আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাসে এক অমোচনীয় দাগ

ছবি: সংগৃহীত

অবশেষে দীর্ঘ ১৮ বছর পর হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায় হলো। এমন একটি মামলার রায় দিতে ১৮ বছর লেগে গেছে—এটিই সম্ভবত এখন মামলাটির অন্য সব দিককে ছাপিয়ে মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ কোনো রায়ের জন্য বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করতে হলে সেই রায় আর ন্যায়বিচারের প্রতীক থাকে না, ন্যায়বিচারে বিলম্বের উদাহরণে পরিণত হয়। 

ন্যায়বিচারের মাধ্যমে যেহেতু সবাইকে কিছু বার্তা দেওয়া হয়, সেহেতু এ ২টি বিষয়ের পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায়বিচারের মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং বিচারব্যবস্থা সতর্ক, ন্যায্য ও দ্রুত হওয়ার কারণে কোনো অপরাধী পার পাবে না। কিন্তু ন্যায়বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা এই বার্তার গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। 

হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার রায়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) ৪ সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ২ জন বর্তমানে পলাতক। যারা কারাবন্দি আছেন, তারা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে জানা গেছে। আমরা আশা করি, হাইকোর্টেও এ রায় বহাল থাকবে। তবে আপিল প্রক্রিয়া ন্যায়বিচারের অপেক্ষা আরও দীর্ঘায়িত করে দিতে পারে।

রায় ঘোষণার সময় ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আল মামুন তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ড 'পুরো জাতির জন্য লজ্জাজনক'। সত্যিকার অর্থে বিষয়টি তা-ই।

বিচারক আরও বলেছেন, মুক্তমনাদের কণ্ঠরোধ করতে, দেশকে অস্থিতিশীল করতে এবং বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে দোষী সাব্যস্তরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।

বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার মশালবাহক হুমায়ুন আজাদ তার শক্তিশালী লেখনীর মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নির্ভয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। ধর্মান্ধরা তাকে বারবার টার্গেট করা সত্ত্বেও তিনি কখনও লড়াই ছেড়ে দেননি। যারা তার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং ধর্ম, জাতীয়তা, লিঙ্গের গণ্ডির বাইরে গিয়ে তার ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন, তাদের ভয় দেখানোর লক্ষ্যেই তাকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের  উদ্দেশ্য ছিল বাকস্বাধীনতা এবং চিন্তার বৈচিত্র্যে বিশ্বাসীদের কণ্ঠরোধ করা।

দুর্ভাগ্যবশত, ওই একই সাম্প্রদায়িক শক্তি আজও সক্রিয়। শুধু তাই না, তারা আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী, আরও বেশি সাহসী। মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক জায়গায় সমাজে আরও বেশি অসহিষ্ণুতা তৈরি হচ্ছে এবং মেরুকরণ হচ্ছে। এর ফলে মুক্তমনা, মানবাধিকারকর্মী, অধিকার রক্ষাকারী এবং ধর্মীয় ও ভাষাগত দিক থেকে সংখ্যালঘুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের ওপর চলতে থাকা ক্রমবর্ধমান আক্রমণ আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাসে হুমায়ুন আজাদ হত্যাকাণ্ডের মতোই কালিমা লেপন করছে।

সুতরাং হুমায়ুন আজাদ হত্যাকাণ্ডের রায় হলেও, এমনকি এটি কার্যকর হলেও, এই পরিবেশে তার প্রভাব কতটুকু পড়বে, সেই বিষয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে। পচা আপেলের সংস্পর্শে যখন ভালো আপেলও পচে যাচ্ছে, অর্থাৎ কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তায় পুরো সমাজ যখন দৃশ্যত এ ধরনের লোকজনের চিন্তাধারা দিয়ে প্রভাবিত, তখন তখন কয়েকটা 'পচা আপেলকে' শাস্তি দেওয়াই যথেষ্ট নয়।

তাই রাষ্ট্রকে অবশ্যই সহনশীলতা ও বৈচিত্র্যের সংস্কৃতিকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করে, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিকদের রক্ষা করে এবং দ্রুত বিচারের জন্য ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার ক্ষমতায়ন করে ব্যাপক সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কার করার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। 

Comments

The Daily Star  | English
Tarique Rahman on election demands

Conspirators eyeing country’s resources like vultures: Tarique

Tarique said the conspiracy by mischievous elements, both within the country and abroad, against the BNP, its leaders, and the nation, does not stop

50m ago