সরকার নিরাপত্তা না দিতে পারলে, চাকরি করা সম্ভব না: হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল
মুন্সিগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল বলেছেন, 'সরকার যদি আমাকে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা দেয় তাহলে আমি স্কুলে শিক্ষকতা করার চেষ্টা করব। আর যদি নিরাপত্তা না দিতে পারে, তাহলে চাকরি করা সম্ভব হবে না।'
তিনি বলেছেন, 'পুলিশ সারাক্ষণ নিরাপত্তা দিতে পারবে না। দীর্ঘদিন ধরেই আমার পরিবারের সদস্যদের সামাজিকভাবে হেয় করা হচ্ছে। নানাভাবে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে এ স্কুলে শিক্ষকতা করা সম্ভব হবে না।'
'সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, আমাকে এ জেলার বাহিরে ঢাকায় কোনো স্কুলে শিক্ষকতার সুযোগ করে দেওয়া। আমি আমার শিক্ষকতা চালিয়ে যেতে চাই,' বলেন এই শিক্ষক।
আজ বুধবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদ শেষে স্কুলের মাঠে হৃদয় মণ্ডল দ্য ডেইলি স্টারকে এসব কথা বলেছেন।
গত ১২ এপ্রিল এ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান সরকারি হরগঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল হাই তালুকদার আজ সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষক, শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল, ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন।
জিজ্ঞাসাবাদের সময় স্কুলের গেটে পুলিশি নিরাপত্তা ছিল। তদন্ত কার্যক্রম হয় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে। এ কক্ষেই সারাদিন ছিলেন শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল।
হৃদয় মণ্ডল বলেন, '১৯ দিন কারাগারে থেকেছি চোর, ডাকাত, অপরাধীদের সঙ্গে। তারাও আমার ছাত্রই হয়ে গিয়েছিল। আগামী সোমবার শোকজের জবাব দেবো। স্কুল কমিটি যদি অনুমতি দেয় তবে সেদিনই চাকরিতে যোগদান করব।'
'চাকরি করাটাই আমার কাছে এখন অনিশ্চয়তা' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'স্বাভাবিকভাবে আবার স্কুলে শিক্ষাগতা করার নিশ্চয়তা নেই। কেননা আমার পরিবারের সদস্যের ওপর আক্রমণ চলছে। রাতে এখনো দরজা জানালায় লাথি দেয়। বাসার বাইরে গেলে বহিরাগতরা হুমকি দেয়। আমাদের ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হচ্ছে। ভয় নিয়ে কতদিন আমরা থাকব।'
'দীর্ঘদিন আগেও আমার ওপর ঢিল ছুঁড়েছিল স্কুলের করণিক। একটি হিসাব নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে ওই ঘটনা ঘটেছিল। এ বিষয়গুলো স্কুল কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানালেও কোনো লাভ হয়নি, বলেন তিনি।
হৃদয় মণ্ডল বলেন, 'ছাত্রদের যারা ইন্ধন দিয়েছে তাদের মাফ করা যাবে না। ছাত্রদের যারা পেছন থেকে ইন্ধন দিয়েছে তাদের উপযুক্ত শাস্তি হোক। আমার প্রতিপক্ষ শিক্ষকরাই। আমি স্কুলের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক। ছাত্ররা আমার কাছে পড়তে আগ্রহী। কিন্তু প্রতিপক্ষ শিক্ষক আমার প্রাইভেট পড়ানোর বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে না নিয়ে এ ষড়যন্ত্র করেছে।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'তদন্তের জন্য আমি স্কুলে এসেছিলাম। মাঠে দাঁড়িয়ে স্কুল দেখে আমি খুবই আনন্দিত।'
তার স্ত্রী ববিতা হাওলাদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশ সবসময় নিরাপত্তা দিতে পারবে না। কারণ সামাজিকভাবে আমাদেরকে যদি হেয় করা হয়, তবে এখানে বসবাস করা যাবে না। সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যদি ঢাকার কোনো স্কুলে আমার স্বামীকে শিক্ষকতা করার সুযোগ করে দেয়, তবে তার জন্য নিরাপদ হবে।'
'জামিন পাওয়ার পরও বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমার মাকে ইট হাতে নিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বাসার গৃহকর্মীকেও কাজে আসার পথে শাসানো হয়েছে। রাতে বাসার দরজায় জোরে জোরে লাথি দিয়ে গালিগালাজ করা হয়। আমাদের নিরাপত্তা সব সময় পুলিশ দিতে পারবে না,' বলেন ববিতা।
হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের স্ত্রীর বড় ভাই বাদল হাওলাদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা আমাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। এ সমাজে আমরা সংখ্যালঘু। আর আমাদের সবসময় ভয়েই থাকতে হচ্ছে।'
জানতে চাইলে বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'গত ২২ মার্চ ৩ দিনের মধ্যে শোকজের জবাব দিতে বলা হয়েছিল শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে তাকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত জেলে থাকতে হয়েছিল। এ জন্য ১০ এপ্রিল থেকে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে তাকে শোকজের জবাব দিতে বলা হয়েছে।'
'জবাব দেওয়ার পরই তিনি স্কুলে যোগদান করতে পারবেন। শোকজের জবাব পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের বিষয়ে আমরা আলোচনা করব,' বলেন তিনি।
তদন্ত কমিটির প্রধান সরকারি হরগঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল হাই তালুকদার বলেন, 'শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তোলা হয়েছে তার ব্যাপারে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। গত ১০ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৫ কর্ম দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা আছে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গেই আলোচনা করা হবে। যথাসময়ে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা হবে।'
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল কবে থেকে স্কুলে ফিরবেন সে ব্যাপারে তদন্ত কমিটি সিদ্ধান্ত দেবে না। স্কুল কর্তৃপক্ষ, ম্যানেজিং কমিটি এ ব্যাপারে বলতে পারবেন। শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে যে কথা উঠেছে সেটি ঠিক না বেঠিক, এটি তদন্ত কমিটি খুঁজে বের করবে।'
তিনি আরও বলেন, 'অডিও রেকর্ডটিও নিয়ে খুঁটিনাটি বিষয় দেখা হবে। তারপর স্কুলে মোবাইল আনা নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারেও তদন্ত করে দেখা হবে যে ছাত্ররা কোন উদ্দেশ্যে মোবাইল নিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করেছে।'
স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আকাশ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হৃদয় স্যারের সঙ্গে আমাদের ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। এখন আমরা চাই স্যার শিগগির ক্লাসে ফিরুক।'
গত ২০ মার্চ ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের কথোপকথনের জের ধরে কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। এতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়।
পরে ২২ মার্চ দুপুরে শিক্ষার্থীরা স্কুলে বিক্ষোভ করে এবং এরপর শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে পুলিশ আটক করে।
২২ মার্চ রাতে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা করেন একই স্কুলের অফিস সহকারী (ইলেকট্রিশিয়ান) আসাদ মিয়া।
এ মামলায় গত ১০ এপ্রিল দুপুরে জামিন শুনানি শেষে বিচারক হৃদয় মণ্ডলের জামিন মঞ্জুর করেন। সেদিন বিকেলে কারামুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যান তিনি। আজ বুধবার তিনি ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জে ফেরেন।
Comments