বুদ্ধিজীবীর দায় ও একজন হুমায়ুন আজাদ

প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর কোন বন্ধু থাকে না, শুভাকাঙ্ক্ষীও না। আপনা মাংসে হরিণা বৈরী যেমন ঠিক তেমন বুদ্ধিজীবীর ধর্মই তাকে বৈরী ও জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে। হুমায়ুন আজাদ বৈরী-জনবিচ্ছিন্ন ও অপ্রিয় হওয়ার সাহস অর্জন করেছিলেন। এই অর্জনই- তাকে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীর দায় বা  ধর্মে বিজয়ী জ্যোতির্ময় এক প্রজ্ঞা-আমাদের কালের একজন সক্রেটিস।  

এবার আসা যাক তাহলে বুদ্ধিজীবী কে? তার ধর্মইবা কী। বুদ্ধিজীবীর ধর্মপালনে একজন হুমায়ুন আজাদ কেমন ছিলেন? বুদ্ধিজীবীর ধর্মকে কতোটা উচ্চকিত করেছেন। সেই প্রসঙ্গে 'বুদ্ধিজীবী' শব্দটাকে কেউ কেউ মেধাজীবী বলেও চিহ্নিত করেছেন। এডওয়ার্ড সাইদ বুদ্ধিজীবীর চেয়ে মেধাজীবী বলতেই স্বচ্ছন্দবোধ করতেন এবং সেটাই করেছেন। বুদ্ধিজীবীর ধর্ম বুঝতে প্রথমেই যেতে হবে গ্রামসির কাছে। তিনি বুদ্ধিজীবীদের দেখছেন দু'ভাবে।

১. পরম্পরাভিত্তিক বুদ্ধিজীবী। শিক্ষক, পুরোহিত কিংবা প্রশাসক, যারা প্রজন্ম থেকে জন্মান্তরে একই রকম কাজ করে চলেছেন।

২. জৈব বুদ্ধিজীবী- স্বার্থ হাসিলের জন্য, ক্ষমতা আদায়ের জন্য কাজে লাগানো হয় এদেরকে। জৈব বুদ্ধিজীবীরা চলমান, গতিময়।

জুলিয়েন বেন্দা সংজ্ঞায়িত বুদ্ধিজীবীরা আবার অন্যরকম। একেবারেই বিপরীতধর্মী-চরম বিপরীতে এদের অবস্থান। বেন্দার বলছেন, প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা অধিবিদ্যার জোরে নিঃস্বার্থভাবে ন্যায় ও সত্যের নীতিতে অবিচল থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলেন, দুর্বলকে রক্ষা করেন, অন্যায় অত্যাচারী শাসনতন্ত্রকে কাঁচকলা দেখান। যেমনটা দেখা গেছে, ফেনেলন ও ম্যাসিলনের মধ্যে চতুর্দশ লুইয়ের যুদ্ধের নিন্দায়। ভলতেয়ার যেভাবে মুখ খুলেছিলেন প্যালাতিনেতের ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে। রেনঁ যেভাবে ধিক্কার জানিয়েছিলেন নেপোলিয়ন কর্তৃক বিপুল হিংসাকে। নিতশে যেভাবে ধিক্কার জানিয়েছিলেন ফ্রান্সের প্রতি জার্মান পাশবিকতাকে। বাকল যেভাবে ঘৃণা জানিয়েছিলেন ফরাসি বিপ্লব প্রসঙ্গে ইংল্যান্ডের মনোভাবকে।

