ট্রেনের টিকিট কেন ‘সহজ’ নয়
দুই ঈদের আগে ট্রেনের টিকিট পেতে সাধারণ মানুষের যে ভোগান্তির চিত্র আমরা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখি, সেরকম চিত্রই এখন দেখা যাচ্ছে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে।
কোনো উৎসব নেই, কিন্তু তারপরও সহজে মিলছে না ট্রেনের টিকিট। যদিও 'সহজ' নামে একটি অনলাইন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে ট্রেনের টিকিট বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এতদিন কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সার্ভিস (সিএনএস) নামে একটি প্রতিষ্ঠান অনলাইনে ট্রেনের টিকিট বিক্রি করতো। তাদেরকে বাদ দিয়ে সহজকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও ট্রেনের টিকিট পাওয়া এখন ভয়াবহ কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগে স্টেশনের কাউন্টার থেকে রেলের কর্মীরা ট্রেনের টিকিট দিতেন, এখনও সেই পদ্ধতিটি আছে। তবে, পুরো পদ্ধতিটি পরিচালনা করছে 'সহজ ডটকম'। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তারা পুরোপুরি প্রস্তুত না হয়েই সিস্টেমটি চালু করেছে। যে কারণে একটা লেজেগোবরে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
অনলাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করেও মানুষ ট্রেনের টিকিট পাচ্ছেন না। ফলে তারাও ভিড় করছেন কাউন্টারে। তৈরি হচ্ছে লম্বা লাইন, ভোগান্তি।
এরা যে কতটা অদক্ষ তার প্রমাণও তারা এরইমধ্যে দিয়েছে। সময় টেলিভিশনের একটি খবরে বলা হয়েছে, সহজ ডটকমের টিকিট বিক্রির তৃতীয় দিন ২৮ মার্চে একটি গন্তব্যের টিকিট প্রতি রেলের লোকসান হয়েছে ৪১২ টাকা। জামালপুরের তারাকান্দি রেলস্টেশন থেকে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত জামালপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের প্রতিটি এসি সিটের দাম ৪৩২ টাকা। এই টিকিট সহজ বিক্রি করেছে মাত্র ২০ টাকায়।
ইমরান হোসাইন নামে এক যাত্রী সহজ ডটকমের নতুন ওয়েবসাইট দিয়ে তারাকান্দি থেকে টিকিট কেনার চেষ্টা করেন এবং তিনি অনায়াসে একটি এসি সিটের টিকিট কেনেন মাত্র ২০ টাকায়। এরকম আরও কত যাত্রীর ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটেছে তা জানা যায়নি। তার মানে পুরো সিস্টেমটি এখনও আপডেট হয়নি। সিস্টেম আপডেট না করেই টিকিট বিক্রি শুরু করে দিয়েছে সহজ ডটকম। সিস্টেম আপডেট করতে কতদিন বা কত মাস লাগবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানা যাচ্ছে না। কিন্তু যদি এক মাসও এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে সরকারের কত টাকা লস হবে এবং এই সময়ের মধ্যে যাত্রীদের যে দুর্ভোগ হবে—তার ক্ষতিপূরণ কে দেবে?
সিএনএস দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করেছে। তাদের সঙ্গে রেলের চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ২ বার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সবশেষ মেয়াদান্তে নতুন করে টেন্ডার হয়। আগে সিএনএস কাউন্টারের প্রতিটি টিকিটের জন্য নিতো ৩ টাকা, আর অনলাইনে প্রতি টিকিটে ভ্যাট, রাজস্ব, রেলের ট্যাক্স, বিটিআরসির খরচসহ নিতো ২০ টাকা। যেখান থেকে সিএনএস পেত ৭ টাকা।
কিন্তু নতুন টেন্ডারে 'সহজ' কাউন্টারের প্রতি টিকিটের জন্য ২৫ পয়সা আর অনলাইনের খরচ যেহেতু, একই সুতরাং ২০ টাকাই অফার করে। নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে 'সহজ' কাজটি পেলেও সিএনএস রেলের বিরুদ্ধে মামলা করে। দেড় বছর মামলা চলার পর আদালতের রায়ে 'সহজ' টিকিট বিক্রির দায়িত্ব পায়। তারা আগের সব সফটওয়্যার বাতিল করে নতুন প্রযুক্তিতে কাউন্টারে টিকিট বিক্রি শুরু করে। আগের সব অনলাইন মাধ্যম, যেমন অ্যাপ, ওয়েবসাইটও বাতিল করে এবং নতুন ওয়েবসাইট চালু করে।
সমস্যা হলো, অ্যাপ বাতিল হয়ে শুধুমাত্র ওয়েবসাইটে এখন টিকিট বিক্রি হচ্ছে। মোট টিকিটের ৫০ ভাগ কাউন্টারে এবং ৫০ ভাগ অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। যদি কোনো ট্রেন ছাড়ার ৪৮ ঘণ্টা আগে অনলাইনে সব টিকিট বিক্রি না হয়, তাহলে বাকি টিকিট অটোমেটিক কাউন্টারে যুক্ত হয়ে যাওয়ার কথা। এই পুরো ব্যবস্থাপনাটি সুচারুভাবে সম্পন্নের আগেই তারা কাজ শুরু করে দেয় এবং এখন তারা বলছে যে, সিস্টেম ঠিক হতে সময় লাগবে।
