মধুপুর বনে কেন কৃত্রিম হ্রদ?
মধুপুর শালবন এলাকায় বন বিভাগ একটি বাইদ খনন করে কৃত্রিম হ্রদ তৈরি করতে চাচ্ছে। মধুপুর গড় এলাকার নিচু জমিকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় বাইদ, যেখানে ধানসহ অন্যান্য ফসলের আবাদ হয়। আর নিচু জমি থেকে ৩-৪ ফুট উঁচু জমি চালা হিসেবে পরিচিত। শালসহ অন্যান্য প্রজাতির বৃক্ষ দেখা যায় এখানে। এটিই লাল মাটির শালবনের স্বাভাবিক চিত্র। মধুপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় শাল ও অন্যান্য দেশি প্রজাতির বৃক্ষ বিলীন হয়েছে। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে বিদেশি প্রজাতির অ্যাকাশিয়া, আনারস, কলা ও মসলার আবাদ। আর এভাবেই মধুপুর শালবনের অধিকাংশ জায়গায় বাইদ-চালার সৌন্দর্য বিলুপ্ত হয়েছে।
দোখলা রেঞ্জ অফিস থেকে পশ্চিম-পূর্বে লম্বা এমনই একটি বাইদের পাশে বন বিভাগ একটি দোতলা গেস্ট হাউজ নির্মাণ করছে। একইসঙ্গে বাইদের ৪ একর জমিতে ছোট একটি কৃত্রিম হ্রদ (২০০ ফুট বাই ৮০০ ফুট) খনন করতে চাচ্ছে। এ গেস্ট হাউজে যারা আসবেন তাদের বিনোদনের জন্যই এ হ্রদ। বন বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবশ্য জানিয়েছেন, এ হ্রদের পানিতে বন্যপ্রাণীরা তৃষ্ণা মেটাতে আসবে।
বাইদের যেখানটায় কৃত্রিম হ্রদ খননের পরিকল্পনা করছে বন বিভাগ, তার মালিক (সনাতনী অধিকারের ভিত্তিতে) কিছু গারো পরিবার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্যবহৃত এ জমি তারা একেবারেই ছাড়তে নারাজ। গারোরা এ এলাকায় বসবাস করেন বন বিভাগ সৃষ্টির অনেক আগে থেকে এবং তারা একসময় জমিদারদের কাছ থেকে জমির বছর মেয়াদি লিজ (পাট্টা) এবং দীর্ঘমেয়াদি লিজ (পত্তনি) নিতেন। এই জমির কার্যত মালিক গারোদের দাবি, তারা অতীতে জমির খাজনা দিতেন। কিন্তু জমি বনভূমি হিসেবে গেজেটভুক্ত এবং এ এলাকাটি মধুপুর জাতীয় উদ্যানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে খাজনা নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণেই এলাকার গারো, কোচ ও বাঙালিদের ৯০ শতাংশেরই জমির মালিকানা দলিল নেই। ফলে বন বিভাগের সঙ্গে তাদের বিবাদ লেগেই আছে। কারণ বন বিভাগ গেজেটভুক্ত সব জমির মালিকানা দাবি করে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে এ বাইদের জমির মালিকদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা সবাই তখন তাদের কৃষি জমিতে ছোট এই কৃত্রিম হ্রদ খননের বিপক্ষে অবস্থানের কথা জানান।
'এখানে সরকারের নেওয়া হ্রদ খননের পরিকল্পনাটি কোনোরূপ মহৎ উদ্দেশ্য প্রমাণ করে না', বলেন দীপেন নকরেক (৬৫)। যিনি বাইদের ২ দশমিক ৪ একর জমির মালিকানার দাবিদার।
বেলি নকরেক (২৭), অপর এক গারো যিনি ৭১ শতাংশ জমির মালিকানা দাবি করেন, তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, 'আমি এখানে হ্রদ চাই না। সরকার যদি আমাদের সম্মতি ছাড়া এখানে হ্রদ খনন করতে চায়, তবে আমরা প্রতিবাদ করব।'
কয়েক মাস ধরে গারো ও বন বিভাগের মধ্যে হ্রদ খনন নিয়ে টানাপড়েন চলছে। হ্রদ নিয়ে গারোরা দ্বিধাবিভক্ত। কিছু মানুষ এর পক্ষে, কিন্তু অধিকাংশই এর বিপক্ষে অথবা দ্বিধাদ্বন্দ্বে।
এই বাইদের অল্প কিছু জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য বন বিভাগ, রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসন গারোদের হাত করার চেষ্টায় আছেন। 'তারা এ জমির জন্য কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন', বলেন মধুপুরের প্রধান গারো সামাজিক সংগঠন 'জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ'-এর সভাপতি ইউজিন নকরেক। 'কিন্তু আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। যদি যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় এবং আমাদের অন্যান্য দাবি পূরণ করা হয়, তবে আমরা সম্মতি দিতে পারি', বলেন তিনি।
'১৯ মার্চ রাজনীতিবিদ, স্থানীয় প্রশাসন ও বনবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জেলা প্রশাসক ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন, যা খুবই সামান্য', বলেন ওই বৈঠকে উপস্থিত নকরেক।
কেন কৃত্রিম হ্রদ?
মধুপুর বন সর্বাঙ্গে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। অরণ্যের সুবাতাস আর নেই। বনের অধিকাংশ জায়গা এখন দখল করে নিয়েছে কলা, আনারস, পেঁপে, মসলা এবং লেবুর বাগান। বন বিনাশ এখানে কোনো নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমরা রাবার গাছের আবির্ভাব এবং পরবর্তীতে সামাজিক বনায়নের নামে বিদেশি প্রজাতির বৃক্ষরোপণ দেখি, যা মধুপুর ও অন্যান্য জায়গার ঐতিহ্যবাহী শালবনকে দ্রুত ধ্বংস করে দিয়েছে। এ ছাড়াও, তথাকথিত সামাজিক বনায়ন দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোর প্রাকৃতিক বনভূমির ব্যাপক ক্ষতির পেছনে অন্যতম কারণ।
১৯৯০-এর দশক থেকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে বন প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বন 'সহ-ব্যবস্থাপনা'র সূচনা। এডিবির অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প বনের চিরায়ত পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়েছে, এমনটি প্রমাণিত হওয়ার পর বাংলাদেশসহ সমগ্র এশিয়াতে ২০০৫ সাল থেকে তাদের বন সংক্রান্ত কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। তবে বন সহ-ব্যবস্থাপনা অব্যাহত থাকে। বর্তমানে বন বিভাগ বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ১৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রকল্প, 'টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল)' বাস্তবায়ন করছে। এ প্রকল্প নানা কারণে বিতর্কিত। যেমন: এ প্রকল্পে বন সহ-ব্যবস্থাপনার কাছাকাছি মডেল সহযোগী (কোলাবোরেটিভ) বন ব্যবস্থাপনা চালু করা হয়েছে। সহ-ব্যবস্থাপনা (বনবিভাগ ও স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণে বন ব্যবস্থাপনা) আমাদের বন সুরক্ষায় কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখেনি। তবে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান (এডিবি ও বিশ্বব্যাংক) থেকে বন প্রকল্পের জন্য সহজ শর্তে প্রাপ্ত ঋণ প্রকল্পবাজদের জন্য বিপুল আর্থিক সুবিধা এনে দিয়েছে।
দোখলা রেঞ্জ অফিস চত্বরে যে গেস্ট হাউজ এবং হ্রদ— সঠিকভাবে বললে বলতে হয় পুকুর— যা সম্পূর্ণভাবে সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত 'স্থানীয় ও নৃ-গোষ্ঠী জনগণের সহায়তায় মধুপুর ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনা' শীর্ষক প্রকল্পেরই অংশ। বন বিভাগের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে, গেস্ট হাউজ ও হ্রদ তৈরি জাতীয় উদ্যান সদর রেঞ্জের ৩ হেক্টর জমির ওপর আরবোরেটামের (উদ্ভিদবিদ্যা অনুশীলনের উপযোগী উদ্যান) সঙ্গে যুক্ত।
মধুপুর বনের প্রায় অর্ধেক, যেখানে আনারস, কলা এবং মসলার বাগান গ্রাস করে নিয়েছে, সেখানে ছোট একটি উদ্ভিদ উদ্যান নির্মাণ বৃক্ষ রক্ষার ক্ষেত্রে কোনোরকম আশার আলো দেখায় না। মধুপুরের মানুষ দেখেছে তথাকথিত সামাজিক বনায়ন কীভাবে বন বিনাশের প্রধান কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। সামাজিক বনায়ন যেখানে হয়েছে সেখানে খুব কম সময়ের মধ্যে আনারস, কলা, পেঁপে, ও মসলার আবাদ জায়গা করে নিয়েছে। সামাজিক বনায়নের থাবা থেকে চাড়ালজানি বন গবেষণা কেন্দ্রটিও রক্ষা পায়নি। ১৯৬৭ সালে ৪০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত গবেষণা কেন্দ্রটি কিছুদিন আগেও স্থানীয় এবং বিদেশি নানা প্রজাতির উদ্ভিদ দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল। তবে বর্তমানে তা কমতে কমতে ২০ একরে এসে দাঁড়িয়েছে এবং এটিকে আর বন গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে চেনা যায় না।
