সত্যজিৎ রায়ের শেষ দিনগুলি
সত্যজিৎ রায় চলে গেছেন ত্রিশ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু আজও বাংলা চলচ্চিত্র তো বটেই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধ অধ্যায়ের নাম সত্যজিৎ রায়। অজস্র প্রতিকূলতা, সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ততার মধ্যেও বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্ব চলচ্চিত্রের তালিকায় সমুজ্জ্বল করার এক অবিনশ্বর কারিগর সত্যজিৎ রায়।
প্রখ্যাত জাপানী চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়া যথোপযুক্ত বলেছিলেন, 'সত্যজিৎ এর চলচ্চিত্র না দেখার অর্থ হলো আপনি পৃথিবীতে বাস করেও চন্দ্র-সূর্য দেখছেন না।'
সত্যজিৎ রায়ের গোটা জীবন ছিল একাগ্রতা, নিষ্ঠা, আর চলচ্চিত্রের প্রতি তার জীবনকে উপলক্ষ করার এক অনন্য উদাহরণ। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালি যেমন আটকে গিয়েছিল বারবার ঠিক তেমনি জীবনের শেষভাগেও চিকিৎসার জন্য অর্থের অপ্রতুলতা ছিল সত্যজিৎ রায়ের। যদিও পরবর্তীতে ভারত সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের আনুকূল্যে অর্থের ব্যবস্থা হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের জীবনের শেষ কয়েকটি বছর কেটেছিল বিক্ষুব্ধ ঝড়ের মতো। শারীরিক অবস্থার কারণে ভীষণ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি দীর্ঘ ৬ বছর চলচ্চিত্রের সঙ্গে কাটাতে পারেননি। তবে তিনি ভুলতেও পারেননি চলচ্চিত্রকে। কর্মব্যাপ্ত সত্যজিৎ এসময়ে করেছেন পুত্র সন্দ্বীপ রায়ের চলচ্চিত্রের সঙ্গীত, সন্দেশ পত্রিকার জন্য লিখেছেন গল্প এবং ছবি।
আইসিইউতে থাকা সত্ত্বেও ঘরে বাইরে চলচ্চিত্রের শুটিং নিয়ে কথা বলেছেন পুত্র সন্দ্বীপ রায়ের সঙ্গে।
অসুস্থ অবস্থাতেই পরে পরিচালনা করেছেন শেষ তিনটি চলচ্চিত্র এবং তার বাবা সুকুমার রায়ের উপর একটি তথ্যচিত্র। এই তিন চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য এবং সঙ্গীতও তার হাতেই সৃষ্ট। জীবনের শেষ ৯ বছরে তার শেষ তিন চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল ইনডোরে বা অভ্যন্তরীণ মঞ্চে। তার জীবনের বাকি চলচ্চিত্রগুলোর চেয়ে এগুলো অনেক বেশি সংলাপনির্ভর। সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে রইলো তার জীবনের শেষ নয়টি বছরের নানা ঘটনা প্রবাহ ও বর্ণিল অধ্যায়ের নানা অংশ।
১ অক্টোবর ১৯৮৩
৩০ সেপ্টেম্বর শুক্রবার চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সত্যজিৎ রায়কে ফোন করে জানালেন একটি সাক্ষাৎকার নেয়ার প্রয়োজনে তারা তাকে নিতে চান। বলে রাখা ভালো সেপ্টেম্বর মাসেই ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট সত্যজিৎ রায়ের কাছে একটি ফেলোশিপের আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যেই লন্ডনে চলে যাবেন তিনি।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে ফোনে সত্যজিৎ বললেন, 'আমার লন্ডনে যাবার আগে কিছু কাজ সারার আছে। কাজেই পনেরো মিনিটের বেশি কিন্তু সময় দিতে পারবো না।' বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত রাজি হলেন।