একটি ট্রেন তার গন্তব্যে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরুর পর যদি সেটা মেরামত করতে হয়, তাহলে দুর্ঘটনা নিশ্চিত। টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। পুরোপুরি প্রস্তুতি ছাড়াই টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে। অথচ যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করেও অনলাইনে টিকিট কাটতে পারছেন না। তাদের যেতে হচ্ছে রেলস্টেশনে।
আবার সেখানেও সিস্টেম যেহেতু সহজ নিয়ন্ত্রণ করছে, ফলে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হচ্ছে। মাসখানেক পরেই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এর মধ্যে যদি পুরো সিস্টেম সচল না হয়, তাহলে ট্রেনের টিকিট নিয়ে যে তখন একটি বিরাট নৈরাজ্য হবে—তা চোখ বন্ধ করেই বলে দেওয়া যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, রেল কর্তৃপক্ষ নতুন প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিলো যে পয়সা বাঁচানোর জন্য, তার বিনিময়ে এখন যে দুর্ভোগ হচ্ছে, তার অর্থনৈতিক মূল্য কত? দ্বিতীয়ত, যে প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, তারা এই কাজের জন্য কতটা যোগ্য এবং কতটা প্রস্তুত—তা যাচাই-বাছাই না করেই কি তাদের হাতে পুরো সিস্টেমটি ছেড়ে দেওয়া হলো?
দেশের যেকোনো সরকারি বা রাষ্ট্রীয় সেবা পেতে নাগরিকদের হয়রানির অভিযোগ বহু পুরনো। যে কারণে অনেক সময়ই বলা হয়, সেবা খাতগুলো ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেওয়া হোক। তাতে জবাবদিহি বাড়বে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক সময় তা বলে না—যার বড় উদাহরণ রেলের টিকিট।
তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কেন নিজেরাই টিকিট বিক্রির দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ? তাদের কি জনবল সংকট? রেলের কি বাজেট কম? সরকারি বহু প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত জনবল আছে—এরকম কথাও শোনা যায়। রেলেরও যে মোট জনবল, তাদের সবাই কি ঠিকমতো নিজেদের কাজগুলো করছেন?
প্রতিবেশী দেশ ভারতেও রেলের টিকিট রেলস্টেশনের আশেপাশের নির্ধারিত দোকান থেকে কিনতে পাওয়া যায়। এ জন্য টিকিটের দামের সঙ্গে সামান্য কিছু বাড়তি টাকা দিতে হয়। তারপরও মানুষ খুশি। কারণ কাউন্টারের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে বা অনলাইনে নেটওয়ার্ক জটিলতায় পড়তে হয় না। আমাদের দেশে এখনও সেই সিস্টেম গড়ে তোলা যায়নি। যদি স্টেশনের আশেপাশে এবং শহরের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পয়েন্টে রেলের টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা থাকতো এবং প্রতি টিকিটে যদি বাড়তি ১০ থেকে ২০ টাকা নেওয়া হতো, তারপরও মানুষ হয়রানি ও ভোগান্তি এড়াতে এসব জায়গা থেকে টিকিট কাটতো। কিন্তু সেই পদ্ধতিতে না গিয়ে ডিজিটাল সিস্টেমের নামে মানুষের ভোগান্তি বাড়ানো হচ্ছে। এতে রাষ্ট্রের কত টাকা সাশ্রয় হচ্ছে? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন মানুষ আদৌ তার কাঙ্ক্ষিত সেবাটি পাচ্ছে কি না? যদি না পায়, তাহলে এর পেছনে কোনো প্রভাবশালী মহলের অনিয়ম ও দুর্নীতি রয়েছে কি না? রেল কর্তৃপক্ষের দায় কতটুকু—তাও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে।
মানুষ টাকা দিয়ে টিকিট কেনে। সুতরাং সেখানে কোনো ধরনের হয়রানি বা ভোগান্তি হলে তার পুরো দায় রেল কর্তৃপক্ষের। তারা ব্যক্তি মালিকানাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিলো, এখানে কোনো পয়সার ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে কি না, সেই প্রতিষ্ঠান আসলেই কতটা যোগ্য ও দক্ষ, তারচেয়ে বড় প্রশ্ন, বছরের পর বছর ধরে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মনে যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে রাষ্ট্র কী করছে?
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments