হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে গ্রেপ্তার: ‘শিক্ষকরা পিছু হটবেন, বাড়বে অশিক্ষা’

কোনো এক কল্পিত 'শিব ঠাকুরের' দেশের 'সর্বনেশে' আইন-কানুন নিয়ে প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায় লিখেছিলেন, 'চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়,/এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়,/রাজার কাছে খবর ছোটে,/পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,'

'একুশে আইন' নামের ওই ছড়ার আরেক জায়গায় সুকুমার বলছেন, 'যে সব লোকে পদ্য লেখে,/তাদের ধ'রে খাঁচায় রেখে,/কানের কাছে নানান সুরে,/নামতা শোনায় একশো উড়ে…'

মুন্সিগঞ্জের স্কুল শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডল পদ্য লেখেন কিনা জানা যায়নি। তবে তিনি গত ২০ মার্চ তার বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির একটি অনির্ধারিত ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সেখানে একজন ছাত্র বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের তুলনা করে তাকে কিছু প্রশ্ন করে। হৃদয় মণ্ডল সেগুলোর জবাব দেন।

পরে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ওই আলোচনা মোবাইলে রেকর্ড করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা হয় হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে।

ওই মামলায় গ্রেপ্তারের পর হাকিম আদালতে এবং দায়রা জজ আদালতে ২ দফায় জামিন মেলেনি মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের।

ব্যাপারটি জানাজানি হলে ক্রমে ওই খবর উঠে আসে সংবাদ মাধ্যমে। ক্লাসে পাঠদানের আলোচনাকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার ও জামিন না পাওয়া নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। শেষমেশ গ্রেপ্তারের ১৯ দিন পর আজ রোববার আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেন।

বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিমের সঙ্গে।

তারা বলছেন, এভাবে আইনি প্রক্রিয়া যথাযথভাবে না মেনে ও ঘটনার প্রেক্ষাপটসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিয়ে একজন শিক্ষককে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর অর্থ হলো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উসকে দেওয়া। এতে করে শিক্ষকের অ্যাকাডেমিক স্বাধীনতার পরিসর সংকুচিত হয়ে আসবে। বাড়বে অশিক্ষা। শিক্ষকরা ভীত হয়ে পড়বেন। পিছু হটবেন। আর শিক্ষকদের পিছু হটা মানে পুরো জাতির পিছু হটা।

পাশাপাশি এই ঘটনায় পুলিশ ও স্কুল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা।

হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের ঘটনাটিকে 'অবিশ্বাস্য ও খুবই উদ্বেগজনক' হিসেবে অভিহিত করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, 'একজন শিক্ষকের মূল ভূমিকা হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করা। প্রশ্ন সৃষ্টি করা। আরও পড়াশোনার আগ্রহ তৈরি করা। বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের রেকর্ডের যে ভার্সন আমরা শুনেছি, তাতে এটাই মনে হয়েছে যে, তিনি সে দায়িত্বটাই পালন করছিলেন। যথেষ্ট ধৈর্যের সঙ্গে।'

তিনি আরও বলেন, 'ঘটনাটা যেভাবে ঘটল, ছাত্ররা রেকর্ড করল তার বক্তব্য, তার মানে একটা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে করেছে তারা। ক্লাস টেনের ছাত্ররা নিজেদের বুদ্ধিমতো এটা করেছে, তা আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় একটা বড় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এটা করা হয়েছে। হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে শায়েস্তা করা, সেই সঙ্গে এ ধরনের আলোচনা যাতে স্কুলগুলোতে না হয়, তার জন্য একটা চাপ সৃষ্টি করা।'

এ পর্যায়ে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এই অধ্যাপক বলেন, 'আরেকটা উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে, তার ভিত্তিতে একটা মামলা হলো এবং মামলার যে বাদী, তিনি নিজেই পরবর্তীতে জানালেন যে, তিনি এসব বিষয়ে কিছু জানেন না। আমরা দেখি যে, অনেক বড় বড় অপরাধ হলেও থানায় মামলা নিতে চায় না। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বাদী নিজেই স্পষ্ট না, কিন্তু পুলিশ খুব দ্রুত মামলা নিয়ে নিল। তাড়াতাড়ি অ্যাকশনে গেল। মামলায় জামিন অযোগ্য ধারা যুক্ত করল।'

এই ঘটনার প্রভাবের বিষয়ে তিনি বলেন, 'এমনিতেই আমাদের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সরকারের নানা ধরনের হস্তক্ষেপ, সরকারি ছাত্র সংগঠনের যে ভূমিকা, সরকারপুষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্তাবকবৃন্দের যে ভূমিকা–এর সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের স্বাধীনভাবে শিক্ষাদান কিংবা ভূমিকা পালন করা, গবেষণা করা নানাভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

'সে জন্য অনেকে দেখা যায় কী পড়াবেন ক্লাসে, কী প্রশ্ন করবেন সেগুলো নিয়েও তাদের বারবার চিন্তা করতে হয়। এমন একটি পরিস্থিতিতে এই ঘটনাটা (হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের ঘটনা) যে বার্তাটা দিচ্ছে তাতে শিক্ষার যে আসল উদ্দেশ্য, শিক্ষকের যে ভূমিকা সেটা বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল। হুমকির মধ্যে পড়ে গেল। অনেক শিক্ষকই এখন দেখা যাবে যে, তাদের শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় পিছু হটবেন। শিক্ষকের পিছু হটা তো পুরো জাতির জন্যই ভয়াবহ বিষয়।'

