রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি ছাত্রলীগের অনিয়মের সহযোগী?

রাবি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ফাইল ছবি

রাজনৈতিক সুবিধা পেতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের ৪ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে হল পরিবর্তন করার অভিযোগ উঠেছে। ছাত্র নেতাদের দাবি, ৪ জনের ক্ষেত্রে এই সুবিধা দেওয়া হলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই সুবিধা দেয় না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা আরও অভিযোগ করেছেন, রাবি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে প্রশাসন উল্টো তাদের অতিরিক্ত নানা সুবিধা দিয়ে আসছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি আবাসিক হল ও আইসিটি দপ্তর সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের ৪ নেতা-কর্মী গত মার্চে অনুষ্ঠিত হল সম্মেলনকে সামনে রেখে হল পরিবর্তনের আবেদন জানিয়েছিলেন। এরা হলেন—আশিকুর রহমান অপু, শেখ কামাল বিন হারুন, কবিরুজ্জামান রুহুল ও আলফাত সায়েম জেমস। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অপুকে বঙ্গবন্ধু হল থেকে শহীদ হবিবুর রহমান হল, কামালকে শাহ মখদুম হল থেকে সৈয়দ আমীর আলী হল, রুহুলকে শহীদ শামসুজ্জোহা হল থেকে বঙ্গবন্ধু হল এবং জেমসকে শহীদ হবিবুর রহমান হল থেকে বঙ্গবন্ধু হলে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই ৪ জনই তাদের কাঙ্ক্ষিত হলের শাখা ছাত্রলীগ কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদও পেয়েছেন।

ছাত্রলীগের একাংশের অভিযোগ, মূলত এই পদ পাওয়ার জন্যই তারা হল পরিবর্তন করেছেন। তারা আরও বলছেন, অনৈতিকভাবে শুধুমাত্র রাজনৈতিক সুবিধা নিতেই ৪ জন হল পরিবর্তন করেছেন, যা কমিটি ঘোষণার পরে আরও দৃশ্যমান হয়েছে।

যোগাযোগা করা হলে ৪ জনের ৩ জনই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা জানিয়েছেন, ব্যক্তিগত কারণে তারা হল পরিবর্তন করেছেন। তবে কামাল স্বীকার করেছেন, রাজনৈতিক কারণেই তার হল পরিবর্তন করা হয়েছিল।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি হল ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসতে চেয়েছিলাম, তাই সংগঠনের নেতাদের সহযোগিতায় আমি আমার হল পরিবর্তন করি।'

ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হল পরিবর্তন করার সুযোগ দিলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেই সুযোগ দেয় না বলে অভযোগ রয়েছে।

বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ডেইলি স্টারকে জানান, তারা হল পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন। প্রাথমিক অবস্থায় তাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, হল পরিবর্তন করা সম্ভব না।

ছাত্রনেতাদের অভিযোগ, হল পরিবর্তনে সহযোগিতা ছাড়াও নানাভাবে ছাত্রলীগকে সুবিধা করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে।

গত বুধবার শহীদ জিয়াউর রহমান হলে বরাদ্দ পাওয়া রুমে উঠতে গেলে মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী প্রসেনজিৎ তিগ্যাকে বাধা দেন হল শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি হল কর্তৃপক্ষ।

তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে যোগাযোগ করা হলে হলের প্রভোস্ট সুজন সেন বলেন, ওই শিক্ষার্থীকে যে সিট বরাদ্দ দিয়েছিলাম,  ওই সিটে সে উঠতে পারেনি বলে জেনেছি। তবে আমি তাকে অন্য একটি সিটে উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।

জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ওই শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট করে কোনো অভিযোগ করেনি। তাই আমরা প্রাথমিকভাবে বিষয়টি প্রক্টর ও ছাত্র উপদেষ্টা দপ্তরকে অবহিত করেছি। তারা বিষয়টি দেখবে বলে জানিয়েছে।

এর আগের দিন মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা হলের একটি রুম থেকে আকিব জাভেদ নামে এক আবাসিক শিক্ষার্থীকে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাতুলসহ ৭-৮ জন নেতাকর্মীর নেতৃত্বে রুম থেকে বের করে দেওয়া হয়। তারা কমল নামে অনাবাসিক এক শিক্ষার্থীকে ওই রুমে তুলে দেন। ওই ঘটনার প্রতিবাদে ওই দিন সন্ধ্যায় উপাচার্য ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচির ডাক দেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতারা।

তবে নেতাদের অভিযোগ, 'ঘটনা সমাধান হয়ে গেছে, কাজেই এ নিয়ে আন্দোলন করা যাবে না। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে—দাবি করে ছাত্র উপদেষ্টা তারেক নূরের নেতৃত্বে তাদের এই কর্মসূচি পালনে বাধা দেওয়া হয়।'