বেন্দার আরো জানাচ্ছেন, আজকের দিনে বুদ্ধিজীবীর সমস্যাটা দাঁড়িয়ে আছে এখানেই যে, তারা তাদের নৈতিক কর্তৃত্বেও সবটুকু ঢেকে রেখেছে, ওই দূরদর্শী ভাষায়, 'সমষ্টির আবেগজাত জিগির-এর আড়ালে। এই সংগঠন দলবাজি, গণ-সেন্টিমেন্ট, জাতীয়তাবাদী যুদ্ধজিগির, শ্রেণীস্বার্থের মতো হরেক চেহারায় দেখা দিতে পারে।... সরকারের তরফে দাসসুলভ কিছু বুদ্ধিজীবী থাকা কতখানি প্রয়োজনীয়, যারা কখনোই হয়তো নেতৃত্ব দেবে না, কিন্তু সরকারি নীতিকে সংহত করবে, সরকারি শত্রুর বিরুদ্ধে প্রচার শানাবে, আর বৃহত্তর ক্ষেত্রে জাতীয় গৌরবের নামে কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক যৌক্তিকতার আড়ালে দিনকে রাত করে মজবুত করা হবে ' অরওয়েলীয় নিউজপিক'-কে।

'অরওয়েলীয় নিউজপিক'- এর কথা বেন্দা বলেছিলেন ১৯২৭ সালে- যখন গণমাধ্যমের আবির্ভাব আজকের দিনের মতো করে বাড়বাড়ন্ত হয়নি, তারপরও কতোটা নির্মম সত্য এই উচ্চারণ তা আজকের দিনে পৃথিবীর দেশে দেশে আরও বেশি করে উন্মোচিত হচ্ছে-প্রতিভাত হচ্ছে হররোজ। এই অচলায়তন ভাঙতে পারে- আলোয় মোড়া কুৎসিত এই অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে পারে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির প্রকৃত সেবকরা-যারা সমাজ রাষ্ট্র দেশে পালন করবেন বেন্দা বর্ণিত বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা।

এডওয়ার্ড সাইদের বুদ্ধিজীবী ও তার ধর্ম হলো : বুদ্ধিজীবী হবেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি স্বাধীনতা ও ন্যায় বিচারের পক্ষে সোচ্চার থেকে তার নিজস্ব বার্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত উপস্থাপন করবেন জনগণের জন্য জনগণের মঙ্গল আকাঙ্ক্ষায়। সত্য প্রকাশে ও সত্যের পক্ষে অবস্থান গ্রহণে তিনি কোনো অবস্থাতেই নিজ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হবে না।

হুমায়ুন আজাদ কি বুদ্ধিজীবীর এই ধর্ম পালন করেছেন? উত্তর  হ্যাঁ, তিনি সর্বদাই বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালন করেছেন। এবং তিনি জীবন দিয়ে দেখিয়েছেন যে, বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালনে ঝুঁকি নিতে হয়। বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালন এ পক্ষে-ও পক্ষে কিংবা তৃতীয় কোনো পক্ষে গিয়েও পালন করার নয়। এই ধর্ম পালনের দায় যেমন বৃহত্তর মানুষের জন্য তেমনি, নিজের কাছেও। নিজের কাছে অর্থ নিজ আদর্শের কাছে। হুমায়ুন আজাদ সারা জীবন এই কাজটা করেছেন। তাঁর বেশীরভাগ লেখালেখিতে বুদ্ধিজীবীর ধর্ম যথার্থভাবে পালিত হয়েছে এবং এ ব্যাপারে তিনি নেননি কোনো প্রকার আপসের আশ্রয়। ফলে, তিনি বিরাগভাজন হয়েছেন সকলের-সর্বমহলের। এই বিরাগভাজন হওয়াটাই  বুদ্ধিজীবীর ধর্ম। প্রশ্ন উঠেতে পারে কেনো, তার উত্তর একটাই-  তিনি নিজ আদর্শের প্রতি যে অবিচল থাকতে পেরেছেন এবং কোনোপ্রকার সম্মতি উৎপাদনকে থোড়াই কেয়ার করে নিজের জ্ঞানবিচার থেকে প্রকৃত সত্যটাকে উপস্থাপন করেছেন এবং বিরাগভাজন হবেন জেনেও  বলেছেন-এটাই প্রকৃত ও সাচ্চা বুদ্ধিজীবীর কাজ।