চাড়ালজানি বন গবেষণা কেন্দ্রের পাশে ২০০৩ সালে স্থাপিত হয় একটি ঔষধি গাছের বাগান। এটিও অর্থপূর্ণ কোনো উদাহরণ নয়। সুফল প্রকল্পে বনতলের শত শত গাছ কেটে যেভাবে কিছু দেশি প্রজাতি ফলদ ও অন্যান্য বৃক্ষ চাষ করা হয়েছে, তাতে এলাকাবাসী অবাক হচ্ছে। মধুপুর শালবনে এসব দেখে এলাকাবাসী ত্যক্ত-বিরক্ত। তবে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী বহিরাগত কলা, আনারস ও মশলাচাষিরা বনভূমিতে এসব ফল, মশলা চাষ থেকে বিপুল মুনাফা করছেন।
এলাকাবাসী একটি ছোট আরবোরেটাম এবং তার সঙ্গে গেস্ট হাউজ ও কৃত্রিম হ্রদ তৈরির ধারণাকে হাস্যকর ও তামাশা মনে করছে। অনেকেরই প্রশ্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের একটি চমৎকার বাইদের জায়গায় কেন একটি কৃত্রিম হ্রদ খনন করতে হবে। গেস্ট হাউজে যারা আসবেন, তারা কি বর্তমানে যে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিরাজমান তা দেখে খুশি হবেন না? তারা যদি পানি দেখতে চান তো গাড়িতে করে লহরিয়া বন বিটের কাছে ১৯৮০-র দশকে তৈরি হ্রদে চলে যেতে পরেন। লেকটি বর্তমানে পরিত্যক্ত। এর আশেপাশে যেসব স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিল তা আগাছা আবৃত এবং খসে পড়ছে। গেস্ট হাউজের অতিথিরা দোখলা থেকে রসুলপুর পর্যন্ত গাড়িতে যেতে পারেন, দেখতে পারেন এখন বেঁচে থাকা কিছু শাল-গজারির বন। তারা যদি 'সবুজ মরুভূমি' দেখতে চান তো ঘুরে আসতে পারেন প্রাকৃতিক বনের জায়গায় তৈরি রাবার বাগান।
টিনশেডের কটেজগুলে নিয়ে খোলামেলা পরিবেশে দোখলা ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস চত্বর বেশ সুন্দর ছিল। আমাদের ১৯৭২ সালের সংবিধানের একটা অংশ এখানে বসে লেখা হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে কয়েক দিন অবকাশ যাপন করেছিলেন দোখলা রেস্ট হাউজে। এটি আমাদের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা, যা সবার জানা উচিত। তবে এখন এ চত্বরের প্রবেশমুখে বিরাট এক নিরাপত্তা ফটক বসানো হয়েছে। এক সময়কার চমৎকার নৈসর্গিক চিত্র পাল্টে গেছে। বাতাস যেন তার স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। দোতলা একটি গেস্ট হাউজ এবং একটি ছোট হ্রদ এখানকার নৈসর্গিক চিত্র মুছে দেবে। এতে এখানকার মানুষের স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত হবে। দোখলা রেঞ্জ অফিস চত্বর দিয়ে দোখলা বাজারে যেতে গারোরা যে মাটির রাস্তা ব্যবহার করে, সেটিও হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। গেস্ট হাউজ ও হ্রদ বাইদ সংলগ্ন শতভাগ গারো গ্রাম চুনিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মধুপুরের গারোরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তারা অন্তরে ধারণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য। তারপরও তাদেরকে ৪ একরের মতো বাইদের জমি ছেড়ে দিতে জোরাজুরি করতে হচ্ছে যেখানে তারা স্বেচ্ছায় কলা, আনারস, পেঁপে ও মশলার আবাদের জন্য তাদের উঁচু জমির অধিকাংশ মেদি (লিজ) দিয়েছেন।
শেষ পর্যন্ত গারোরা কিছু ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে হয়তো বাইদের জমি ছাড়তেও পারেন। তবে তারা স্বেচ্ছায় হ্রদের জন্য জমি দেবেন না, এমনটাই তারা বলছেন নানাভাবে। গারোদের অনেক দাবির মধ্যে অন্যতম হলো- সনাতনী ভূমির অধিকার, যা রাষ্ট্র অস্বীকার করে। আমরা আশা করব সরকার সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং এর বিপর্যয়কর কুফল বিবেচনা করে মধুপুর এবং সেখানে বসবাসকারী শান্তিপ্রিয় গারোদের প্রতি সুবিচার করবে।
ফিলিপ গাইন: গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (শেড) পরিচালক
Philip.gain@gmail.com
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments