টিপ তুমি কথা কও

শামসুর রাহমান কবিতার টিপ নেওয়ার কথা বলেছিলেন পাঠকদের। লিখেছিলেন, 'ছন্দ ও ছড়ায় জীবন কেটেছে/ কবিতা আমার প্রিয়/ আবীর রাঙানো শান্ত বিকেলে/ কবিতার টিপ নিও।' কবিতার টিপ নিচ্ছে কি প্রিয় বাংলাদেশ?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের যেতে হবে রাহমান থেকে কবীর সুমনের কাছে। 'প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর তো জানা।'

বেদনা ও লজ্জার বিষয়: প্রশ্ন-উত্তর জানা থাকলেও টেকসই সমাধান নেই, সদর্থক কোনো উদ্যোগ নেই। টিপ নিয়ে যে কাণ্ড সংঘটিত হলো, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখা। তালাশ করার চেষ্টা টিপের সংস্কৃতি ও শক্তির। কান পেতে শোনার প্রয়াস টিপের ঐতিহ্য ও অপরিহার্যতার পরম্পরা এবং হৃদ মাঝারের সকল অর্ঘ্য দিয়ে এই নিবেদন করা, 'টিপ তুমি কথা কও'।

টিপের কথা শুনব নিশ্চয়। তার আগে শুনে নেই সংস্কৃতির কথা। সংস্কৃতির শক্তি কোথায়? ভাষা-সংস্কৃতি কিংবা নদীর কথায় যদি ধরা যায়, তাহলে আমাদের মনে কি একটিবারের জন্যও এই প্রশ্ন উদিত হয় না, এদের বৈশিষ্ট্য কি আর কোন ধর্ম গুণেই-বা এরা টিকে থাকে কিংবা নিজেদের প্রবহমানতা বজায় রাখে? কিভাবে এরা নিজেদের অস্তিত্বের জয়গান গায় বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী?

নদীর কথায় বলা যাক সবার আগে। যেহেতু আমাদের জন্ম নদীমাতৃক দেশে। নদীর ধর্ম হলো সবকিছুকে গ্রহণ করা এবং এই গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে সে তার জীবনপ্রবাহ বহমান রাখে। এটাই তার নীতি, বেঁচে থাকার ধর্ম। এই নীতি বা ধর্মচ্যুত হলে সে লুপ্ত হয়, মৃতদের তালিকায় নিজেদের নাম লেখায়। নদীর জলে কতো কিছু পড়ে, কতো কিছু যুক্ত হয়, প্রয়োজন বা অপ্রয়োজন ২ কারণেই। তারপরও সেই জল নষ্ট না। এর কারণ একটাই, তার প্রবহমানতা, বেঁচে থাকার জন্য রয়েছে অনিবার্য গতিশীলতা।

ভাষাও তাই। তার কাছে অনেক ভাষার শব্দ হাজির হবে, যুক্ত হবে মিলনের অভিপ্রায়ে। কিন্তু, সে তার নিজস্ব শক্তি দিয়ে ওই ভাষার কিছু শব্দকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে বজায় রাখবে তার প্রবহমানতা, সংগ্রহ করবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় গতিশীলতা।

সংস্কৃতির ধর্মও ঠিক তেমন। সে অন্য সংস্কৃতির উতোর-চাপানের মধ্যে দিয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু নিজস্বতা হারাবে না। কারণ সেটুকু হারালে সে নিজেই হারিয়ে যাবে। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো, সে আত্তীকরণ ও সাঙ্গীকরণে বড়োই পারঙ্গম। ফলে, অন্য সংস্কৃতির যেটা অথবা যে অংশটুকু তার কাছে গ্রহণ করার মতো সেটাকে সে নিজের করে নেয়। অন্য সংস্কৃতির কোনো কিছু যদি গ্রহণ করার মতো না হয়, কিন্তু সেটার শক্তি ও সৌন্দর্য অনস্বীকার্য এবং বাঙালি সংস্কৃতির জন্য সাংঘর্ষিক নয়, তাহলে সেটাকে আত্তীকরণ না করে সাঙ্গীকরণ করে। অর্থাৎ নিজের সঙ্গী রূপে, সহযাত্রী রূপে, সহযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে নিজের প্রবহমানতা অক্ষুণ্ণ ও অটুট রাখে।