জানতে চাইলে তারেক বলেন, সিট সমস্যার সমাধান হওয়ায় তাদের কর্মসূচি করতে নিষেধ করেছিলাম। বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। 

প্রশাসন সমাধান হয়ে গেছে দাবি করলেও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষার্থী আকিব তার নামে বরাদ্দ রুমটি ফেরত পাননি। তাকে অন্য একটি রুমে তুলে দেওয়া হয়েছে। আকিবের রুমে যাকে তুলে দেওয়া হয়েছিল, অনাবাসিক হওয়ার পরও তিনি সেখানেই আছেন। রুম থেকে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনায় জড়িত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শের-ই-বাংলা হলের প্রভোস্ট হাবিবুর রহমান বলেন, কীভাবে কী ঘটেছে তা জানতে ২ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আকিবকে তার সিটে স্থানান্তর করা হবে। জড়িতদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গত ২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা হলে শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত শতাধিক প্যাকেট খাবার ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে হল ছাত্রলীগের সভাপতি চিরন্তন চন্দ ও সাধারণ সম্পাদক মোমিন ইসলামের বিরুদ্ধে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ঘটনার সময় হল প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।

সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর দপ্তর জানিয়েছিল, হল কর্তৃপক্ষকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এর কদিন পরেই হল প্রভোস্ট একরামুল ইসলাম জানান, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ক্ষমা চেয়েছেন। তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে।

সৌরভ নামে এক বাকপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ২৯ মার্চ মধ্যরাতে মতিহার হল থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেওয়া হলেও করো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে ওই হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক মুসতাক আহমেদ বলেন, বর্তমানে প্রতিটি হলেই এ সংক্রান্ত সমস্যা বাড়তে বাড়তে বৃহদাকার ধারণ করেছে। তাই চাইলেই হল কর্তৃপক্ষ এককভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।

তবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে অবহিত করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং হল প্রশাসন একযোগে সম্মিলিতভাবে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে 'হার্ডলাইনে' যেতে পারলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে, বলেন এই অধ্যাপক।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মিলন হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আমরা সংবাদ সম্মেলন করে, বিভিন্ন আলোচনা সভা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে অবগত করেছি। কিন্তু তারা বছরের পর বছর নিশ্চুপ থেকেছে।

রাকসু আন্দোলন মঞ্চের আহ্বায়ক আব্দুল মজিদ অন্তর বলেন, হল দেখভালের দায়িত্ব হল কর্তৃপক্ষের। অথচ এখন এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যেন, ছাত্রলীগই হল পরিচালনা করে। বরং তারা যাতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হয়, কর্তৃপক্ষ সে বিষয়েই বেশি নজর রাখে।

এর অন্যতম বড় প্রমাণ হলো 'রাজনৈতিক কারণ' জানার পরও ছাত্রলীগ নেতাদের হল পরিবর্তনে সহযোগিতার ঘটনা, বলেন তিনি।

আব্দুল মজিদ আরও বলেন, আমরা যতই অভিযোগ করি না কেন, হল প্রশাসন অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে কখনোই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় না। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ দিনের পর দিন এভাবেই ছাত্রলীগের অনিয়মে সহযোগিতা করে চলেছে।

হল পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় আইসিটি দপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক বাবুল ইসলাম বলেন, আমার জানা মতে গত কয়েক বছরে এই ৪ জনসহ মোট ৬ শিক্ষার্থীর হল পরিবর্তন করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, হল পরিবর্তনে কোনো বিধিনিষেধ নেই। পরিবর্তন করতে গেলে বিভিন্ন কারিগরি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় কর্তৃপক্ষকে, তাই শিক্ষার্থীদেরকে হল পরিবর্তনে সব সময় নিরুৎসাহিত করা হয়।

ছাত্রলীগের নেতাদের হল পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে আবদুস সালাম বলেন, আমি এ ব্যাপারে অবগত না। তবে খুবই জরুরি কোনো কারণ ছাড়া হল পরিবর্তনের আবেদন অনুমোদন করা উচিত না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার ডেইলি স্টারকে বলেন, রাজনৈতিক কারণে কোনো শিক্ষার্থীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। এসব কারণ দেখিয়ে হল পরিবর্তন করারও কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়ম সমান।

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ছাত্র সংগঠনগুলো নেতাদের তোলা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী যে-ই হোক না কেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। বিভিন্ন হলে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ব্যাপারে আমি অবগত হয়েছি। শিগগির সব হল প্রভোস্টদের নিয়ে আলোচনায় বসা হবে। যদি তারা এভাবে কোনো অন্যায়ের সহযোগিতা করে থাকে তবে তাদের বিষয়েও আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

Comments

The Daily Star  | English

Extortion will no longer be tolerated: DMP chief

He urged rickshaw drivers to provide the names of the extortionists and promised strict action

24m ago