পরদিন ১ অক্টোবর সকাল ১০ টার দিকে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে গেলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। একটি ঘরে সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। একদিকে সরাসরি লাইটের আলো অন্যদিকে পাখা নেই। ঘেমে রীতিমতো অস্থির সত্যজিৎ। এক পর্যায়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে বলেই বসলেন, রিফ্লেক্টেড লাইট ব্যবহারের কথা। এরপর সত্যজিৎ রায়ের কথা অনুযায়ী রিফ্লেক্টেড লাইট ব্যবহার করা হয়।
বাড়ি ফিরে এসেও সত্যজিৎ ঘামছিলেন। সেদিন সত্যজিৎ রায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বেলভিউ নার্সিং হোমে।
এরপর সতর্কতাবশত সত্যজিৎ রায়কে টানা ৩ সপ্তাহ নার্সিং হোমের আইসিউতে রাখা হয়। হাসপাতাল থেকে তিনি বাড়িতে ফিরেন পরের বছর ১ জানুয়ারি।
১৯৮৪ সাল
ঘরে বাইরে চলচ্চিত্রের তখনো কিছু দৃশ্যায়ন বাকি। সত্যজিৎ রায় অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় সেই কাজটি করলেন সন্দ্বীপ রায়। তবে দৃশ্যায়নের কাজে শেষদিকে সত্যজিৎ রায়কে শুটিং স্পট চকদিঘিতে যেতে হয়েছিল। আগে সাধারণ পুরনো অ্যামবাসেডর গাড়িতে যাতায়াত করলেও অসুস্থতার দরুণ তাকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মার্সেডিজে যাতায়াত করতে হয়। একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শে তার গাড়ির পেছনে সার্বক্ষণিক ডাক্তার, নার্স এবং অ্যাম্বুলেন্স থাকতো। যেন শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হলে তাকে জরুরি চিকিৎসা দেয়া যায়।
চিকিৎসকেরা তার সম্পূর্ণ আরোগ্যের জন্য হার্টে বাইপাস সার্জারির পরামর্শ দিলেন। কিন্তু ভারতে বাইপাস সার্জারি না হওয়ায় তাকে যেতে হবে উন্নত বিশ্বের কোনো দেশে। অন্যদিকে অপারেশন বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় তা বহন করাও ছিল তার পরিবারের জন্য দুঃসাধ্য। এই বছরের ১১ মার্চ আবার হার্ট অ্যাটাক করেন সত্যজিৎ রায়।
তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। আইসিইউতে থাকা সত্ত্বেও এই চলচ্চিত্রের নানা বিষয় নিয়ে সন্দ্বীপ রায়কে পরামর্শ দেন সত্যজিৎ। কয়েকদিনের মাথায় বাড়ি ফিরে এসে তিনি অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলেন। সত্যজিৎ পত্নি বিজয়া রায় সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের গয়না বিক্রির এবং আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রাপ্য বইয়ের রয়্যালিটি জোগাড়ের জন্য। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে রয়্যালিটি বাবদ পুরো টাকা তুলে নিলেও এক সমস্যা। কারণ আনন্দ পাবলিশার্সের বই বিক্রির টাকাতেই সংসার চলে সত্যজিতের। এরই মধ্যে অমিতাভ চৌধুরী একদিন সত্যজিৎ রায়ের পরিস্থিতি দেখে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জানালে সত্যজিৎ রায়ের চিকিৎসা বাবদ ১ লাখ টাকা ও হিউস্টন যাত্রার দুটো টিকেটের ব্যয় বহন করবে বলে জানায় ভারত সরকার। কিন্তু চিকিৎসার তুলনায় একদিকে এই অর্থ সহায়তা ছিল খানিকটা অপ্রতুল। অন্যদিকে তার প্রয়োজন তিনটি টিকেট। যথাক্রমে তিনি, বিজয়া রায় এবং একজন সার্বক্ষণিক চিকিৎসক। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই রাজ্যের তরফ থেকে চিকিৎসা, বিমান টিকেট সহ সমস্ত কিছু বহনের আশ্বাস দেন। ২২ মে অসুস্থতার কারণে সত্যজিৎকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং এরপরেই হিউস্টন থেকে খবর এলো সত্যজিতের অপারেশন হবে ১৮ জুন। সে বছরের ১৮ জুন এবং ২০ জুলাই দুদফা অপারেশন শেষে ১৪ আগস্ট কলকাতায় ফিরে আসেন সত্যজিৎ রায়।
১৯৮৫ সাল
