মাখোঁ নাকি লা পেন, কে হচ্ছেন ফ্রান্সের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট
কে হবেন ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট- লা পেন নাকি ইমানুয়েল মাখোঁ। এই প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে আগামীকাল ২৪ এপ্রিল। কারণ ২৪ এপ্রিল ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রানঅফ। আর সেখানেই মুখোমুখি হচ্ছেন লা পেন ও মাখোঁ। এ যেন ২০১৭ সালের পুনরাবৃত্তি। সেবার কট্টর ডানপন্থী মেরিন লা পেন রাজনীতিতে নবাগত ইমানুয়েল মাখোঁর মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে, এবার প্রার্থী একই থাকলেও ২০২২ সালের প্রতিযোগিতা পুরোপুরি ভিন্ন হতে যাচ্ছে।
ফ্রান্সের নির্বাচন যেভাবে হয়
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২ রাউন্ডে হয়ে থাকে। প্রথম রাউন্ডে কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে দ্বিতীয় রাউন্ড বা রানঅফে অংশ নিতে হয়। প্রথম রাউন্ডে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া ২ প্রার্থী রানঅফে অংশ নিতে পারেন।
এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গত ১০ এপ্রিল প্রথম রাউন্ডের ভোটে ১২ জন প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তারা সারা দেশের ৫০০ মেয়র অথবা স্থানীয় কাউন্সিলরদের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে তবেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতা অর্জন করেন। প্রথম দফায় মাখোঁ এবং লা পেন সবচেয়ে বেশি ভোট পান। তবে, ফ্রান্সের নিয়ম অনুযায়ী যেহেতু কেউই ৫০ শতাংশে বেশি ভোট পাননি তাই আগামীকাল তারা রানঅফ বা দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে অংশ নেবেন।
সিএনএন বলছে, মাখোঁ এবং লা পেন গত ২০ এপ্রিল সন্ধ্যায় টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নেন। সেসময় লা পেনকে ২০১৭ সালের চেয়ে বেশি প্রস্তুত বলে মনে হয়েছে। বিতর্কে লা পেন মাখোঁকে অর্থনৈতিক বিষয়ে আক্রমণ করেন। তিনি যুক্তি দেন ফরাসিদের জন্য মুদ্রাস্ফীতি এবং ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্য মোকাবিলায় সহায়তা করতে মাখোঁ যথেষ্ট কাজ করেননি।
সিএনএন অনুমোদিত বিএফএম টিভির এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৯ শতাংশ ভোটার তাদের দু'জনের মধ্যে মাখোঁকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেশি পছন্দ করেন। আগামীকাল ২৪ এপ্রিল রানঅফ বা দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তারপর জানা যাবে কে হচ্ছেন ফ্রান্সের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট।
জরিপ কী বলছে
পলিটিকো ও সিএনএন বলছে, ২০১৭ সালের নির্বাচনের চেয়ে এবার ব্যাপক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। মাখোঁ এবং লা পেন উভয়েরেই ২০১৭ সালের তুলনায় এ বছর প্রথম রাউন্ডে মোট ভোটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, চলতি মাসের প্রথম দিকে প্রথম রাউন্ডের আগের জরিপগুলোতে দেখা যায়, মার্চে লা পেনের সমর্থন ঊর্ধ্বমুখী ছিল।
সিএনএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১০ এপ্রিল প্রকাশিত আইফপ-ফিডুসিয়ালের জরিপে দেখা গেছে- মাখোঁ দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লা পেনের বিরুদ্ধে মাত্র ৫১ শতাংশ থেকে ৪৯ শতাংশ ব্যবধানে জয়ী হতে পারেন। প্রথম রাউন্ডের ফলাফল আসার পর কয়েক দিনের মধ্যে মাখোঁর সমর্থন কিছুটা বেড়েছে বলে একই জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রায়ই বলেন, ফরাসিরা প্রথম রাউন্ডে মন থেকে ভোট দেন। আর দ্বিতীয় রাউন্ডে মাথা খাটিয়ে ভোট দেন। যার অর্থ তারা প্রথমে তাদের আদর্শ প্রার্থীকে বেছে নেন, তারপরে দ্বিতীয় রাউন্ডে দু'জনের মধ্যে দেশের জন্য ভালো ব্যক্তিকে বেছে নেন।
মাখোঁ ২০১৭ সালে এই চিত্রপট দেখেছিলেন। সেবার তিনি এবং লা পেন প্রথম রাউন্ডে যথাক্রমে ২৪ শতাংশ এবং ২১.৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। অথচ দ্বিতীয় রাউন্ডে মাখোঁ পান ৬৬.১ শতাংশ ভোট এবং লা পেন পান ৩৩.৯ শতাংশ ভোট।
মাখোঁ যেখানে এগিয়ে
পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার জন্য মাখোঁকে সম্ভবত অতি-বাম প্রার্থী জঁ-লুক মেলেনচনের সমর্থকদের তার দিকে টানতে হবে। ২২ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থানে ছিলেন মেলেনচন। মেলেনচন অবশ্য তার সমর্থকদের বলেছেন, মিসেস লা পেনকে অবশ্যই একটি ভোটও দেওয়া উচিত হবে না। তবে, তিনি স্পষ্টভাবে মাখোঁকে সমর্থন জানাননি।