টিপ ছোট, কিন্তু তার গুরুত্ব অসীম ও অনস্বীকার্য। কেননা, টিপ তার সৌন্দর্য-গুণে ও প্রতীকায়নের শক্তি বলে কয়েক হাজার বছর ধরে টিকে রয়েছে এবং আগামীতেও টিকে থাকবে। ঋকবেদে টিপের কথা উল্লেখিত হয়েছে, বাল্মিকী যুগেও টিপের ব্যবহার ছিল। শুধু ভারতবর্ষে নয়, এশিয়ায় বিশেষ করে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় টিপের ব্যবহার অনেক পুরনো ও তাদের যাপিত জীবনের যে সাংস্কৃতিক প্রবহমানতা, তার অংশ হয়ে উঠেছে।

টিপ নিয়ে হিন্দু পুরাণে নানা কথা রয়েছে। এমনকি টিপের শ্রেণিভেদও রয়েছে। একদা হিন্দু ধর্মের প্রধান ৪টি বর্ণ—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—ভিন্ন ভিন্ন ধরনের টিপে শ্রেণি বা বর্ণের প্রতিনিধিত্ব করতো। সেই অনুযায়ী তারা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের টিপ পরতো। শূদ্র যেহেতু 'নিচু জাত' এবং আমজনতার প্রতিনিধিত্ব করে, সেহেতু তাদের টিপের রং ছিল কালো। বৈশ্যরা ব্যবসায়ী হওয়ায় তারা হলুদ রঙের টিপ পরতো ব্যবসা বিস্তার ও ফলন্ত হওয়ার প্রত্যাশায়। ক্ষত্রিয়রা পরতো লাল রঙের টিপ, কারণ তারা যোদ্ধা। ব্রাহ্মণরা ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট ও পুত-পবিত্রের দাবিদার হওয়ায় পরতো সাদা চন্দনের টিপ।

টিপের শক্তি ও সৌন্দর্য হলো তার অতীতকে সে পুনর্নির্মাণ করতে পেরেছে নিজস্বতায়। আঁতুড়ঘরের ইতিহাস আর জন্মের ঠিকুজি যাই-ই হোক না কেন, সে নিজেকে হাজির করেছে সবার মধ্যে।

মুসলিম পুরাণেও টিপের কাহিনী রয়েছে বলে কেউ কেউ বলছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, তা আমদানিপূর্বক রপ্তানিও করেছেন। যদিও এ সম্পর্কে শক্তিশালী কোনো দলিল হাজির নেই। তারপরও সেই বয়ানকে যদি আমরা মান্যতা দেই, তাতে টিপের বর্তমান অবস্থানের কোনো হেরফের হয় না।

টিপ নিয়ে অবান্তর প্রশ্ন করার শানে নযুলগুলো কোনোভাবেই যৌক্তিক হয়ে ওঠে না। টিপের যে সাহস, সৌন্দর্য, প্রয়োজনীয়তা ও সাজের অনুপম এক অনুষঙ্গ, সেই জায়গায় কোনো প্রশ্ন রাখার অবকাশ মেলে না। উল্টো এই ভাবনা সংগত ও যুক্তিযুক্ত হয়ে দাঁড়ায় যে, টিপ কোন সেই শক্তির আধার যার গুণে আজও রয়ে গেয়ে ঘর-গেরস্থের বাঙালিয়ানায়। কায়মনে বাঙালি হওয়ার যে সাধনা ও অভীষ্ট অভিলাষ এবং প্রার্থিত প্রার্থনা সেখানে টিপ হয়ে উঠেছে অনিবার্য এক অনুষঙ্গ।

ছোট্ট একটা টিপ, কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করেছে ভালো লাগা ও ভালোবাসার মোহনীয় এক আঁধার রূপে। নিজেই হয়ে ওঠেছে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বাহন ও চেতনার মৌল প্রতিভূ। চাঁদ যে কাকা না হয়ে মামা হয়ে উঠলো সেতো সেই টিপের কারণেই। কেননা, শিশুকে টিপ দেওয়ার জন্য যিনি আহবান করছেন তিনি মা। আর জগত সংসারে মায়ের তো চিরকালীন এক বড়ো আশ্রয় তার ভাই। এ কারণে মায়ের কাছে চাঁদ তার ভাই এবং শিশুর কাছে মামা। সেই মামাকে কি টিপ ছাড়া চেনা যায়, নাকি কোনোভাবেই মানায়?

