বিচারহীনতার সংস্কৃতি রাষ্ট্রকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়: আসাদ চৌধুরী

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

আসাদ চৌধুরী বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন। কবিতা, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য সম্পাদনা মিলিয়ে তার বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। তার ব্যঙ্গার্থক জনপ্রিয় দুটি কবিতার লাইন 'কোথায় পালালো সত্য', 'তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/এখন আছি অল্প।'

আসাদ চৌধুরী তার সাহিত্য কীর্তির জন্য অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ২০১৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন।

সদ্যপ্রয়াত এই কবি নিজের লেখালেখি, সমাজ, রাজনীতি ও শৈশব নিয়ে গত বছর কথা বলেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে। সেই লেখাটিই আজ পাঠকদের জন্য আবারো তুলে দেওয়া হলো।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনার 'ঘরে ফেরা সোজা নয়' একটা বই আছে। আসলেই কী ঘরে ফেরা সহজ না?

আসাদ চৌধুরী: অবশ্যই তা সহজ না। একবার বাড়ি থেকে দূরে গেলে আর সহজে বাড়ি ফেরা যায় না। আর এই মুহূর্তে বাঙালির জন্য আরও কঠিন বাড়ি কিংবা ঘরে ফেরা।

ডেইলি স্টার: আপনি নিজেও একজন ভ্রমণপিয়াসু। সে দিক থেকে একটু ব্যাখ্যা করবেন?

আসাদ চৌধুরী: বাড়ি মানে কী—একটা আইডেন্টিটি, একজন মানুষের পরিচয়। যেখানে আমার আপনার অঞ্চল ভাগ করা আছে। এতে ফিরতে পদে পদে বাঁধা থাকে, চাইলেই যাওয়া যায় না। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বলছি, বাড়ি সহজে ফেরা যায় না।

ডেইলি স্টার: প্রসঙ্গত বলা যায়, ৪টি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও সেই নীতিতে আমরা কেন যেতে পারছি না?

আসাদ চৌধুরী: এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। কেউ এটা নিয়ে কথা বলে না। তবু বলছি, রাষ্ট্রীয় ৪ নীতির মধ্যে সর্বশেষ ও অন্যতম সমাজতন্ত্র। এই শব্দটি গত ১২ বছরে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা একটিবারও উচ্চারণ করেনি। অথচ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের শক্তি বলে দাবী করে। আমরাও সেটা মেনে নিয়েছি, কিন্তু তারা সেই নীতির আশেপাশেও যেতে পারছে না। গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আর এটা আপনি আমি মানি আর না মানি বাস্তবতা তাই বলে।

এই বাস্তবতা আওয়ামী লীগের দু-একজন জ্ঞানী যারা, তারাও স্বীকার করবেন। আওয়ামী লীগের ভাগ্য ভালো এখনো কিছু ভালো মানুষ আছে তাদের দলে। এর বাইরে যারা বর্তমান রাজনীতির নিয়ন্ত্রক তাদের প্রায় ৯০ ভাগ চোর। চোরেরা রাজনীতি বুঝে না, মানবেও না কোনো নীতি।

প্রসঙ্গত আবুল মনসুর আহমদের কথা বলা যায়। তিনি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের মানুষ ছিলেন। তাকে কেউ মনে করে না। অথচ তার কাজ ও ভাবনা লিখে গেছেন 'আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর' বইতে।

ডেইলি স্টার: আপনার শৈশব কোথায় কেটেছে?

আসাদ চৌধুরী: আমার শৈশব অনেক জায়গায় কেটেছে। প্রথম দিকে ঢাকায়, কিছুদিন কলকাতায় তারপর বরিশালের উলানিয়ায়।

ডেইলি স্টার: পাঠ্য বইয়ের বাইরে বইয়ের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক হলো?