বেশিরভাগ পরাজিত প্রার্থী তাদের সমর্থকদের মাখোঁকে সমর্থনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার কারণ একটাই তারা চান না ডানপন্থী কেউ প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হন। সেদিক থেকে মাখোঁ অবশ্যই সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন।
অন্যদিকে উস্কানিমূলক বাগাড়ম্বরের জন্য পরিচিত ডানপন্থী প্রার্থী ও প্রাক্তন টিভি ব্যক্তিত্ব এরিক জেমিমোর তার সমর্থকদের লা পেনকে সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছেন।
মাখোঁ এবং লা পেনকে নিয়ে যা জানা দরকার
সিএনএন বলছে, মাখোঁ একজন প্রাক্তন ব্যাংক বিনিয়োগকারী এবং ফ্রান্সের সবচেয়ে অভিজাত স্কুলগুলোর সাবেক শিক্ষার্থী। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি রাজনীতিতে নবীন ছিলেন। শুধু তাই নয় চলতি বছর তিনি দ্বিতীয়বার রাজনৈতিক নির্বাচন করছেন। তবে তিনি এখন আর নবীন নন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বায়ত্তশাসন এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্থানকে শক্তিশালী করতে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা তাকে বিদেশে এবং দেশে খ্যাতি এনে দিয়েছিল। যদিও এইউকেইউএস সাবমেরিন চুক্তি প্রতিরোধের চেষ্টা এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ এড়ানোর ব্যর্থ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা তার ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
তবে, মাখোঁর দেশীয় নীতিগুলো কম জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কয়েক দশকের মধ্যে ফ্রান্সের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিক্ষোভগুলোর মধ্যে 'ইয়োলো ভেস্ট' আন্দোলনটি তাকে ব্যাপক সমালোচনায় ফেলে। এছাড়া, করোনা মহামারি নীতিমালা নিয়েও তাকে বিতর্কিত হতে হয়।
মহামারিতে তার স্বাক্ষর নীতি- মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে টিকা দেওয়ার প্রমাণ দেখাতে হবে দেশে টিকা গ্রহণের হার বাড়াতে সহায়তা করেছিল। তবে তার প্রেসিডেন্সির বিরুদ্ধে মানুষ জোরপূর্বক এসব নীতি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিল ফ্রান্সের অনেক মানুষ।
মাখোঁ এই নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডের আগে বিরোধীদের সঙ্গে বিতর্কে অংশ নিতে অস্বীকার করেন। এছাড়া তিনি প্রচারণাও চালান খুবই কম। তবে, তার অবস্থান মোটেও হুমকির মধ্যে ছিল না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি এড়াতে তিনি এই কৌশলের আশ্রয় নেন। আর এজন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার ভাবমূর্তির দিকে মানুষের মনোনিবেশ বেড়েছে।
অন্যদিকে লা পেন ফরাসিদের সবচেয়ে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। তিনি জিন-মেরি লা পেনের কন্যা। যিনি ন্যাশনাল ফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যে দলটি লা পেনের বর্তমান রাজনৈতিক দলের পূর্বসূরি। তরুণ লা পেন দলটিকে পুনরায় আলোচনায় আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি।
প্রেসিডেন্ট পদে এবার তিনি তৃতীয়বার নির্বাচন করছেন। চলতি বছর ও ২০১৭ সালের প্রথম দফার ভোটে বাবাকে ছাপিয়ে গিয়েছেন তিনি।
২০১৭ সালে লা পেন ফ্রান্সের অভিবাসী শ্রমিক শ্রেণীকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। যদিও তার এই প্রচারণা খুব বেশি কাজে আসেনি। তারপর থেকে তিনি তার সবচেয়ে বিতর্কিত নীতির প্রস্তাবগুলো পরিত্যাগ করেন। যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করা।
সিএনএনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সামগ্রিকভাবে তার অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদী অবস্থান, অভিবাসনের বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, ইউরোপের সংশয়বাদ এবং ফ্রান্সে ইসলামের অবস্থান পরিবর্তন নিয়ে তার নীতির পরিবর্তন হয়নি। তার ইশতেহারের দুটি প্রধান অগ্রাধিকার হলো- 'অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন বন্ধ করা' এবং 'ইসলামী মতাদর্শ নিয়ন্ত্রণ'।
তবে, ব্রেক্সিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ করে ইসলাম ও ইইউকে ঘিরে লা পেন তার সুর নরম করার চেষ্টা করেছেন। বিকল্প হিসেবে তিনি পকেটবুক ইস্যুতে কঠোর প্রচারাভিযান চালিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, প্রতিটি পরিবারের কোষাগারে ১৫০ ইউরো থেকে ২০০ ইউরো রাখা হবে। তাই এই কৌশলটি কাজ করেছে বলে মনে হচ্ছে।
২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে লা পেনের পারফরম্যান্স ছিল তার ৩ বারের মধ্যে তার সেরা ফলাফল।
Comments