলাম। দুর্ভাগ্য, আজও তা পেলাম না।'

ডেমরা চরপাড়া গ্রামের আব্দুল হাই বলেন, 'পাকবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা সেদিন আমার বাবা খোরশেদ প্রাং, চাচা খবির প্রাং ও চাচাতো ভাই ইউসুফ আলিকে নির্মমভাবে হত্যা করে। লাশের স্তূপ থেকে তাদের মরদেহ খুঁজে বের করে একদিন পর দাফন করা হয়।'

তিনি বলেন, 'ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তাদের কবরের কোনো মূল্যই থাকবে না। শুধু আমাদের বাড়ি নয় ডেমরা, রূপসী ও বাউসগারি এলাকার অনেক বাড়িতেই রয়েছে শহীদের কবর, গণকবর।'

ডেমরা গণহত্যার শহীদদের স্মরণে গণকবরে একটি স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে ২০০৯ সালে। এ ছাড়া ডেমরা বাসস্ট্যান্ডে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে ২০১১ সালে।

বর্তমানে রূপসী গ্রামে একটি স্থায়ী শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ও সংগ্রহশালা নির্মাণের কাজ চলছে।

তবে শহীদ পরিবারগুলোর দাবি, শুধু স্তম্ভ করলেই হবে না। শহীদদের নামের তালিকা করে তাদের যথাযথ সম্মান দেওয়া না হলে ইতিহাস থেকে তাদের নাম হারিয়ে যাবে।

Comments

The Daily Star  | English

Extortion will no longer be tolerated: DMP chief

He urged rickshaw drivers to provide the names of the extortionists and promised strict action

20m ago