হুমায়ুন আজাদতো নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালন করে গেছেন। যে হন্তারক তাকে খুন করেছে, খুনের পেছনে যে সংঘবদ্ধচক্র যুক্ত ছিল তারা নিজেরাও হয়তো জানে না, হুমায়ুন আজাদের বুদ্ধিজীবীর যে ধর্ম, সেই ধর্ম তাদেরকেও আলোর পথে আনতে পালন করে সহায়ক ভূমিকা। তাদের ভেতরে যদি বিন্দুমাত্র শুভবোধ থাকে-মানুষের জন্য মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা থাকে হুমায়ুন আজাদ সেই শুভবোধ-সেই মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্যই লড়াই করে গেছেন মসীর শক্তিতে- মসীকে আশ্রয় করে। হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে এই লেখা যখন তৈরি হচ্ছে তখনই জানা গেল, তাঁকে হত্যা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে এবং চারজনের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। হুমায়ুন আজাদের মতো একজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যার রায় ঘোষণা করতেও লেগে গেল প্রায় দেড় যুগ। এসব কি প্রমাণ করে না, রাষ্ট্র ক্ষমতায় যে বা যারাই থাকুক না কেন, হুমায়ুন আজাদরা মূল্যায়নের বাইরে থেকে যায়। হুমায়ুন আজাদরা রাষ্ট্রের কল্যাণে, জনগণের মুক্তি ও বাক স্বাধীনতার জন্য  নিজেদেরকে উৎসর্গ করলেও, রাষ্ট্রযন্ত্র যারা চালায় তারা সেটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না, কিংবা মনে করলেও প্রকাশে তার  নজির রাখেন না। ফলে, হুমায়ুন আজাদরা সবারই বিরাগভাজন হন, সেটা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের চালকদের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য-একই সঙ্গে প্রযোজ্য রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে যারা রয়েছেন তাদের ক্ষেত্রেও। হুমায়ুন আজাদরা কারোরই প্রিয়পাত্র হন না। এবং এই না হওয়ার মধ্য দিয়ে এটাও প্রতীয়মান হয় যে, এই সময়ের এদেশে, হুমায়ুন আজাদের কালের বাংলাদেশে সত্য কতোটা অপাংক্তেয়, এখানে অন্ধকারের চাষাবাদের জন্য জমিন ও আবহাওয়া কতোটা উর্বর এবং অনুকূল। হুমায়ুন আজাদরা বন্ধুহীন। 

হুমায়ুন আজাদ এর গবেষণা ধর্মী কাজের বাইরের সৃজন ও মনন জগতের সকলে কাজেই তিনি বুদ্ধিজীবীর ধর্মকে সর্বদায় ‍শুধু প্রাধান্য দেননি-সেটাকেই ধ্যান-জ্ঞান করেছেন। কখনোই কোনো চেয়ার-ব্যক্তি বা সংঘবদ্ধতার দিকে তাকিয়ে-পাটিগণিতের সূত্র মেনে লেখালেখিকে পঙ্কিল ও আবর্জনাময় করে তোলেননি। আমরা এই লেখায় চকিতে সেসবের কিছু নমুনা দেখে নেব।

'আমাদের শহরে একদল দেবদূত' বইয়ের হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন : 'আমাদের শহরকে আমরা আর কেউ ভালোবাসি না। আমি জানি আমাদের শহর আমার কথা শুনলে খুব কষ্ট পাবে, আমার মতোই আর ঘুমোতে পারবে না, মনে মনে কাঁদবে। … আমি আমাদের শহরের চোখের নিচে চোখের কোণে কালো কালি দেখতে পাই। মনে হয় আমাদের শহর ও আমাদের মতোই ঘুমোতে পারে না। ঘুমোতে পারলে কারো চোখে এতো কালি জমে না ! ভালবাসলে কেউ এতো ঘুমহীন থাকে না।'
হুমায়ুন আজাদের শহর আরও নষ্ট হয়েছে। দূষণে-বসবাসে এই শহর এখন অযোগ্য হতে হতে একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। তারপরও শহরের যারা কর্তা তারা কেবলই বয়ানই দিচ্ছে। হুমায়ুন আজাদের সময়েও ছিল যে বাস্তবতা তার কলুষিত চিত্র বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন:

'আমাদের শহর খুব চমৎকারভাবে আমাদের খেয়ে ফেলতে পারে। আমাদের শহর খুব ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছে। রক্ত না পেলে আমাদের শহরের তৃষ্ণা মেটে না।'
সত্যিইতো এই শহরের রক্ত না পেলে তৃষ্ণা মেটে না। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টিতো নেইই, বরং অস্বাভাবিক মৃত্যুই এই শহরের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বুদ্ধিজীবীর ধর্ম থেকে হুমায়ুন আজাদ এই শহরের এই অচলায়তন দেখে শুধু ব্যথিত হননি। স্পষ্ট করে বলেছেন এর জন্য দায় কার-কাদের ব্যর্থতায় একটা শহর হয়ে উঠলো-হয়ে উঠেছে বসবাস অযোগ্য তার কথাও। তিনি বলছেন :

'আমাদের বড় বিপদ হচ্ছে আমাদের শহর যারা চালান তারা নষ্ট … আমরা সাধারণেরা ভয়ে কুঁকুড়ে থাকে। কখন কাকে ধরে নিয়ে যাবে, কে আর ফিরে আসবে না, কার চোখ উপড়ে নেবে, কার পায়ের রগ কেটে দেবে, এসব ভাবতে ভাবতে আমরা স্বপ্নেও শিউরে উঠি।'

হুমায়ুন আজাদের বুদ্ধিজীবীর ধর্মের মধ্যে কোমল মনের আশাবাদী এক মানুষেরও বসবাস ছিলো। সেখানে হোঁচট খেয়েছেন হয়তো প্রতিনিয়ত-কিন্তু প্রত্যাশাকে খাটো করেননি-টুটি চেপে ধরেননি। যেমনটা মেলে 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না' বইয়ে। হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন, 'ভাল থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।/ ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,/ ভালো থেকো বক, আড়িয়াল বিল,/ ভাল থেকো নাও, মধুমতী গাও, ভালো থেকো।/ ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।/ ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।'

দায় অনুভব করে বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালনের অনন্য এক নজির মেলে হুমায়ুন আজাদের সংকলনগ্রন্থ 'আধুনিক বাঙলা কবিতা'র সংকল গ্রন্থে । তিনি লিখেছেন : 'এখানে সক্রিয় অজস্র কবিযশোপ্রার্থীর মধ্যে তাঁদেরই নিয়েছি, যারা কবি; তবে কয়েকজনকে নিই নি, সেটা আমাদের সময়ের শোচনীয় দুর্ভাগ্য- সৈয়দ আলী আহসান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন ও আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা নিই নি, আমি নিতে পারি না, কেননা তারা সামরিক একনায়কত্ব ও মৌলবাদে দীক্ষা গ্রহণ করে মানুষ ও কবিতা ও আধুনিকতার বিপক্ষে চ'লে গেছেন। এ-সংকলনটিকে আমি ভবিষ্যতের জন্য রেখে যেতে চাই, এক শতক পর আমার মতো কেউ এটি বিচার করবেন।

হুমায়ুন আজাদের এই বিচার ও সিদ্ধান্তে অনেকে আহত হতে পারেন, এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি তর্ক হাজির করা যেতে পারে। আমার কাছে সেসব একান্তই গৌণ বিষয়। মুখ্য হলো হুমায়ুন আজাদের বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালনের সাহস, এখানেই হুমায়ুন আজাদ অনন্য এবং বাংলাদেশে তুলনারহিত এক নাম।

প্রবচনগুচ্ছ যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয় জানেন এখানেও তিনি কতোটা উজান গাঙয়ের মাঝি। প্রবচনগুচ্ছের ৮ ও ৯ নাম্বারের দিকে আমরা একটু চোখ রাখলেও দেখবো -হুমায়ুন আজাদের শক্তি ও প্রজ্ঞার প্রখরতায়।

'আজকাল আমার সাথে কেউ একমত হ'লে নিজের সম্বন্ধে গভীর সন্দেহ জাগে। মনে হয় আমি সম্ভবত সত্যভ্রষ্ট হয়েছি, বা নিম্নমাঝারি হয়ে গেছি।' (প্রবচনগুচ্ছ ৮)

'মিনিস্টার' শব্দের মূল অর্থ ভৃত্য। বাঙলাদেশের মন্ত্রীদের দেখে শব্দটির মূল অর্থই মনে পড়ে। (প্রবচনগুচ্ছ ৯)

হুমায়ুন আজাদের ২ ও ৪ নাম্বার প্রবচনগুচ্ছ পড়লে তো আমাদের চমকে উঠতে হয় না শুধু, শিহরিতও হতে হয়। কী বললেন সেটা যেমন ব্যাপার তেমনি কতোটা সাহসী কথা বললেন সেটাও সমধিক গুরুত্ববহ। সবকিছুর আপাত অর্থ ও তাৎক্ষণিক উত্তর খোঁজার এদেশে-এইসময়ে হুমায়ুন আজাদ কতোটা ঝুঁকি নিয়ে একথা বলেছেন তা ভাবলে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায় । 

হুমায়ুন আজাদের কবি প্রতিভার এক সিগনেচার সৃষ্টি হলো, 'সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে'। এ কাব্যগ্রন্থের 'না, তোমাকে মনে পড়ে নি' কবিতার অংশবিশেষ এরকম : ' বুঝেছি যা-কিছু লিখেছে পাঁচ হাজার বছর ধ'রে মানুষ ও তাদের/ দেবতারা- সবেই অপাঠ্য, অন্তঃসারশূন্য, ভারি বস্তাপচা। আর অই/ শ্রীরবীন্দ্রনাথকে মনে হয়েছে নিতান্তই গদ্যলেখক, শোচনীয় গৌণ এক কবি।'
এই হচ্ছে হুমায়ুন আজাদ-এই হচ্ছে তাঁর বুদ্ধিজীবীর ধর্ম- এই হচ্ছে তাঁর বিশ্বাসের মৌলশক্তি। এখানেই হুমায়ুন আজাদ সবার থেকে ব্যতিক্রম-প্রকৃত বুদ্ধিজীবীর স্বয়ম্ভু এক সত্ত্বা।

সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে কাব্যগ্রন্থের 'তুমি সোনা আর গাধা করো' কবিতায় তার দ্ব্যার্থহীন উচ্চারণ, 'তুমি যাকে দেহ দাও, তাকে গাধা করো/ তুমি যাকে স্বপ্ন দাও, তাকে সোনা করো।'
প্রেমিকার কাছেও হুমায়ুন আজাদ খাপখোলা এক তলোয়ার, ট্রিগারে আঙ্গুল রেখে-চোখে চোখ রেখে বিশ্বাসের ঐরাবত ছোটানোর এক সাহসী যোদ্ধা। লুতুপুতু কোনো সংলাপ বা শব্দচয়ন নয়-বিশ্বাসের বাণ ছুটিয়েছেন অর্জুনের নিশানায়-একলব্যের ধ্যানে আর যুধিষ্ঠিরের মতো সত্যের মতো পক্ষপাতে।

কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ নামের কবিতায় হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, 'আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।/ নষ্টদের দানবমুঠোতে ধরা পড়বে মানবিক/ সব সংঘ পরিষদ;-চলে যাবে অত্যন্ত উল্লাসে/ চ'লে যাবে এই সমাজ সভ্যতা- সমস্ত দলিল-/ নষ্টদের অধিকারে ধুয়েমুছে, যে –রকম রাষ্ট্র/ আর রাষ্ট্রযন্ত্র দিকে দিকে চ'লে গেছে নষ্টদের/ অধিকারে। চ'লে যাবে শহর বন্দর গ্রাম ধানখেত/ কালো মেঘ লাল শাড়ি শাদা চাঁদ পাখির পালক/ মন্দির মসজিদ গির্জা সিনেগগ নির্জন প্যাগোডা।/ অস্ত্র আর গণতন্ত্র চ'লে গেছে, জনতাও যাবে;/ চাষার সমস্ত স্বপ্ন আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে একদিন/ সাধের সমাজতন্ত্রও নষ্টদের অধিকারে যাবে।'

হুমায়ুন আজদের বেদনা এখানে গর্ভবতী মেঘের মতো জল হয়ে ঝরেছে। সেই জলে স্নান করতে করতে করতে আমাদের চোখ রাখতে হবে হুমায়ুন আজাদের রবীন্দ্র প্রেমে-বিরোধীতায় ও দ্রোহে। তিনি যখন রবীন্দ্রনাথের পক্ষপাত নেন তখন বলেন এভাবে : 'রবীন্দ্রনাথের সব জ্যোৎস্না আর রবিশঙ্করের/ সমস্ত আলাপ হৃদয়স্পন্দন গাথা ঠোঁটের আঙুর/ ঘাইহরিণীর মাংসের চিৎকার মাঠের রাখাল/ কাশবন একদিন নষ্টদের অধিকারে যাবে।'

রবীন্দ্রনাথকে কখনো তিনি ছুঁড়ে দিচ্ছেন খারিজ করার বাসনায়-নিমিত্তে, আবার যখন মনে করছেন এখানেই রবীন্দ্রনাথ অনন্য-নমস্য-তুলনারহিত, তখন তাঁকে হাজির করছেন শ্রদ্ধার ডালি মেলে-হৃদয়ের পবিত্রতায়।

হুমায়ুন আজাদ ডানে ছিলেন না, বামে ছিলেন না, মধ্যপন্থায় ছিলেন না, সুবিধাবাদে ছিলেন না, স্বজনে-স্তুতিতে ছিলেন না। ছিলেন কেবল বুদ্ধিজীবীতায়-বুদ্ধিজীবীর ধর্মে পালনে। একারণে তার রবীন্দ্রনাথ নানা রূপের-নানা আধার ও আধেয়-র।

হুমায়ুন আজাদের 'রাজনীতিবিদগণ' পাঠান্তে, 'আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম' এর পাঠমগ্নতায় এই সত্যই হাজের-নাজেল হয় যে, তিনি কেবলই বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালন করেছেন। তিনি সত্য প্রকাশ করেছেন। সমালোচনার জায়গায় পিছপা হননি। মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য জ্ঞান করে সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলেছেন। বাংলাদেশে একটা বাক্য প্রবলভাবে উচ্চারিত হয়, 'এখানে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশী।' একথা হয়তো সত্যি-কিংবা সত্যি নয়। কিন্তু বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা এখানে শূন্যের কাছাকাছি।

এই শূন্যতায় হুমায়ুন আজাদ যেন গর্বের প্রার্থনালয়-আশাবাদের বাতিঘর, যিনি অকপটে বলতে পারেন, 'লম্পটের অশ্লীল উরুতে গাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী'।

গ্রামসি-বেন্দা-সাইদ বুদ্ধিজীবীর যে সংজ্ঞা দিয়েছেন, যা আমরা আলোচনা করেছি লেখার শুরুতে। লেখার শেষে এসে এখন আমাদেরই দেখার দায় বুদ্ধিজীবীর ধর্মে একজন হুমায়ুন আজাদ কোন ভূমিকা পালন করেছেন-কার সংজ্ঞায়িত বুদ্ধিজীবীর দায় মিটিয়েছেন বাংলাদেশ ও এই গ্রহকে আলোকিত করার লক্ষ্যে-নিজের চিন্তা-বিবেচনা ও দর্শনকে পাথেয় করে।
 

Comments

The Daily Star  | English
Public universities admission woes in Bangladesh

Public universities: Admission woes deepen for students

Admission seekers are set to face increased hassle with at least 10 public universities no longer participating in the cluster-based admission test system. They are holding entrance exams on their own.

8h ago