১২ ফেব্রুয়ারি মুম্বাই থেকে সত্যজিৎ রায়ের কাছে টিভি সিরিয়ালের প্রস্তাব এসেছিল। পরদিন ১৩ ফেব্রুয়ারি সত্যজিতের লেফট ভেন্ট্রিকুলার ফেলিওর হলে ২৭ মার্চ পর্যন্ত বাড়িতে বিশ্রামে থাকেন সত্যজিৎ। মার্চ মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি লিট ডিগ্রি প্রদানের ঘোষণা দেয়। মে মাসে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য সত্যজিৎ রায়কে মনোনীত করা হয়। ২ সেপ্টেম্বর কলকাতায় নিজ দেয়া নামেই পশ্চিমবঙ্গ চলচ্চিত্র কেন্দ্র 'নন্দন' উদ্বোধন করেন তিনি। অক্টোবর মাসে সত্যজিতকে লন্ডন থেকে মোৎজার্টের 'ম্যারেজ অব ফিগারো' পরিচালনার আমন্ত্রণ জানালে তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সন্দ্বীপ রায়ের চলচ্চিত্রের সঙ্গীত করার মাধ্যমে কাজে ফিরেন সত্যজিৎ। একই মাসে তাকে নেহেরু পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এসময় যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ও তাকে সম্মানসূচক ডি লিট প্রদানের ঘোষণা দেয়। চিকিৎসক কর্তৃক তার চলচ্চিত্রে কাজের বারণ থাকায় এসময়ে দ্বিগুণ উৎসাহে 'সন্দেশ' পত্রিকার জন্য গল্প লিখেছিলেন যেমন তেমনি এঁকেছেন ছবিও।
১৯৮৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সত্যজিৎকে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। সত্যজিৎ রায়ের আগ পর্যন্ত কোনো চলচ্চিত্র পুরস্কার সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পাননি। ১৬ এপ্রিল সত্যজিৎকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা 'লিজিয়ন অব অনারে' মনোনীত করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে কাঠমুণ্ডু সফরে যান সত্যজিৎ। কাঠমুণ্ডু থেকে ফিরে এসে ১৫ সেপ্টেম্বর বাবার উপর তথ্যচিত্র 'সুকুমার রায়' নির্মাণের কাজ শুরু করেন সত্যজিৎ। প্রায় ৩ বছর ৯ মাস পর শুটিংয়ে ফিরেন সত্যজিৎ। তিন দিন বাড়িতে এবং দুদিন স্টুডিওতে কাজ চলে। প্রথমে এইচএমভিতে ডকুমেন্টারির জন্য 'আসিছে রাবণ বাজে ঢক্ক ঢোল' গান রেকর্ডিং হয়। এই বছরের ৩১ অক্টোবর প্রদর্শিত হলো তথ্যচিত্র 'সুকুমার রায়'। বলা বাহুল্য আগেরদিনই ছিল সুকুমার রায়ের শততম জন্মদিন। একই বছরের ৬ ডিসেম্বর নেপালের কাঠমাণ্ডু ভ্রমণে যান সত্যজিৎ।
১৯৮৮ সনে
ফেব্রুয়ারির শেষ দিন কাঠমাণ্ডু থেকে ফিরে আসেন সত্যজিৎ। মার্চ মাসে বিবিসি থেকে সত্যজিতের উপর তথ্যচিত্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়। সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি, তার চলচ্চিত্র যাত্রার অজানা নানা তথ্য উঠে এসেছিল এই তথ্যচিত্রে। ১ মে কাঠমাণ্ডু যান সত্যজিৎ এবং তার সে বছরের জন্মদিন কাটে কাঠমাণ্ডুতে।
জুন মাসে তার পীড়াপীড়িতে চিকিৎসকেরা সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স রাখার শর্তসাপেক্ষে সত্যজিৎ রায়কে চলচ্চিত্র পরিচালনার অনুমতি দেন। শর্তের মধ্যে আরও ছিল কোন প্রকার আউটডোরে শুটিং করা যাবে না। সম্পূর্ণ শুটিং হবে স্টুডিওতে। শর্ত শুনে তিনি বিজয়া রায়কে বললেন, 'ভাবতে পারো আমাকে লোকেশন শুটিং করতে দেয়া হবে না। ঐ বন্ধ স্টুডিওতে যা করার করতে হবে, আমি নিজে যা অত্যন্ত অপছন্দ করি। কিন্তু কী করবো! কাজ না করতে পারলে আমি পাগল হয়ে যাবো। এতো বসে বসে আর কাঁহাতক দিন কাটানো যায়।'