তিনি আরও বলেন, 'রাষ্ট্র-সরকার যখন এই ধরনের শিক্ষকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন তো এটা খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়। সামাজিকভাবে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা, অন্য ধর্মের প্রতি কিংবা বিজ্ঞানের প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষের মতো বিষয়গুলো আছেই। যা বাড়ছেও। তাদের সঙ্গে যদি সরকার বা রাষ্ট্র যোগ দেয়, পুলিশ আইন এগুলোর ব্যবহার শুরু হয়, তাহলে তো শিক্ষকরা পিছু হটতে থাকবেন। শিক্ষকদের পিছু হটা মানে পুরো জাতিরই পিছু হটা।'

এদিকে হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও তাকে গ্রেপ্তারের প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, 'অ্যাবসুলিটলি এখানে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় নাই। যদি তারা অডিওটা শুনত তাইলে পুলিশের উচিত ছিল তাৎক্ষণিকভাবে এই অডিওটা যারা রেকর্ড করেছে এবং প্রচার করেছে তাদের গ্রেপ্তার করা।'

এই আইনজীবীর বক্তব্য, 'বিজ্ঞানের শিক্ষক তো বিজ্ঞানই বোঝাবেন। ধর্ম বোঝাবেন না, সাহিত্য বোঝাবেন না। হৃদয় মণ্ডল তার কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করেছেন। অডিওটা শুনলে বোঝা যায় যে, সেখানে ইনটেনশনালি তাকে একের পর এক প্রশ্ন করা হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'পাশাপাশি আমার কাছে যেটা অ্যালার্মিং মনে হয়েছে– প্রথমে টিপ নিয়ে একজন নারীকে আক্রমণ করা হলো। তিনি একজন মাইনরিটি এবং শিক্ষক। দ্বিতীয় হৃদয় মণ্ডল। তিনিও একজন মাইনরিটি ও শিক্ষক। তৃতীয়ত, নওগাঁতেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও অভিযুক্ত একজন শিক্ষয়িত্রী ও মাইনরিটি। আমার কাছে মনে হচ্ছে একটা অরগানাইজড গ্রুপ একটা অরগানাইজড ওয়েতে এমন পরিস্থিতি তৈরি করছে।

এই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জেড আই খান পান্না বলেন, 'বাদী  গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছে, সে নিজেও অডিওটা শোনেনি। সেক্ষেত্রে পুলিশ কেন এটা কোয়্যারি করবে না? পুলিশ বাদীকে কেন জিজ্ঞেস করবে না যে, অডিওটা কোথায়?

'অডিও ছাড়াই পুলিশ মামলা রিসিভ করল। এমনিতে ধর্ষণের অভিযোগে মামলাও পুলিশ অ্যাকসেপ্ট করতে চায় না আজকাল। অথচ পুলিশ এটা অ্যাকসেপ্ট করল।'

অধ্যাপক সাদেকা হালিমের মতে হৃদয় মণ্ডলের ঘটনাটি শিক্ষক কমিউনিটির জন্য 'অত্যন্ত উদ্বেগজনক ও আতঙ্কের'। তিনি বলেন, 'আমরা দেখতে পাচ্ছি, খুবই পরিকল্পিতভাবে কোনো শিক্ষক এখানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে স্বীয় স্বার্থ হাসিল করার জন্য এই কাজটি করেছে। কোমলমতি শিশুদের এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। তাকে একটি প্রশ্নই এক শিক্ষার্থী বার বার জিজ্ঞাসা করেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'ধর্ম ও বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার অমিল আছে। বিজ্ঞান আমাদের শেখাচ্ছে যে যুক্তি দিয়ে বুঝতে হবে, ধর্ম আমাদের কাছে বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের জায়গা আমরা কোনো সময়েই অবমাননা করি না। উনিও (হৃদয় মণ্ডল) সেটা করেননি। কিন্তু যেহেতু উনি একজন মাইনরিটি, তাকে বারবার একই প্রশ্ন করে পরিকল্পিতভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা করা হয়েছে। সেখানে স্থানীয় যে রাজনীতি, সেটাকে ব্যবহার করা হয়েছে। স্কুলের রাজনীতিকে মিশিয়ে।'

তার ভাষ্য, হঠাৎ করে এই বিষয়গুলো নিয়ে এরকম নাড়াচাড়া কিংবা কথা বলাটা বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটা অশুভ সংকেত। তিনি বলেন, 'আমি নিজেই সমাজবিজ্ঞান পড়াই। আমি এখানে সকল ধর্মকে পড়াচ্ছি, সকল ধর্মের বিশ্বাসের কথা পড়াচ্ছি, নৈতিক অবস্থানের কথা পড়াচ্ছি, (ধর্ম) মূল্যবোধ তৈরি করতে যে ভূমিকা রাখে সেটা পড়াচ্ছি। আমি আবার সমাজকে বিশ্লেষণ করার কথাও বলছি।

'আবার আমি এটাও বলছি যে, সমাজে মানুষ যখন বৈষম্যের শিকার হয়, অনেক ক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতেও আমরা সেই বৈষম্যের সৃষ্টি করি। এগুলো তো যুগ যুগ ধরে আমার শিক্ষকদের কাছ থেকে আমি শিখেছি। আমি সেটা পড়াচ্ছি। তাহলে কি বাংলাদেশে কার্ল মার্ক্স, গ্রেইবার, গ্রামসি, হান্টিংটন কাউকে আমরা পড়াতে পারব না? সব কি আমরা বাদ দিব?'

Comments

The Daily Star  | English

Chief adviser returns home after joining COP29 in Baku

Chief Adviser Professor Muhammad Yunus returned home this evening wrapping up his Baku tour to attend the global climate meet Conference of Parties-29 (COP29)

1h ago