আসাদ চৌধুরী: পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই দিয়েই জীবন শুরু হয়। প্রথম দিকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানেই পড়িনি। সেই স্বাধীনতাও পেয়েছি পরিবার থেকে। স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, গিয়ে দেখলাম তাতে সাহেবরা পড়ায়, ফাদাররা পড়ায় না। আমি আব্বাকে বললাম, আমি ইংরেজি স্কুলে পড়ব না। বিষয়টি আমার পছন্দ হয়নি। প্রচণ্ড স্বাধীনতা ছিল শৈশবে।

ডেইলি স্টার: আপনার বাবা মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরী একজন এমএলএ ছিলেন। এমন পরিবারে আপনার শৈশবের ঈদ কেমন ছিল?

আসাদ চৌধুরী: আমাদের চারপাশের পরিবেশটা বিশাল, জমিদারি পরিবার। একই সঙ্গে কনজারভেটিভ এবং খুবই সেকুলার। এর মধ্যে ঈদ আনন্দ ছিল অন্যরকম। অন্যদের চেয়ে আমাদের একটু ব্যবধান ছিল। ঈদে আমাদের সবার আচকান পরতে হতো। ১৯৫৪ সালের পর আচকান পরতে কাউকে দেখিনি।

ডেইলি স্টার: ঈদের দিন কেমন খাবার হতো?

আসাদ চৌধুরী: বিভিন্ন ধরণের শরবত, পায়েস থাকতো। কাশ্মীর থেকে জর্দা আসতো আমাদের জন্য, বিশেষ করে কলকাতা থেকে কিছু খাবার আসতো। আস্ত খাসির রেজালা, পেস্ট্রি, প্যাটিস, কেক এবং ভালো চা আসতো। বাঙালি খাবারের সঙ্গে নানীর বাড়ি বিক্রমপুরের খাবার মিশ্র ছিল কিছুটা।

ডেইলি স্টার:  সাহিত্য অঙ্গনে আসার পরিবেশটা কেমন ছিল পরিবারে?

আসাদ চৌধুরী: সাহিত্যে আসার পরিবেশটা পারিবারিকভাবে তৈরি ছিল। বাসায় প্রবাসী, মোহাম্মদী, ভারতবর্ষ, মাহে নও, সওগাতসহ অনেক পত্রিকা রাখা হতো। আমার এক মামা শিশু সওগাত রাখতেন। এর মধ্যে আমার প্রিয় ছিল মোহন সিরিজ।

আমি নজরুলের অনেক বই ক্লাস ফোরে থাকতেই পড়ি। নজরুলের কবিতাগুলো জোরে জোরে পড়তাম। ফলে ছন্দটা তখন মনে হয় কানে গেঁথে গিয়েছিল। অন্যদিকে বিখ্যাত আবদুল গাফফার চৌধুরীকে দেখেছি কাছ থেকে, পড়েছি তার সুপারহিট উপন্যাসগুলো। আর তিনি ছিলেন আমার নানীর আপন ছোট ভাই, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জামাতা।

আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় যখন পড়ি, তখন মোহাম্মদী পত্রিকায় তিনি আমাকে প্রুফ দেখার চাকরি দিলেন। তার পাশে বসে ডালপুরি খেতাম। গাফফার ভাই যেদিন চাকরি ছেড়ে দিল, সেদিন আমার চাকরিও চলে গেল।

ডেইলি স্টার:  আপনার প্রথম বই 'তবক দেয়া পান'। তবকের মানে কি?

আসাদ চৌধুরী: তবক হচ্ছে আসলে সংস্কৃত থেকে আসা বাংলা শব্দ। তবক অর্থ স্তবক। মানে কোনো কিছুকে ঢেকে রাখা। আগের দিনে আমি দেখেছি, খুব পাতলা কাগজের মতো রূপা অথবা সোনা দিয়ে তবক থাকতো, ওটার ওপরে পান দিয়ে ভাঁজ করে দিতো। সেই লোকজ বিষয়টা মাথায় রেখে লেখা হয় 'তবক দেয়া পান'। সরল ও লোক সংস্কৃতির গন্ধ মাখা নাম তবক।

ডেইলি স্টার:  কবিতায় বলেছেন 'তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/এখন আছি অল্প'। বুঝিয়ে বলবেন কী?

আসাদ চৌধুরী: এটা আমি ৭১ এর পরিপ্রেক্ষিতে বলেছি। ৭১ এ আমাদের মাঝে একটা সহজাত ঐক্য ছিল। মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা ছিল, বিশ্বাস ছিল। মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি ও ভালোবাসা ছিল।

আমরা দেখতাম, তখন নিচতলার মানুষ বাজার করতে না পারলে দোতলার মানুষ বাজার পাঠিয়ে দিতো। দোতলার মানুষ বাজার করতে না পারলে নিচতলার মানুষ পাঠিয়ে দিত। তারপর ৭৫ এ দেখলাম হঠাৎ পরিবর্তন।

ডেইলি স্টার:  সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন 'আপোষ করিনি কখনোই আমি—এই হ'লো ইতিহাস'। আপনি কী বলেন?

আসাদ চৌধুরী: হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছেন। আপোষ করিনি কখনোই আমি—এই হ'লো ইতিহাস। কিন্তু আপোষ যারা করেছে তাদের ইতিহাস লেখা নেই।

ডেইলি স্টার:  রাজনীতি এবং দলবাজি—২টিকে কীভাবে দেখেন?

আসাদ চৌধুরী: ১০০ বার আলাদা করে দেখি। রাজনীতি এবং দলবাজির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। রাজনীতিটা এখন আমার কাছে দুঃখজনক বাস্তবতা।

ডেইলি স্টার:  আমাদের রাজনীতি মূল্যবোধের জায়গা থেকে কতটা সরে গেছে?

আসাদ চৌধুরী: অনেক সরে গেছে। রাজনীতি এখন একটাই—ক্ষমতায় যাব কি করে, ক্ষমতায় থাকবো কি করে। এই ধান্ধায় সারাদিন তারা ব্যস্ত থাকে। এর বাইরে রাজনীতি কই? আর আছে চুরিচামারি করা। তবে আমাদের বাংলাদেশের অবস্থান বৈশ্বিকভাবে খুব ভালো। আমেরিকা পটাতে বাধ্য হচ্ছে, সৌদি আরব এতদিন বিরোধিতা করে এখন পটাতে বাধ্য হচ্ছে, চীন এখন জাপানের চেয়ে বেশি ইনভেস্ট করছে বাংলাদেশে।

চুরি-চামারি সব সময় ছিল। এখন ৭০ ভাগ খেয়ে ৩০ ভাগ হলেও কাজ করছে। বাংলাদেশে এক ধরনের উন্নতি হয়েছে কোনো সন্দেহ নেই। পরিকাঠামোও ইম্পর্ট্যান্ট।

ডেইলি স্টার:  নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী-শিক্ষার্থী সংঘর্ষের ঘটনায় ২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। একজনের পরিবার বলছেন বিচার চাই না। বিচার না চাওয়া আমাদের কী বার্তা দিচ্ছে?

আসাদ চৌধুরী: এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। শিক্ষার্থীদের এমন কর্মকাণ্ড নিন্দনীয়। সমাজে কোনো ঘটনার বিচার না হওয়াই পরবর্তী ঘটনায় ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে বিচারের আশা ছেড়ে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর উচিত বিষয়টা কঠোরভাবে দেখা। মনে রাখা উচিত বিচারহীনতার সংস্কৃতি রাষ্ট্রকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়

ডেইলি স্টার:  এ ক্ষেত্রে সমাজে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা কী? সরকার বুদ্ধিজীবীদের মান্য করে?

আসাদ চৌধুরী: সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে টাকা। বুদ্ধিজীবীদের কাজ কী?

বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স, চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স, খুলনা চেম্বার অব কমার্স। কি রোল আছে বুদ্ধিজীবীদের? কে পাত্তা দেয়? এক সময় জাতীয় অধ্যাপক রাজ্জাক সাহেবের কাছে বঙ্গবন্ধু দৌড়ে গেছেন। বলেছেন, ইলেকশনের আগে যে ৬ দফা দিয়ে ফেলেছি। ৬ দফাভিত্তিক ইলেকশন এটাকে পাকিস্তানি ফ্রেমআউটের ভিতর কিভাবে রাখব?

রাজ্জাক সাহেব বললেন, পরে আইয়েন। আবার গেছেন বঙ্গবন্ধু। এইভাবে বুদ্ধিজীবীদের কাছে রাজনীতিবিদরা ধর্না দিতেন। এখন তাদের দরকার নেই। বৈধ-অবৈধভাবে যারা টাকা রোজগার করছেন, তারাই নিয়ন্ত্রণ করবেন দেশ।

ডেইলি স্টার:  কবিদের মধ্যে রাজনৈতিক অবস্থা কী?

আসাদ চৌধুরী: কবিদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা কম না, ভিতরে ভিতরে তারা নিজেদের সুবিধার জন্য হাহাকার করে।

ডেইলি স্টার:  সংস্কৃতি নিয়ে অনেক আলাপ, কখনো কখনো বাড়াবাড়ি পর্যন্ত হয়।

আসাদ চৌধুরী: আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তি কিন্তু এই সংস্কৃতির যে সামাজিক ভিত্তি সেটা কখনো পরিষ্কার করে না যে, কোনটা আমাদের আর কোনটা আমাদের না। সংস্কৃতি কখনো একটা নির্দিষ্ট জায়গায় থাকে না। নদীর মতো সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দেয়। এই জায়গাগুলো নিয়ে অনেকে না বুঝে হানাহানি করে। এটা বোঝার অভাব।

সংস্কৃতির সংজ্ঞা কি? সংস্কৃতি হচ্ছে, আমার যা আছে তাই। আমি ভাত আঙ্গুল দিয়ে মেপে খাই, এটা আমার সংস্কৃতি। টাকি মাছ কোথাও আদা দিয়ে, কোথাও লেবু দিয়ে রান্না করে। এটাই সংস্কৃতি। সমস্যাটা হয় কোথায়? সমস্যা অনেকগুলো জায়গায়। ১৯ শতকে যে নবজাগরণ হয়েছে হিন্দু সমাজে, এটা বাঙালি সমাজের কথা বললেও মুসলমানের কথা বলা হয়নি। এই নবজাগরণ সামগ্রিক জাগরণ না। একে অর্ধ রেনেসাঁ বলছেন গোপাল হালদার, বিনয় ঘোষসহ অনেকে।

ডেইলি স্টার:  আপনার বেশকিছু কবিতা জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু জনশ্রুতি আছে শক্তিশালী কবিতার চেয়ে দুর্বল কবিতাটা জনপ্রিয় হয়। কারণ কী?

আসাদ চৌধুরী: এটা হতেই পারে। স্যার ভি এস নাইপল কি লিখছেন? তার পরামর্শ হচ্ছে, ছোট ছোট বাক্য, সহজ বাক্য ইত্যাদি। তার টেকনিকটা হচ্ছে, যাতে দ্রুত মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করা। ৩টা জিনিস তিনি বেছে নিয়েছেন। রিলিজিয়ন, পলিটিক্স, সেক্স। পৃথিবীতে এই ৩টা জিনিস জনপ্রিয়। সুতরাং জনপ্রিয়তাও দরকার আছে।

Comments

The Daily Star  | English

Can't afford another lost decade for education

Whenever the issue of education surfaces in Bangladesh, policymakers across the political spectrum tend to strike a familiar chord. "Education is our top priority," they harp

3h ago