চলচ্চিত্রের জন্য গল্প খুঁজতে গিয়ে হেনরিক ইবসেনের 'এনিমি অব দ্যা পিপল' কে চলচ্চিত্রের গল্প হিসেবে নির্বাচন করে চিত্রনাট্য তৈরি করেন সত্যজিৎ। ১৮ জুলাই অভিনয়শিল্পীদের চিত্রনাট্য পড়ে শোনানোর চারদিন পরেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন সত্যজিৎ।
২৬ অক্টোবর চিকিৎসকদের বৈঠকে তার সম্ভাব্য ডিসেম্বর মাস থেকে শুটিংয়ের বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে সার্বক্ষণিক অ্যাম্বুলেন্স, নার্স, ডাক্তার এবং লাইটিংয়ের সময় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের ব্যবস্থা রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।
এর আগে সব চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় নিজে ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করলে এই চলচ্চিত্রে তার পক্ষে আর তা সম্ভব হলো না। সন্দ্বীপ রায় নিজেই ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করলেন এবং ১ ডিসেম্বর প্রথম দিনের শুটিং ভালোভাবেই শেষ হলো। কিন্তু এদিন রাতে হঠাৎ অস্বস্তিবোধ করলেও পরদিন শরীর ভালো থাকায় শুটিংয়ে গেলেন সত্যজিৎ। এরপর ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটানা শুটিং চললো। মাঝে এক সপ্তাহের বিরতির পর ২৮ ডিসেম্বর এই চলচ্চিত্রের শুটিং শেষ করলেন সত্যজিৎ। শেষদিকে ফরাসি সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা নানাভাবে সত্যজিতের শুটিংয়ের ছবি তুললেন। এসময়ে সাউন্ড অ্যান্ড সাইট এবং বিবিসি তার সাক্ষাৎকার নেয়।
১৯৮৯ সাল
১৩ জানুয়ারি ঘোষিত হয় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ নিজে কলকাতায় এসে সত্যজিৎ রায়কে 'দ্যা লিজিয়ন অব অনারে' ভূষিত করবেন। ২ ফেব্রুয়ারি ন্যাশনাল লাইব্রেরি চত্বরে সত্যজিৎ রায়কে স্বর্ণপদক পরিয়ে দিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। ৭ ফেব্রুয়ারি সত্যজিৎ রায়ের গণশত্রু চলচ্চিত্রের শুটিং শেষ হলো এবং ১০ এপ্রিল নন্দনে চলচ্চিত্রটি প্রদর্শিত হয় এর মধ্যে গুপী গাইন বাঘা বাইন সিরিজের তৃতীয় এবং শেষ চলচ্চিত্র গুপী বাঘা ফিরে এলো চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। একই সঙ্গে চলে তার পরবর্তী 'শাখা প্রশাখা' চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের কাজ। চিত্রনাট্য প্রস্তুত হলে ২৪ সেপ্টেম্বর চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পীদের চিত্রনাট্য পড়ে শোনান সত্যজিৎ রায়। ৬ অক্টোবর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় সত্যজিৎ রায়কে ডি লিট ডিগ্রি প্রদানের ঘোষণা দেয়।
২৯ অক্টোবর বাথরুমে পড়ে গেলে সত্যজিৎ রায়কে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সে বছরের ২৪ ডিসেম্বর সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দ্বীপ রায়ের বিয়ে হয়।
১৯৯০ সাল
এই বছরের ১৯ জানুয়ারি বসুশ্রী সিনেমা হলে মুক্তি পায় 'গণশত্রু' চলচ্চিত্র। ৫ মার্চ শেষ হয় শাখা প্রশাখা চলচ্চিত্রের শুটিং। ২২ নভেম্বর আগন্তক চলচ্চিত্রের শুটিং শুরু হয়। এবং এর পরদিনই ২৩ নভেম্বর মুক্তি পায় শাখা প্রশাখা চলচ্চিত্র।
১৯৯১ সাল
১৯৯১ সালের ৬ মে মুক্তি পায় আগন্তুক চলচ্চিত্র। জুন মাসে সপরিবারে কাঠমাণ্ডু গেলেন সত্যজিৎ। সে বছরের ১৭ জুলাই চোখের ছানির অপারেশন হলো সত্যজিৎ রায়ের।