টিপ পরার উপকারিতাও রয়েছে। শুধু টিপই নয়, যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বছরের পর বছর টিকে রয়েছে এবং সর্বজনীনতা পেয়েছে তার বেশিরভাগেরই রয়েছে বহুমুখী উপকারিতা, দু-একটা ব্যতিক্রম বাদে। পান্তা ভাতের উপকারিতা যেমন এখন বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত ও মর্যাদাপ্রাপ্ত, টিপেরও উপকারিতা অনেক।

কপালের মাঝখানে এর স্থান করে নেওয়ার পেছনেও রয়েছে যুতসই কার্যকারণ। এসবের জন্যই টিপের আঁতুড়ঘরের ইতিহাসের চেয়ে বর্তমানকে দেখা জরুরি। কেন টিপের মতো ছোট্ট একটা সাজ অনুষঙ্গ নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নিজের প্রবহমানতা বজায় রাখতে সক্ষম, সাবলীল ও গতিশীল হলো; টিপ নিয়ে আলটপকা-উটকো কোনো মন্তব্য করার আগে সেটা বোঝা জরুরি।

আমরা যদি ধর্ম ও সংস্কৃতিকে তাদের স্ব স্ব শক্তি ও আধারের জায়গা থেকে না দেখি, তাহলে হয়তো বলা যাবে অনেক কিছুই। কিন্তু, তাতে টিপের কিছুই যায় আসে না। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অগ্রগতি, উন্নয়ন ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সামাজিক অবস্থান স্বস্তিদায়ক হবে না, অস্বস্তি বিঁধবে খচখচ করে প্রতিনিয়ত। সেটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের প্রাণশক্তিকে বাধাগ্রস্ত করবে।

টিপ নিয়ে সম্প্রতি লতা সমাদ্দারের সঙ্গে যা হয়েছে তা কোনোভাবেই সুস্থ সমাজের বাস্তবতা নয় এবং সেই ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখে যেভাবে দ্বিখণ্ডিত মন ও মানসিকতার প্রকাশ দেখা গেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, তাও কোনো ইতিবাচক মানসিকতার পরিচয় বহন করে না। অশ্লীলতা কিছুই পয়দা করে না, ক্ষতি ও ধ্বংসই আনে কেবল।

প্রশ্ন হলো, টিপ পরা নিয়ে যে কাণ্ড ঘটলো এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য যে মানসিকতার পরিচয় দিলেন, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এবং রাষ্ট্রের অন্দরে-বাহিরে কি এ ধরনের মন-মানসিকতার মানুষের বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে না?

টিপ নিয়ে এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যবস্থা কি দৃশ্যমান ও কার্যকর হবে, যার মধ্যে দিয়ে এই বাস্তবতা ও মন-মানসিকতা রোধ করা যাবে বা ধীরে ধীরে লুপ্ত হবে? যদি তা না করা হয়, তাহলে হয়তো ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে। কিন্তু, সেই ধামার নিচে যে আগাছা ও বিষবৃক্ষের বীজ থেকে গেল, তা শুধু টিপের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে না, কাল হবে বাঙালি সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্যও।

আজ টিপ পরার জন্য ভর্ৎসনা দেখছেন, সেদিন হয়তো দেখবেন 'আয় আয় চাঁদ মামা/ টিপ দিয়ে যা/ চাঁদের কপালে চাঁদ/ টিপ দিয়ে যা'—এই ছড়া পাঠের জন্যও ভর্ৎসনা করা হচ্ছে। ভর্ৎসনা করা হচ্ছে শামসুর রাহমানকে 'তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা,/ সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর'—এই কবিতা লেখার জন্য। তখন হয়তো মনের মধ্যে আঁকুপাঁকু করলেও আমরা বলতে পারব না 'আবীর রাঙানো শান্ত বিকেলে কবিতার টিপ নিও'।

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Seeking police services: 38% faced harassment, 31% paid bribes

Forty percent of 2,040 university-level students who participated in a recent survey reported paying bribes or facing harassment while seeking police services, while only 10.5 percent experienced smooth service.

1h ago