সে বছরের ১১ আগস্ট রাইট ভেন্ট্রিকুলার ফেইলিয়োরের দরুণ নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয় সত্যজিৎ রায়কে। নার্সিং হোমে ভর্তির পর কিছুটা সুস্থ হলেন সত্যজিৎ। নার্সিং হোম থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বাড়ি ফিরে সত্যজিৎ রায় ঠিক করলেন সামনের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে নতুন চলচ্চিত্র উত্তরণের শুটিং শুরু করবেন তিনি।
শারীরিক পরিস্থিতির অনেকখানি উন্নতি হলে ১৩ অক্টোবর থেকে নার্স রাখার প্রয়োজন পড়বে না বলে জানালেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু সেদিনই শ্বাসকষ্ট শুরু হলো সত্যজিতের। ১১ ডিসেম্বর ফের নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয় সত্যজিৎকে।
১৪ ডিসেম্বর অস্কার কমিটি থেকে পাঠানো একটি টেলিগ্রামে বলা হলো, ১৯৯২ সালের ৩০ মার্চ সত্যজিৎ রায়কে আজীবন সম্মাননা হিসেবে একাডেমি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করা হবে। এদিকে তার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে ডাক্তারেরা বললেন, হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশনের বিকল্প নেই। সত্যজিৎ রায় সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি একই সঙ্গে এই সুযোগে অস্কার গ্রহণ করবেন এবং হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশনের অপারেশনও করবেন।
১৯৯২ সাল এবং মৃত্যু
৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেল গুপী বাঘা ফিরে এলো। ২৭ জানুয়ারি নার্সিং হোমে ভর্তি হলেন সত্যজিৎ রায়।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হলে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয় সত্যজিৎ রায়কে। এরপর হার্ট ট্রান্সপ্লান্টেশনের অপারেশনের জন্য সত্যজিৎ রায়কে প্রস্তুত করানো হচ্ছিল। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে সত্যজিৎ রায়ের শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হলেও ১২ মার্চ কিছুটা স্বাভাবিক হলো।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্কার পুরস্কার নিয়ে বেশ কয়েকজন এলেন। অস্কার তুলে দেয়া হবে সত্যজিৎ রায়ের হাতে। কিন্তু কীভাবে তা করা হবে তাই ভাবা হচ্ছিলো। এটি জানাজানি হলে সত্যজিৎ রায়ের কানে গেল। তিনি বললেন, নার্সিং হোমের যদি আপত্তি না থাকে তবে আমিই এই ঘরে এটি রিসিভ করব। কোনদিনও পাবো বলে ভাবিনি। সেটা পাবো আর আমি নিজে তা নেবো না তা হয় না!' ১৮ই মার্চ অস্কার তুলে দেয়া হলো সত্যজিৎ রায়ের হাতে। তার আট দিন পরে ২০ মার্চ তাকে ভূষিত করা হলো ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ভারতরত্ন পদকে।
এপ্রিলের শুরু থেকে সত্যজিৎ রায়ের অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে গেল। কথা বন্ধ হয়ে গেল তার।
একপর্যায়ে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করা হয়।
২৩ এপ্রিল চলে যান এই কিংবদন্তী সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার।
সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যু মুহূর্ত নিয়ে বিজয়া রায় লিখেছিলেন, 'কিছুক্ষণ পর ডা. বক্সী ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। শান্ত ধীর স্থির ভাব। এতদিন ধরে প্রচণ্ড যুদ্ধ করে এসেছেন। কিন্তু ঈশ্বরের কাছে হার স্বীকার করতে কোন লজ্জা নেই। প্রচণ্ড ঈশ্বরে বিশ্বাসী মানুষ - শান্ত গলায় বললেন, 'হঠাৎ হার্টটা স্টপ করে গেল- ওরা চেষ্টা করেছে কিন্তু কিছু হবে না।'
আজ সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
Comments